মো. সোহেল রিগ্যান:
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনগোষ্ঠী বা উপজাতিদের পাশাপাশি দেশীয় ষড়যন্ত্রকারী স্বার্থান্বেষী মহল আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করেই যাচ্ছে। বস্তুত কাক যেমন ময়ূরের পেখম লাগালে ময়ূর হয় না, তেমনি এ দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনগোষ্ঠী বা উপজাতিরা কখনও ‘আদিবাসী’ হয় না। এ দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে (রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) ১২ টি উপজাতি- চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খুমি, বম, তংচংগা, লুসাই, চাক, পাংখোয়া, খেয়াং ও ম্রো) বাস করে। এছাড়াও সাঁওতাল, গারো, হাজং উপজাতি নেত্রকোনায়, গারো পাহাড়, ময়মনসিংহে, রাজশাহীর কিছু অঞ্চলে, সিলেটের জাফলং এ বসবাসরত খাসিয়া উপজাতি, মনিপুরীরা কমলগঞ্জ, লাওয়া ছড়া, মৌলভীবাজারে এবং রাখাইনরা রামু, কক্সবাজার অঞ্চলে বসবাসরত রয়েছে। এসব উপজাতিরা আদিবাসী কিনা? এবং এদের আদিবাসী স্বীকৃতি দিলে সমস্যা কোথায়? তা জানতে বিশদভাবে আলোচনায় আসা যাক- পার্বত্য চট্টগ্রামে ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাসের ইতিহাস ৩০০ বছরের নিচে। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ (আইএলও) কনভেনশনে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ‘সংজ্ঞা’ মতে আদিবাসী হতে হলে- নির্দিষ্ট স্থানে কয়েক হাজার বছর বসবাস করতে হবে, যাদের বসতি স্থাপনের বা যথাস্থানে বসবাসের সুনির্দিষ্ট ইতিহাস বিদ্যমান এবং তাদের কথ্য ও লেখ্য ভাষা ভান্ডারে থাকতে হবে কমপক্ষে দেড় হাজার শব্দভাণ্ডার। বর্ণিত বিষয়গুলো থাকলেই জাতিসংঘের (আইএলও) কনভেনশন এর সংজ্ঞা মতে আদিবাসী জনগোষ্ঠী স্বীকৃত হবে না। তাদের সুনির্দিষ্ট ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবনযাত্রা, চালচলন ও খাদ্যাভ্যাস প্রভৃতি কিছুটা সংশ্লিষ্টদের থেকে আলাদা বিদ্যমান থাকতে হবে।
এদিকে বাংলাদেশে বসবাসরত উপজাতি মানুষদের সঙ্গে আদিবাসী শব্দচয়ন বা জনগোষ্ঠীর বা সমমানের কোনো বিন্দুমাত্র মিল নেই। সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হলো- বাংলাদেশ বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও উপজাতি মানুষের বসবাস মাত্র ৩০০ বছর। এরা পার্শ্ববর্তী ভারত, ত্রিপুরা, মিজোরাম, মায়ানমার, মঙ্গোলীয় তিব্বত এবং চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ১৭৩০ সাল নাগাদ যুদ্ধে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অস্থায়ীভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় গ্রহণ করে৷ অনেক চাকমা ও মারমা পণ্ডিত, লেখকগণও অনায়াসে তাদের লেখা বিভিন্ন বইতে উল্লেখ করেছে, “তারা আদিবাসী না, তারা পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে এ দেশে আন্তর্জাতিক সীমারেখা অতিক্রম করে বসতি স্থাপন করেছে। তাদের অধিকাংশের আদি নিবাস বার্মা ও বার্মার চম্পকনগর।” তারা যে এ দেশের আদি বাসিন্দা নয়, এটা তারা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমেও অকপটে স্বীকার করেছে। (সূত্র কার্পাস মহল থেকে শান্তি চুক্তি-আনন্দ বিকাশ চাকমা, বোমাং রাজা সংলাপ) এ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী তথা উপজাতীয়দের একটি অংশ রাষ্ট্রের জন্য বিষফোড়া।
