পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একজন আমিও। আমার বয়স ৩৫+। এ স্বল্প বয়সে আমাকে অনেক চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির সেকাল আর এইকাল মোটামুটি আমার জানা। আমি তথাকথিত শান্তি বাহিনী ও ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র জীবন প্রত্যক্ষকারী। অস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে অবিরত কাজ করা নিরস্ত্র এক বাঙ্গালীই আমি। পাহাড়ে বসবাস করার সুবাধে ছোটবেলা হতে উপজাতীয় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে উঠা বসার করি। উপজাতীয় গ্রামে ঘুরাফেরার সুযোগে সন্ত্রাসীদের রাষ্ট্র, সেনা ও বাঙ্গালী বিরোধী অপতৎপরতা আমি স্বচোখে প্রত্যক্ষ করি। পার্বত্যাঞ্চলের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সম্পর্কে আমি এ অঞ্চলের মানুষ হিসেবে অন্যান্য মানুষ মতো ধ্যান ধারনা নিয়ে থেমে থাকিনি। নিজের চোখে তো কমবেশি দেখেছি। তবে বয়স কম হওয়ার কারণে অনেক কিছুই দেখিনি সেটাও ঠিক, তবেই সে ছোটবেলা হতে মায়ের মুখে শান্তিবাহিনীর নৃশংসতা শুনে তাদের অত্যাচার, অবিচার ও গণহত্যা নিয়ে আমার ‘তাদের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা সৃষ্টি হয় ৷’ সে থেকে তথাকথিত শান্তিবাহিনী ইউপিডিএফ সম্পর্কে জানতে আমি জীবনের বেশিরভাগ সময় পাহাড়ের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছি। চুক্তির সময় আমার বয়স ছিল সবেমাত্র (১৩)। সেসময়কালেও আমি চাকমা ভাষা ও মারমা ভাষা কিছুটা রপ্ত করি। বিষয়টি আশ্চর্যজনক হলেও এটা সত্য যে, আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল না। যার ফলে অনেক উপজাতীয় নারী-পুরুষেরাই সন্ত্রাসী সম্পর্কে আমাকে তথ্য প্রদান করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। এটা নিয়ে কিছু মানুষের হিংসাও হয়!! তবে, সেকালে চাকমা ভাষা আর মারমা ভাষা রপ্ত করাটা আজকের মতো এতটাই সহজও ছিল না। কারণ, তখন সাধারণ চাকমা, মারমাদের সাথে এখনকার মতো সচরাচর বাঙ্গালীর অতোটা যোগাযোগও ছিল না।
শান্তি বাহিনীর অতর্কিত হামলা, গুলি ও বাঙ্গালীদের ঘরবাড়িতে আগুন এবং মিলিটারির সঙ্গে গোলাগুলিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম যুদ্ধ কবলিত এলাকা ছিল। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে আমার বাবা এবং চাচা দুইজনে জমিতে ধান রোপণ করতেছেন, এমন সময় আনুমানিক ৭০০/ ৮০০ গজ দূর হতে শান্তি বাহিনী তাদের লক্ষ্য করে ৫/৬ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে! তখন আমার বাবা ও চাচা আত্মরক্ষার তাগিদে জমিনের কাঁদা মাটির সঙ্গে একেবারে নাকানিচুবানি খেয়ে মিশে যায়। একটা গুলি চাচার পিঠের ওপর দিক দিয়ে একদম গেঞ্জির পাশ দিয়ে গেছে। আল্লাহর রহমতে সেদিন চাচা বেঁচে যায়৷
আরকটা ঘটনা ছিল তখন সম্ভবত আমার বয়স আড়াই বছর কিংবা তিন বছর হবে, তখন শান্তি বাহিনী আমাদের ঘর লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে। আমার মা আমাকে বুকে নিয়ে চৌকির তলায় ঢুকে যায়। তার পরেও ২/৩ টা গুলি চৌকির খুঁটির সাথে লেগে ব্যাহত হয়। না হয় সেদিন মা ছেলে দুজনে শেষ হতাম। পরে অবশ্যই আমাদের মাটির গুদাম করে। মাটির গুদামে গুলি খুব সহজেই ছেঁদ করেনা। সেজন্যেই পার্বত্যে মাটির ঘরের প্রচলনটা বেশি ছিল। তার পরে আরো বেশ কয়েকবার শান্তি বাহিনী আক্রমণ চালিয়েছে কিন্তু আমরা তার আগে মিলিটারি ক্যাম্পে চলে গেছি।
