মোঃ সোহেল রিগ্যান
প্রতিবছর কল্পনা চাকমা ইস্যুতে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করার প্রচেষ্টা অত্যন্ত দুঃখজনক। তাই এই ইস্যুর প্রকৃত সত্য উদঘাটনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে পাঠকদের জন্য বিষয়টি বিশদভাবে তুলে ধরা হলো।
পার্বত্য চট্টগ্রামে যেকোনো ঘটনায় সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করা আঞ্চলিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর নিয়মিত কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি নতুন কিছু নয়। জাতির অধিকারের দাবি তুলে এই গোষ্ঠীগুলো পাহাড়ে অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, খুন-গুমসহ রাষ্ট্র বিভাজনের গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এই বিষয়ে সচেতন মহল রহস্যজনকভাবে নীরব থাকে। অথচ ১৯৯৬ সালে নিখোঁজ কল্পনা চাকমা নামে একজন উপজাতি নারীকে নিয়ে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ ছড়িয়ে তাদের অপপ্রচার অব্যাহত রয়েছে। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে জানা প্রয়োজন, কে এই কল্পনা চাকমা?
কল্পনা চাকমা, পিতা: গুণরঞ্জন চাকমা, মাতা: বাঁধুনি চাকমা। গুণরঞ্জনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে কল্পনা ছিলেন সবচেয়ে ছোট। তিনি রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার লাল্যাঘোনা এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস), তৎকালীন শান্তিবাহিনীর সহযোগী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডব্লিউএফ)-এর বাঘাইছড়ি শাখার সাংগঠনিক সম্পাদিকা ছিলেন।
দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী সংগঠনের সহযোগী হিসেবে কাজ করার সুবাদে তিনি ভারতের অরুণাচল প্রদেশে বসবাসকারী অরুণ বিকাশ চাকমার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান। অরুণ বিকাশ চাকমা পিসিজেএসএস-এর ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে একাধিক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে এই প্রেমের সম্পর্ক কল্পনার পরিবার এবং পিসিজেএসএস-এর একাংশ মেনে নিতে পারেনি, যা দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পিসিজেএসএস প্রতিষ্ঠার পর থেকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এবং তার ভাই সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করে আসছিলেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, কল্পনা চাকমার অপহরণের অভিযোগ এই ষড়যন্ত্রের একটি অংশ। তাদের লক্ষ্য ছিল এই ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসবাদ কায়েম করা এবং রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে বিপাকে ফেলে নিজেদের অবস্থান শক্ত করা।
১৯৯৬ সালের ১১ জুন গভীর রাতে পিসিজেএসএস-এর একাংশ এবং পিসিপি’র কয়েকজন সদস্য গোপনে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা এলাকা থেকে কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করে তাকে তার প্রেমিক অরুণ বিকাশ চাকমার কাছে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে পাঠিয়ে দেয়। এর পেছনে একটি বড় কারণ ছিল ১৯৬৬ সালের সংসদ নির্বাচনে পিসিজেএসএস-এর সহযোগী সংগঠন পাহাড়ি গণপরিষদের প্রার্থী বিজয় কেতন চাকমার পক্ষে প্রচারণার নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কল্পনা চাকমা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালান। এতে পিসিজেএসএস এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলো তাদের প্রার্থীর পরাজয়ের আশঙ্কা করে এবং কল্পনাকে তাদের পথের কাঁটা হিসেবে বিবেচনা করে তাকে অপহরণ করে।
উপজাতি সন্ত্রাসীরা দাবি করে যে, লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস এই অপহরণের সঙ্গে জড়িত এবং অপহরণের সময় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা মুহুর্মুহু গুলি চালিয়ে এলাকাবাসীকে ভীতসন্ত্রস্ত করেছিল। কিন্তু কল্পনার ভাই কালিন্দী চাকমা এই ঘটনায় যে মামলা করেছিলেন, তাতে সেনাবাহিনী বা গোলাগুলির কোনো উল্লেখ ছিল না। তিনি শুধু অপরিচিত কিছু সন্দেহভাজন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেছেন।
লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস ঘটনার দিন সকালে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য উগলছড়ি ক্যাম্পে আসেন, যা কল্পনার বাড়ির কাছাকাছি ছিল। সেখানে একজন মেজর, একজন ক্যাপ্টেন, দুজন লেফটেন্যান্টসহ প্রায় ৯০ জন সৈনিক উপস্থিত ছিলেন। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা এবং নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা সেদিন রাতে উগলছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থান করেন।
এখন প্রশ্ন হলো, সশস্ত্র বাহিনী যদি গুলি চালিয়ে থাকে, তাহলে এতজন মানুষের মধ্যে কেউ কেন শুনল না? সেনাবাহিনীর গুলিতে কেউ আহত বা নিহত হলো না কেন? সেনাবাহিনী যদি অপহরণে জড়িত থাকত, তাহলে মামলায় তাদের নাম উল্লেখ করা হলো না কেন?