উপজাতিদেরকে তৎকালীন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি দাবার গুঁটি হিসেবে পার্বত্যের গহিন অরণ্যে আশ্রয় দেয়৷ অথচ আশ্রয়ে আশা বহিরাগত অভিবাসী উপজাতিরা আজ নিজেদের এ দেশের আদি বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দেয়। দাবি তোলে আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এই দেশে আশ্রয়ে এসে তারা ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক ১ বছর পর ১৯৭২ সালে তথাকথিত শান্তিবাহিনী গঠন করে এম. এন. লারমার নেতৃত্বে এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়ার যোগসাজশে। এই শান্তিবাহিনী গঠন হওয়ার পর অতর্কিতভাবে রাষ্ট্রীয় স্থাপনা ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীসহ বাঙালিদের উপর বর্বরোচিত হামলা শুরু করে (ভূষণছড়া, কলমপতি, লোগাং, পাকুয়াখালী লংগদু, তারাবনছড়া ইত্যাদি)। দীর্ঘ সশস্ত্র হামলা, অগ্নিসংযোগে বাঙালি ছিল এক নির্যাতিত জাতি। অশান্ত ছিল সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম। সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল তথাকথিত শান্তিবাহিনী।
সর্বশেষ ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালের সরকার ও তথাকথিত শান্তিবাহিনীর মধ্যকার সংঘাত পরিহার ও অবৈধ অস্ত্র ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিরাজমান পরিস্থিতি শান্ত করার চুক্তি সম্পাদিত হয়। উক্ত চুক্তিতে সরকারের পক্ষ থেকে শুধু একটি প্রধান শর্ত ছিল ‘অবৈধ অস্ত্র পরিহার’। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) তথাকথিত শান্তিবাহিনীর পক্ষ হতে যে-সব দাবিদাওয়া ছিল সব দাবিদাওয়া মেনে নিয়ে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার। শান্তিবাহিনীর দাবিদাওয়া ও শর্তের তুলনায় সরকারের শর্ত ছিল অতি নগণ্য। তবুও তথাকথিত শান্তিবাহিনী সম্পূর্ণ অস্ত্র সরকারের কাছে হস্তান্তর না করে পুনরায় অস্ত্র নিয়ে একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পার্বত্য জনপদ রক্তে রঞ্জিত করে। চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে রাস্ট্রদ্রোহীতামূলক অপরাধ করেছে শান্তিবাহিনী।
এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর তৎকালীন পার্বত্য চুক্তিতে উপজাতিরা নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে দাবি না করে বরং উপজাতি হিসেবে উল্লেখ করে চুক্তি স্বাক্ষরিত করেছিলেন। ভাববার বিষয় হলো- চুক্তির এত বছর পরে তারা আবার এখন নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ দাবি করে কেন? এটা কিন্তু বাঙালি জাতিসত্তা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের পূর্বাভাস। পার্বত্য চুক্তির সম্পাদিত হওয়ার ফলে উপজাতি কোটায় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, উপজাতি কোটায় শিক্ষা-দীক্ষা-চাকরি ও অন্যান্য সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার পরে এখন তারা দাবি জানাচ্ছে নিজেরা ‘আদিবাসী’।
আদিবাসী নিয়ে যারা বেশি বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন, তারা হচ্ছে উপজাতিদের অধিকারের নামে বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা, আইএনজিও, এনজিও এবং উপজাতি নেতাদের ভিতর রাঙামাটি চাকমা সার্কেল চিফ দেবাশীষ রায় ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী ইয়েন ইয়ান, গৌতম দেওয়ান, প্রকৃত রঞ্জন চাকমা সহ দেশের তথাকথিত দেশদ্রোহী সুশীল সমাজ, বামপন্থী রাজনীতিবিদ এবং হলুদ মিডিয়া। অধিকারের দোহাই দিয়ে চাঁদাবাজি ও মানুষ হত্যা করাই উপজাতি সন্ত্রাসী বাহিনীর কাজ।।