||হাসান আব্দুল্লাহ, পার্বত্য চট্টগ্রাম||
শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে স্বজাতি পাতি নেতাদের কূটচাল ও সন্ত্রাসীদের তীক্ষ্ণ নজর এড়িয়ে পার্বত্য নিয়ে কাজ করা এক অপ্রত্যাশিত সংগ্রাম। অপ্রতিরোধ্য প্রতিবাদের নবজাগরণ আমি আমার সেই কৈশোর বয়স থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা আর বাংগালী নিয়ে কাজ করার দুঃসাহসিক জোয়ান অনেকেই ছিলো, কিন্তু দুর্ভাগ্য যে প্রায়ই মাথা নত করে অস্ত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্থন করেছে। অন্ততপক্ষে আমি নিজের ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত করেছি পার্বত্য দীর্ঘ সংগ্রামে। আমার এ ১৯ বছর পার্বত্য জীবনে বহু ঘাত-প্রতিঘাত জীবনের নিয়মে মেনে নিয়ে গিরিপথ পাড়ি দিতে হোটচ খেতে হয়েছে বারবার। পার্বত্য নিয়ে কাজ করলে সাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে ট্যাগ সেই ঘৃণা চর্চা এখনো এদেশে বহাল। দীর্ঘসময়ে গিরিপথ পাড়ি দিতে গিয়ে স্বচক্ষে যে পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছি তা থেকে অনেক নবজাগরণের যৌবনা ক্লান্ত হয়ে হারিয়ে যেতে দেখেছি। কেউ বা পারিবারিক বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে এ পথ থেকে হারিয়ে গেছে। আবার কেউ বা জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা রেখে শেষ বিকালে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। অনেককে পেছন থেকে টেনে নেওয়ার ভয় দেখিয়ে মূল স্রোতের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ মূল স্রোত বলতে বুঝানো হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশিরভাগ মানুষ সন্ত্রাসবাদকে অন্তরালে ঘৃণা করলেও ওপেন সমর্থন করে যেতে হয়। বেশিরভাগই স্রোতের দিকে একাট্টা হয়। আর হাতে গণা কয়জন ছিলো স্রোতের বিপরীতে। তন্মধ্যে আমরা সেই স্রোতের বিপরীত মানুষ। আমাদের প্রতিটি কাজ নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের নাগরিক অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করার পাশাপাশি ভূখণ্ড রক্ষার কথা বালাটা তীব্র চ্যালেঞ্জ ছিলো। পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেক দিনগুলো অন্ধকারভেদ করে কাটিয়ে উঠতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। আমরা যে রাষ্ট্রের জন্য পার্বত্য সন্ত্রাসীদের বন্দুকের নলের সামনে দাড়িয়ে প্রতিবাদ করেছি সেই রাষ্ট্র অনেক সময় আমাদের সঙ্গে নিন্দনীয় আচরণ করেছে৷ নিরুপায় হয়ে সহযোদ্ধাদের অনেককে ক্লান্ত। সন্ত্রাসীদের হাতে ধরাশায়ী হওয়া রাষ্ট্রের অনেক সরকারি কর্মকর্তাও রক্ষা পেতে অনেক সময় ক্ষণিকের জন্য হলেও আমার দারস্থ হতে হয়েছে। কিন্তু সকাল শেষে বেলা ডুবে যাওয়ার আগে অকৃতজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে তারা। এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রায়শই দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম হতো আমার। তবুও আবেক আর মনের নোনতা, বাধভাঙ্গা ঢেউ, চোখের টলমল জল আড়ালে রেখে চলেছিলাম একলা ভাবে। আমার এ দুঃসাহসিক কাজ নিয়ে অনেকেই ঠাট্টা মশকারি, উদাসীনতাও ঝেড়েছিলো। এখনো নিন্দুকেরা তা করছে। হয়ত প্রতিক্রিয়া আমি দেখায়নি কখনো এসমস্ত কিছুতে। স্বজাতির দালাল আর পাতি নেতাদের অসহ্য যন্ত্রণা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। অপমানে আমি যতটা না কষ্ট অনুভব করেছি তার থেকে বেশি কষ্ট আমার পারিবারিক সদস্যরা অনুভব করেছিলো সেদিন গুলোতে৷এখনো অন্ধকার কাটেনি আমার পথ হতে। আমার পার্বত্য সংগ্রাম যদিও এটা আমার একার না, সকলেরই অংশ গ্রহণ থাকার কথা ছিলো। কিন্তু জাতি ধিরে ধিরে বিবেকহীন হয় নিজের আখর গোছাতে ব্যস্ত। পাতি নেতাদের মত আমি আবার মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পাততে পারিনা। আমরা কিছু অদম তার ব্যতিক্রম। কথায় আছে না নিজের টাকায় অন্যের মহিষ চরানো। ঠিক তেমনতর আমি। শেষ সময়ে মাঝেমধ্যেই নিজেকে নিশ্চুপ করে হারিয়ে যেতে চেষ্টা করি। কিন্তু আমার অনুপস্থিতি তেমন কেউ অনুভব না করলেও সে নির্যাতিত মানুষরা অনুভব করে। তাদের ডাকে আমাকে সাড়া দিতে হয়। অনেকেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক নির্যাতিত মানুষ গুলোর আত্মচিৎকার সাড়া দেয় না, বিবেকে ঘুমন্ত রেখে বরঞ্চ আমার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। প্রশাসন ও প্রহসন করে আমাদের সাথে। সব অন্যায় অবিচার মাথায় পেতে নিয়েও আমাদের দাঁড়াতে হয় নির্যাতিত মানুষগুলোর কাতারে। ওই যুগে এযুগে কেউ আমাদের পার্বত্য লড়াইকে সুন্দর চোখে দেখিনি। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত জীবনের সঙ্গে মানিয়ে পথচলা আমাদের। বেশ করে আমাদের রাজপথ আন্দোলন ও অগোছালো লেখা সংগ্রাম বড় পরিসরে প্রভাব বিস্তার না করলেও অন্ততপক্ষে কিছু নির্যাতিত মানুষ উপকৃত হয়েছে। সেইটা তারাই স্বীকার করবে না, যারাই জেগে জেগে ঘুমাই। জেগে ঘুমের ভান করা মানুষের ঘুম ভাঙ্গানো কঠিন। বাস্তবতার নিরিখে বলতে গেলে বর্তমানে কেউ স্বার্থহীন ভাবে পার্বত্য নিয়ে আত্মত্যাগ বির্সজন দেয়না।