প্রকৃত সত্য হলো, লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনার মাধ্যমে পিসিজেএসএস এবং পিসিপি’র মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি উগলছড়ি ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন এবং নির্বাচনের সময় সেখানে দায়িত্ব পালন করতে আসেন। তার সাফল্য শান্তিবাহিনীর অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি এবং সাংগঠনিক তৎপরতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এর ফলে নির্বাচনে ভোট কারচুপি রোধ করার পরিবেশ তৈরি হয় এবং পিসিজেএসএস তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে সাংগঠনিক ভাঙনের আশঙ্কা করে। এই পরিস্থিতিতে লেফটেন্যান্ট ফেরদৌসের বিরুদ্ধে অপহরণের মিথ্যা অভিযোগ সাজানো হয়।
জেএসএস সিনিয়র নেতাদের নির্দেশনায় কৌশল ব্যবহার করে তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করে। তারা কল্পনা চাকমার অপহরণের দায় সেনাবাহিনীর ওপর চাপিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে থাকে।
উল্লেখ্য, পার্বত্য চুক্তির আগে পিসিজেএসএস-এর অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে দুটি গ্রুপ—এমএন লারমা গ্রুপ এবং প্রীতি গ্রুপ—গঠিত হয়েছিল। এই কোন্দলের জেরে ১৯৮৩ সালে শান্তিবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে হত্যা করা হয়। উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো এবং অনেক উপজাতি তাকে জুম্ম জাতির অভিভাবক মনে করলেও তার হত্যার বিষয়ে কোনো মামলা বা আন্দোলন হয়নি। এই নীরবতা রহস্যজনক। কিন্তু কল্পনা চাকমার ইস্যুতে তাদের সোচ্চারতা কেন? এর উত্তর সহজ—এই ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্র, প্রশাসন এবং সেনাবাহিনীকে বিপাকে ফেলাই তাদের উদ্দেশ্য।
পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে জুম্মল্যান্ড নামে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকেই শান্তিবাহিনী করে আসছে। স্বাধীনতার পর সরকার যখন রাষ্ট্র পুনর্গঠনে ব্যস্ত, তখন শান্তিবাহিনী অস্ত্র হাতে তুলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ এবং সেনাবাহিনীর ওপর হামলা শুরু করে। এটি স্পষ্ট যে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি। তারা অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, অপহরণ এবং খুন-গুমের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। তাদের পথে প্রধান বাধা ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তাই তাদের স্লোগান ছিল ‘পাহাড় থেকে সেনা হটাও’।
১৯৯৬ সালের ১১ জুন কল্পনা চাকমার অপহরণ নাটক এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সাজানো হয়েছিল। সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করতে এবং রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে এই ঘটনাকে কাজে লাগানো হয়। ১৯৯৬ সালের ৮ ও ৯ আগস্ট জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বরাতে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, কল্পনা চাকমা সেনাবাহিনী দ্বারা অপহৃত হননি। তার মা জানিয়েছেন, অপহরণের পর তার সঙ্গে দুইবার যোগাযোগ হয়েছিল।
কল্পনা চাকমার অপহরণের ঘটনা বিজয় কেতন চাকমার পক্ষে ভোট না করা এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থী দীপংকর তালুকদারের পক্ষে প্রচারণার প্রতিশোধ হিসেবে তার নিজ দলের সন্ত্রাসীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল। সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করা এবং সাংগঠনিক অবস্থান শক্ত করাই ছিল তাদের লক্ষ্য।
পত্র-পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, কল্পনা চাকমা ভারতের অরুণাচলে তার স্বামী অরুণ বিকাশ চাকমার সঙ্গে বসবাস করছেন। সরকারের একজন কর্মকর্তার চিঠির জবাবে তিনি জানিয়েছেন, তিনি দেশে ফিরতে আগ্রহী, কিন্তু সন্ত্রাসীদের ভয়ে ফিরছেন না। পুলিশ তার পরিবারকে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য অনুরোধ করলেও তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে, যা থেকে বোঝা যায় এই অপহরণ একটি সাজানো নাটক।
পার্বত্য চুক্তির পর সন্তু লারমার জেএসএস এই ইস্যু থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে, কারণ তারা জানে সেনাবাহিনী এতে জড়িত নয়। তবে ইউপিডিএফ এই ইস্যুকে রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহার করে চলেছে। কল্পনার ভাই কালিন্দী চাকমার দায়ের করা মামলা ২০২৩ সালের ২৩ এপ্রিল আদালত কর্তৃক শেষ হয় এবং আসামিদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবুও প্রতিবছর এই ইস্যুতে ইউপিডিএফ-এর সোচ্চারতা রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীকে বিপাকে ফেলার একটি মিথ্যা কৌশল মাত্র। এই নাটক আর কতদিন চলবে?