তাদের সহায়তা দিচ্ছে কিছু বিদেশি এনজিও, দাতাসংস্থা এ এদেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা। যারা আদিবাসী স্বীকৃতি নিয়ে সরগরম করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম সক্রিয় হচ্ছে সুশীল, বুদ্ধিজীবী ও প্রগতিশীল রাম-বামরা। বৈদেশিক দাতাসংস্থা ইউএনডিপি অর্থায়নে আদিবাসী শব্দের প্রচলন ও স্বীকৃতি দাবি এ দেশে উপজাতিদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সমতলের ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগে বসবাসরত সাঁওতাল, গারো, হাজং,মনিপুরী এবং রাখাইনসহ কয়েকটি তফশিল সম্প্রদায়ও নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানাচ্ছেন তাদের সাথে সুর মিলিয়ে। তাদের এ দেশের বসবাসের ইতিহাসও ৩০০ বছরের বেশি নয়। এতে করে এই সমস্ত আন্তর্জাতিক অর্থায়ন সংস্থাগুলো তাদের মিশন ভিশন ও কর্মক্ষেত্রের নতুন জায়গা খুঁজে পাবে। নির্বিঘ্নে এই সমস্ত কোমলমতি ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে তাদের স্বীয় স্বার্থ হাসিলের কাজে ব্যবহার করতে পারবে।
এখানে ‘আদিবাসী’ শব্দটির একটি ভুল ব্যাখ্যা বেশি কাজ করছে। এই ভুল ব্যাখ্যা কাজ করার পেছনে লুকিয়ে আছে রাষ্ট্র ভাগ করার ভয়ংকর পরিকল্পনা-বিশেষ করে যারা পার্বত্যাঞ্চল ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে ‘উপজাতি খাটো ও অপমান জনক শব্দ বলে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ‘আদিবাসী’ পরিচয় বহন ও স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আন্দোলন সৃষ্টি করে দিয়েছে’ তাদের অবস্থান বরাবরই সারাবিশ্বে প্রশ্ন বিদ্ধ। এদের শেখানো ফন্দি আঁটেন স্বদেশীয় মীরজাফররা। এমতাবস্থায়, উপজাতিরা মনে করে আদিবাসী জাতি হিসেবে তাদের পরিচয় বহন করা গর্বের আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি হিসেবে পরিচয় বহন করা অপমানজনকও লজ্জাকর! তাই তারা আর উপজাতি পরিচয়ে থাকতে চান না! বিষয়টি যেমন হাস্যকর তেমনি উদ্বেগজনক। এটা রাষ্ট্র ভাগ করার ষড়যন্ত্রও বটে। এমন ভয়ংকর পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে এসব ষড়যন্ত্রকারী জনগোষ্ঠী।
এবার জেনে নেওয়া যাক বাংলাদেশে সংবিধান বিতর্কিত আদিবাসী দাবিদারদের বিষয়ে কী বলে-
১। বাংলাদেশ সংবিধানে পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠী, এবং সমতলের ময়মনসিংহ, রাজশাহী, সিলেট সহ কিছু বিভাগে বসবাস করা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও তফশিল সম্প্রদায় (আদিবাসী দাবিদার) জনগণের পরিচয় স্বীকৃতি হচ্ছে, উপজাতি হিসেবে। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৩ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি। এখন
২। উপজাতি শব্দের সংজ্ঞা হচ্ছে রাষ্ট্রের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর থেকে যারা সংখ্যায় কম ও যাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চেয়ে আলাদা তারাই ‘উপজাতি’৷ এই উপজাতি শব্দে খাটো জাতি, অপমান কিংবা লজ্জাজনক কিছু নেই৷ তবুও বিদেশি দাতাসংস্থা, এনজিও, খ্রিষ্টান মিশনারি, চাকমা সার্কেল চিফ দেবাশীষ রায় ও এই দেশের সুশীল, প্রগতিশীল, রাম-বামরা উপজাতি সন্ত্রাসীরা এদের উপজাতি শব্দের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ‘আদিবাসী’ বানাতে উড়ে পড়ে লেগেছে! এইটা সত্যি দেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের নীল নকশা, এবং বড় ধরনের ষড়যন্ত্রের আভাস।
৩। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী তথা উপজাতি হিসেবে পরিচয় বহন করা উপজাতিরা হঠাৎ নিজেদের সংবিধানে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবি তোলা শুরু করে ২০০৭ সাল থেকে। পূর্বের ছিল আইএলও কনভেনশন ১৬৯ (১৯৮৯)। এখন সমস্যা বাঁধিয়েছে ২০০৭ সালে জাতিসংঘের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য ঘোষণাপত্র। এ ঘোষণাপত্রে ৪৬টি অনুচ্ছেদ রয়েছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, সুরক্ষা অধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার ও স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থাসহ জাতীয়তাবাদের অধিকার, এবং ভূমি অধিকার (তথ্য ২০০৭ সালের জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র)। এই অনুচ্ছেদ গুলো একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য হুমকি।
৪। কী বলা আছে জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রে অনুচ্ছেদ গুলোতে চলুন দেখে নেয়া যাক-
(ক) অনুচ্ছেদ-৩: আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার বলে তারা অবাধে তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা নির্ধারণ করে এবং অবাধে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রাখে।
(খ) অনুচ্ছেদ-৪: আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার উপভোগের বেলায়, তাদের অভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বিষয়ে তথা স্বশাসিত কার্যাবলীর অর্থায়নের পন্থা ও উৎস নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের স্বায়ত্তশাসন বা স্বশাসিত সরকারের অধিকার রয়েছে।
(গ) অনুচ্ছেদ-৫: আদিবাসী জনগণ যদি পছন্দ করে তাহলে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের পূর্ণ অধিকার রেখে তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক, আইনগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান অক্ষুণ্ন রাখা ও শক্তিশালীকরণের অধিকার লাভ করবে।
(ঘ) অনুচ্ছেদ-৬: আদিবাসী ব্যক্তির জাতীয়তা লাভের অধিকার রয়েছে।
৫। উল্লিখিত অনুচ্ছেদগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পেলে বাংলাদেশের ভেতর কমপক্ষে ৪৫ টি স্বায়ত্তশাসিত বা স্বশাসিত অঞ্চল ও সরকার ব্যবস্থার সৃষ্টি হবে। এসব অঞ্চলে সরকার পরিচালনায় তারা নিজস্ব রাজনৈতিক কাঠামো, জাতীয়তা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, আইনপ্রণয়ন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পাবে।এছাড়া এই ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের ভূমির উপর যে অধিকারের কথা বলা হয়েছে তা আরো ভয়ানক”।
(ক) অনুচ্ছেদ-২৬: ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তাদের ঐতিহ্যগতভাবে মালিকানাধীন, দখলীয় কিংবা অন্যথায় ব্যবহার্য কিংবা অধিগ্রহণকৃত জমি, ভূখণ্ড ও সম্পদের অধিকার রয়েছে।
(খ) ২৬: ৩. রাষ্ট্র এসব জমি, ভূখণ্ড ও সম্পদের আইনগত স্বীকৃতি ও রক্ষার বিধান প্রদান করবে। সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রথা, ঐতিহ্য এবং ভূমি মালিকানা ব্যবস্থাপনা মেনে সেই স্বীকৃতি প্রদান করবে।
(গ) অনুচ্ছেদ-২৮: ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি, ভূখণ্ড ও সম্পদ যা তাদের ঐতিহ্যগতভাবে মালিকানাধীন কিংবা অন্যথায় দখলকৃত বা ব্যবহারকৃত এবং তাদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি ছাড়া বেদখল, ছিনতাই, দখল বা ক্ষতিসাধন করা হয়েছে এসব যাতে ফিরে পায় কিংবা তা সম্ভব না হলে, একটা ন্যায্য, যথাযথ ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পায় তার প্রতিকার পাওয়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার রয়েছে।
(ঘ) অনুচ্ছেদ-৩০: ১. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বেচ্ছায় সম্মতি জ্ঞাপন বা অনুরোধ ছাড়া ভূমি কিংবা ভূখণ্ডে সামরিক কার্যক্রম হাতে নেয়া যাবে না।