শান্তি বাহিনী আক্রমণ চালানোর দুই কি একদিন আগে চিঠি ফেলে যেতো ঘরের আঙ্গিনায়। চিঠিতে লিখতো তোরা বাঙ্গালীরা ভালো ভাবে খেয়ে নিস, তোদের রাতে এসে মেরে ফেলবো! এইভাবে প্রায় তারা চিঠি দিতো। তবে তারা যেদিন চিঠি দিতো সেদিন রাতে আসতো না হঠাৎ দুই একদিন পরে এসে ঘরবাড়িতে গুলি করে আগুন লাগিয়ে সবকিছু তচনচ করে চলে যেতো। বেশিরভাগ সময় শান্তি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ হতে রক্ষা পেতে বাঙ্গালীরা মাটিতে ছোটছোট গর্ত করে ঢুকে উপরে খড় দিয়ে থাকতো। আমি স্বচোখে দেখেছি অনেক বাঙ্গালীকে গুলি করে মেরে ফেলতে এবং লাথি মেরে মারতে। মায়ের সামনে তার ছোটছোট শিশুদের আছাড় মেরে মারতো! মিলিটারি আসার সময় হলে তারা চলে যেতো। অনেক সময় মিলিটারির সঙ্গে সম্মুখে যুদ্ধ হতো! বাঙ্গালীরা তখন নিরাপদে সরে যেতো৷ বাঙ্গালীদের জন্য নিরাপদ হিসেবে অস্থায়ী শিবির ছিল, “হাসপাতাল এবং সেনা ক্যাম্পের আশে পাশের জায়গা গুলো।” বাঙ্গালীরা ফিরে যাওয়ার পর গুচ্ছ গ্রাম গুলোতে বাঙ্গালীরা ডিউটি করতো আর তখন ভিডিপি ডিউটি করতো। আমার এখনো অনেক ঘটনা স্পষ্টভাবে মনে আছে। আর মায়ের মুখে তো সেকালের ঘটনা গুলো এখনো সময় পেলে মাঝেমধ্যে শুনার চেষ্টা করি। পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি বাহিনী কর্তৃক সংগঠিত অনেক গণহত্যার কালের সাক্ষী আমার মা। পার্বত্য পরিস্থিতি অশান্তকালীন সময়ে আমার মা বান্দরবান নাইক্ষ্যংছড়ি হচ্ছে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা পর্যন্ত যাতায়াতে ছিলেন নানার চাকরির সুবাধে। সে হতে উনি এ অঞ্চলের অসংখ্য হত্যাযজ্ঞ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায়ই মানুষ নিজের চাহিদা মতো উপজাতি-বাঙ্গালীর সঙ্গে সব জায়গা ঘুরতে পারে খোলা ভাবে। কিন্তু আমি হতভাগা তা পারিনা। সবসময় নিরাপত্তা জনিত কারণেই চার দেওয়ালে আমাকে বন্দী থাকতে হয়! আমার অপরাধ আমি রাষ্ট্র, সেনা ও বাঙালি পক্ষে কাজ করেছিলাম অপ্রতিরোধ্য ভাবে। শত ঘাত-প্রতিঘাত উপেক্ষা করে আমাকে পার্বত্য নিয়ে কাজ করতে হয়েছে মাটি ও দেশ প্রেম আগলে রেখে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালীরা নিজেদের অধিকারের বিষয়ে আজও ওয়াকিবহাল নয়। আর যারা ওয়াকিবহাল তারা উদাসীন। পার্বত্য বাঙ্গালীদের মধ্য হতে বর্তমান যদি ৪০% বাঙ্গালী ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদেরকেই অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত করতো তাহলে অধিকার আদায় হতো শতভাগ। পার্বত্য বাঙ্গালীদের মধ্যে অনেকেই এতটাই অপ্রত্যাশিত ভাবে অকৃতজ্ঞ যে, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে থাকে খাই, ঘুমাই তার পরেও রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে তথ্য প্রদান করেনা!! পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে যদি সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমের বিন্দুমাত্র ঘাটতি থাকতো তাহলে সে কবে “পার্বত্য” বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হত।
চুক্তির পরে সন্ত্রাসীরা যেহেতু অবৈধ অস্ত্র ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেনি সেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রাম রক্ষায় এবং অঞ্চলের মানুষের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে প্রত্যাহারকৃত সেনাক্যাম্প গুলো পুনঃস্থাপন সময়ের শ্রেষ্ঠ দাবি।