মগ তথা বার্মিজ জলদস্যুদের নিপীড়িনের ইতিহাস কয়েকশ বছরের পুরনো।

1

মগ তথা বার্মিজ জলদস্যুদের  নিপীড়িনের ইতিহাস কয়েকশ বছরের পুরনো। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী এবং সাধারণ উপজাতীর উপর নির্যাতন-নিপীড়নের সেই ধারাবাহিকতা অব্যহত রেখেছে ঐতিহাসিকভাবে মানবতা বিরোধী বার্মিজ জলদস্যুদের বংশধর বর্তমান বার্মিজরা এবং তাদের রাষ্ট্রযন্ত্র। ঐতিহাসিকভাবে খুনে-ডাকাত এবং তাদের বংশধররা যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে তখন সেখানে মানবতা মুখ থুবড়ে পড়ে।

১৭৬১ সালের রেসলের ম্যাপে সেসময়ের জনবিরল দক্ষিণবঙ্গকে ‘মগদের দ্বারা উৎসন্ন’ লেখা হয়েছে। এ সময় গোটা বাকেরগঞ্জ এলাকা প্রায় জনমানবশূণ্য হয়ে গিয়েছিলো। প্যারিসে রক্ষিত মোগল আমলের মাঝামাঝি পর্তুগিজদের প্রণীত একটি ম্যাপে সুন্দরবন এলাকায় পাঁচটি সমৃদ্ধ বন্দরের উল্লেখ দেখা যায়। তবে পরবর্তীকালে রাখাইনের মগ ও পর্তুগীজ জলদসু্যদের অত্যাচারে এসব বন্দর ও জনপদ পরিত্যক্ত হয় বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা। মগ জলদসু্যদের যথেচ্চ আচরণের কারণেই, যেখানে এখনো অনাচার দেখা যায় তাকে ‘মগের মুল্লুক’ বলা হয়। সত্যিকারার্থে বার্মিজ  মগরা বাংলাদেশের নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোকে ‘মগের মুল্লুকে’ পরিণত করেছিল।

সুন্দরবন সহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে মগ আর পর্তুগীজ জলদসু্যরা একসময় যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েক করেছিলো, তা বর্ণিত হয়েছে নানান ঐতিহাসিকের লেখায়। ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ের-এর ভ্রমণ বৃত্তান্তে তাদের অকথ্য অত্যাচারের কিছু কিছু উল্লেখ আছে, যা পড়লে আজও শিউরে উঠতে হয়।

ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে বাংলার শাসনব্যবস্থা শিথিল হয়ে পড়ে। সে সময় পর্তুগিজ জলদস্যু আর মগদের অত্যাচারে গোটা দক্ষিণবঙ্গে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, অঅজ সেকথা কল্পনা করা দুরূহ। বিশেষ করে বৃহত্তর বরিশাল, খুলনা ও পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা তাদের হামলার প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। উপকূলীয় এলাকা শুধু নয়, ছোট ছোট নৌযান নিয়ে তারা দেমৈর অনেক ভেতরেও ঢুকে পড়তো। উপকূলভাগ থেকে সুদূর ঢাকা পর্যন্ত নদী তীরবর্তী এলাকা প্রায় জনশূণ্য হয়ে পড়েছিলো। নদী তীরবর্তী কোন বাড়িতে রাতের বেলা আলো জ্বালানো হত না এসব জলদসূ্যদের ভয়ে। নদীপথে বাণিজ্যযাত্রা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মোঘল আমলে এ অঞ্চলে যেসব দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল তার সবগুলোই বিভিন্ন নদীতীরে। আর এসব দুর্গ নির্মিত হয়েছিলো বহিঃশত্রুর মোকাবেলার জন্যে নয়। মগ-পর্তুগীজ জলদস্যুদের মোকাবেলা করার জন্য। বার্নিয়ের লিখেছেন-‘ফিরিঙ্গি আর মগদের অত্যাচারে ধু ধু করছে গ্রামের পর গ্রাম। এককালে যেখানে লোকালয় ছিল, এখন সেখানে বাঘসহ বন্য জন্তু চরে বেড়াচ্ছে স্বচ্ছন্দে।’