(ঙ) অনুচ্ছেদ-৩২: ২. রাষ্ট্র আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি, ভূখণ্ড ও সম্পদের উপর প্রভাব বিস্তার করে এমন কোনো প্রকল্প অনুমোদনের পূর্বে, বিশেষ করে তাদের খনিজ, পানি কিংবা অন্য কোনো সম্পদের উন্নয়ন, ব্যবহার বা আহরণের পূর্বে স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি গ্রহণের জন্য তাদের নিজস্ব প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে আলোচনা ও সহযোগিতা করবে।
আজকে তারা যে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার চাচ্ছে, তা কিন্তু ব্রিটিশদের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি অনুযায়ীও নেই। উপজাতিরা কিন্তু ব্রিটিশ কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিকে তাদের বেঁচে থাকার দলিল মনে করে। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি (অর্থাৎ ব্রিটিশ কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি বা হিল ম্যানুয়াল) কিন্তু জাতিসংঘের কোন ঘোষণাপত্র নয়। এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের উপর্যুক্ত অনুচ্ছেদগুলো ব্যাখ্যা ও পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী আদিবাসী স্বীকৃতি পেলে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে নিজস্ব আইনে নিজস্ব ভূমি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মুষ্টিমেয় চিহ্নিত উপজাতিরা দাবি করছে ঐতিহ্য ও প্রথাগত অধিকার বলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল ভূমির মালিক তারা। একই অধিকার বলে সমতলের (তফশিল সম্প্রদায়) অধ্যুষিত এলাকার সকল ভূমির মালিকানা সেখানকার উপজাতীয়রা দাবি করবে। সেখানে যে-সব ভূমি সরকারি ও ব্যক্তিগত মালিকানায় বাঙালিরা রয়েছে তা ফেরত দিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যেহেতু ঐ গোষ্ঠী সকল সামরিক স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার দাবি জানাচ্ছে, সে কারণে সেখান থেকে সকল সামরিক স্থাপনা সরিয়ে নিতে হবে। সামরিক স্থাপনা সরিয়ে নেওয়া মানে ভূখণ্ড ভাগের সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। এটা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতিসত্তা এবং সাংবিধানিক অধিকারের উপরে অমূলক হস্তক্ষেপ। যা অনেকটা হাস্যকর এবং পাগলের প্রলাপ ছাড়া অন্য কিছুই নয়। এমনিতে তাদের রয়েছে একাধিক সশস্ত্র গ্রুপ, যারা প্রতিনিয়ত বাঙালি ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উপর হামলা করে যাচ্ছে। আদিবাসী হিসেবে এদের স্বীকৃতি দিলে রাষ্ট্র ভাগ তাদের হাতে চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবে।
আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের অঞ্চলে জাতীয়তা লাভের জন্য জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ চেয়ে জাতিসংঘের মাধ্যমে গণভোট আয়োজন করে পার্বত্যাঞ্চল আলাদা রাষ্ট্র গঠন চেষ্টা করে, এবং জাতিসংঘ যদি সেটা স্বীকৃতি দেয়,সেক্ষেত্রে তারা আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে পারবে। ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ আদিবাসী বিষয়ক যে ঘোষণাপত্র (United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples) গৃহীত হয়, সেখানে প্রস্তাবের পক্ষে ১৪৩ টি দেশ ভোট দিলেও বাংলাদেশ ভোট দানে বিরত থাকে। স্মরণযোগ্য যে, ১১ টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে এবং ৩৪ টি দেশ ভোটাভুটিতে অনুপস্থিত থাকে। চারটি দেশ যথা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। এখন কোনো কারণে যদি উক্ত উপজাতিরা যথাযথ প্রতিনিধির মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে জাতিসংঘে আদিবাসী প্রস্তাবনা পাস করে ফেলেন, তাহলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে আঘাস আসবে। যেমনটা হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের মত হবে। ইতিমধ্যে উপজাতি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো সেই চেষ্টা, তদবির এবং বাস্তবে রূপদানে যথেষ্ট সোচ্চার। ইতোমধ্যে উপজাতি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো পার্বত্যাঞ্চলকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা জম্মল্যান্ড নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুধু করেছে৷ রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও বাঙালিদের উপর হামলা প্রতিনিয়ত চলছে। নতুন রাষ্ট্র গঠনের নীতিমালা ও নিজেদের মধ্যে অবকাঠামো তৈরি করেছে। (বরাত- এডুকেশন. ডকুমেন্টস নামের ওয়েবসাইট)। এছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুসন্ধানে পাওয়া যাবে কল্পিত জুম্মল্যাণ্ড রাস্ট্রের ম্যাপ, পতাকা, মুদ্রা।
উপজাতি জনগোষ্ঠী ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য জাতিসংঘে আলাদা কনভেনশন রয়েছে ১৮৯ (১৯৮৯) ১ এর a ও b। বাংলাদেশের উপজাতিদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আইএলও কনভেনশন শুধুমাত্র আদিবাসী সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে অন্যদিকে উপজাতি জনগোষ্ঠীর সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয় না। আদিবাসী শব্দটি এনজিও মিডিয়া যেভাবে প্রচারে ভূমিকা রাখে সেভাবে উপজাতি শব্দটি প্রচারে করে না। এসব কারণে শুধু উপজাতিরা নয় দেশের অধিকাংশ মানুষও ‘উপজাতি, এবং আদিবাসী’ শব্দের তফাত বুঝেনা। উপর্যুক্ত বিস্তারিত পর্যালোচনা ও আলোচনা থেকে এ কথায় প্রতীয়মান হয়েছে বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বা উপজাতি কখনোই আদিবাসী নয়। এটা ফলাও করে প্রচার প্রকাশ করা এবং বাঙালি জনগণ, ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার প্রকৌশলী, সুশীল সমাজ, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসক সহ সকল বাঙালি জাতিসত্তাকে এক ও অভিন্ন ভাবে এর বিরোধিতা করে এবং এর বিরুদ্ধে তীব্রভাবে সোচ্চার হওয়া এখন সময়ের দাবি। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে সকলকে এক হয়ে কাজ করার সময় এখনই।
লেখক: মো. সোহেল রিগ্যান
তথ্যসূত্র:
১. কার্পাস মহল থেকে শান্তি চুক্তি -আনন্দ বিকাশ চাকমা
২. পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও সম্ভাবনা, মেহেদি হাসান পলাশ
৩. সতীশ চন্দ্র ঘোষ, (১৯০৯, পুনর্মুদ্রণ ২০০০), চাকমা জাতি (জাতীয় চিত্র ও ইতিবৃত্ত), (সম্পাদক রঞ্জিত সেন) কলকাতা: অরুণা প্রকাশন
৪. জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, (১৯৯৩), ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ, রাঙামাটি স্থানীয় সরকার পরিষদ, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
৫. সিদ্ধার্থ চাকমা, (১৩৯২ বঙ্গাব্দ), প্রসঙ্গ: পার্বত্য চট্টগ্রাম, কোলকাতা নাথ ব্রাদার্স
৬. বিরাজ মোহন দেওয়ান (২০০৫), চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত (২য় সংস্করণ), রাঙামাটি: উদয় শংকর দেওয়ান
৭. শ্রী কামিনী মোহন দেওয়ান (১৯৭০), পার্বত্য চট্টলের এক দীন সেবকের জীবন কামিনী, রাঙামাটি: দেওয়ান ব্রাদার্স এন্ড কোং
৮. আতিকুর রহমান, (২০০৭), পার্বত্য তথ্য কোষ (Vol. নবম খণ্ড), সিলেট: পর্বত প্রকাশনী।