মানরিক-এর বর্ণনায় দেখা যায়, ১৬২১ সাল থেকে ১৬২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে অন্তত ৪২ হাজার মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো এই জলদসু্যরা। ১৬২৯ সালের পর অল্প সময়ের মধ্যেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ১৮ হাজার মানুষকে। এই হিসাব প্রকৃত হিসাবের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। কারণ, সে আমলে, সেই পরিস্থিতিতে অধিকাংশ হতভাগ্য বাঙালির হিসাব রাখা সম্ভব ছিল না। দস্যুরা গ্রাম-কে-গ্রাম লুটপাট করত লুটপাট শেষে যা নিয়ে যেতে পারত না তাতে আগুন ধরিয়ে দিত। পুড়িয়ে দিত গ্রামের পর গ্রাম। বড় বড় হাট-বাজার, এমনকি বিয়ে বাড়িতে বা উৎসবের সময়ও তারা চরদিক থেকে হামলা চালিয়ে লোকজন ধরে নিয়ে যেত, লুটপাট করত। তাদের হাত থেকে নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু কারো নিস্তার ছিল না। তবে তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিলো নারী। ধরে নেয়া লোকজনের হাতের তালু ছিদ্র করে তার ভেতর সরু বেত ঢুকিয়ে দিয়ে বেঁধে জন্তুর মত গাদাগাদি করে ফেলে রাখা হত জাহাজের পাটাতনের নিচে। অন্যদেশের বন্দরে নিয়ে বিক্রি করে দেয়া হত তাদের। বাঙালি বিক্রির একাধিক বাজারও ছিল বার্মায়। মগ এবং পর্তুগীজরা এতটাই বেড়ে গিয়েছিলো যে, মগরা চট্টগ্রাম থেকে লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল। আর পর্তুগীজরা দখল করেছিলো সন্দ্বীপ। সে সময় যেসব বাঙালী নারীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হত, তাদের সেই দু:খের কাহিনী দীর্ঘশ্বাসের মত আজো লুকিয়ে আছে কিছু কিছু লোকগানে।
‘ইস্ট ইন্ডিয়া ক্রোনিক’স’-এর বর্ণনায় জানা যায় ১৭১৮ সালে বার্মার রাখাইন রাজা দক্ষিণ বঙ্গ তছনছ করে  অন্তত ১৮০০ জন সাধারণ অধিবাসীদের ধরে নিয়ে যায়। বন্দীদের অমানুষিক উপায়ে রাজার সামনে হাজির করা হয়। রাখাইন রাজা সেখান থেকে বেছে বেছে একদলকে তার নিজের দাস বানায়, অবশিষ্টদেরকে গলায় দড়ি বেঁধে ক্রীতদাসের বাজারে বিক্রি করা হয়।

মগ ধাওয়ানি :
সুবাদার শায়েস্তা খান বাংলার শাসনভার গ্রহণ করেন ১৬৬৩ সালে। এই ঘটনাই মগ আর পর্তুগীজ জলদস্যুদের কপালে মরণ ডেকে আনে। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের তিন বছরের মধ্যেই মগ ও পর্তুগিজদের এমন তাড়া করেন যে, তারা গোটা সুন্দরবন এলাকা, সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রাম থেকে পড়িমরি করে পালাতে লাগল। লোককাহিনীতে এ ঘটনা ‘মগ ধাওয়ানি’ নামে পরিচিতি পায়। মগ আর পর্তুগিজ জলদস্যুরা পালানোর সময় তাদের লুট করা ধনরত্ন সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। সুন্দরবনের নানা স্থানে সেগুলো পুঁতে রেখে সেসবের সাংকেতিক ম্যাপ তৈরী করে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তারা সুযোগ বুঝে সেসব ম্যাপ সঙ্গে নিয়ে গুপ্তধন খুঁজতে আসত। পূর্ববঙ্গ গীতিকায় এর এক সরস বর্ণনা আছে। মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের রেখে যাওয়া এসব গুপ্তধনের অনেকগুলো এখনো অক্ষত থাকতে পারে বলে মনে করেন অনেক ঐতিহাসিক। [তথ্যসূত্র : আমাদের সুন্দরবন, ফরিদী নুমান ২১-২৪ পৃষ্ঠা]

প্রয়োজন এখন  ‘মগদের অনুসারী চাকমা রাজা দেবাশিষ রায় এবং তার স্ত্রী রাখাইন রানী ইয়েন ইয়েনকে ধাওয়ানি’র রাখাইনি তথা বার্মিজদের অত্যাচার নতুন কিছু নয়। শত বছরেও এসব দসু্যদের আচরণ বদলায়নি। তাদের ষড়যন্ত্রে এখন হারাতে চলেছে আমাদের প্রাণপ্রিয় পার্বত্য চট্টগ্রাম। 
তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ পার্বত্যবাসি।

আমার মনে হয়, অত্যাচারি, নিষ্ঠুর, অমানবিক এসব মানবরূপি পশুদেরকে আবারো ‘ রাখাইনিদের ধাওয়ানি’ দেবার সময় এসেছে। বর্তমানে অস্ত্রের ব্যবহারের চাইতে কুটনৈতিক প্রচেষ্টাই বেশী কার্যকর। তাই যে কোন উপায়ে, যে কোন মানুষের, যে কোন প্রস্থে, যে কোন ফোরামে কিংবা যে কোন দেশের এখনি উদ্যোগ নিতে হবে জন্ম-জন্মান্তরের এই মানবতার শত্রুগোষ্ঠীর রাজা দেবাশিস রায় এবং রানী ইয়েন ইয়েন বিরুদ্ধে। কঠোর চাপে ফেলতে হবে তাদেরকে এবং বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে।
মনে রাখতে হবে রাজা দেবাশীষ রায় হলো রাজাকার ত্রিদিব রায়ের পুত্র।



লেখক: Azmir Hossain Cht 

আগের পোস্টপার্বত্য চট্রগ্রামের অশান্তির নেপথ্যে রাণী ইয়েন ইয়েন!
পরের পোস্টদেশের প্রচলিত আইনের সাথে পাহাড়ের আইনের ভিন্নতা থাকায় সন্ত্রাসীরা অবাধে বিশৃঙ্খলা করছে!

১টি কমেন্ট

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন