আজ সে ভয়াল ১০ এপ্রিল লোগাং বাঙালি গণহত্যা দিবস!
লোগাং নামে খাগড়াছড়ি জেলায় একটা জায়গা আছে, যার নদীর নাম ‘লোগাং’ শব্দটির অর্থ রক্তের নদী। লোগাং শব্দটি স্থানীয় উপজাতি ভাষা। এক দিন লোগাং সত্যি সত্যি তার নামের সার্থকতা রেখেছিল!
আজ থেকে ৩০ বছর আগে এই দিনে লোগাং এলাকাটি সত্যি বাঙালির রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল, জানেন সেটা কাদের রক্তে?? আপনাদের ভাষায়, ‘সেটেলার বাঙালি’ অর্থ (পুনর্বাসিত বাঙালির রক্তে) যে বাঙালি আপনাদের জীবনমান উন্নয়ন করেছে সে বাঙালি আজ আপনাদের চোখে ‘সেটেলার চেদহাবা’! আসলে কী ঘটেছিল সেদিন?
১০ এপ্রিল ১৯৯২ সালের দুপুর, আর দু-দিন পরেই শুরু হবে বাঙালিদের প্রাণের উৎসব বর্ষবরণ নতুন বছর। তৎকালীন বাংলা নববর্ষ ধুমধাম পালন করত বাঙ্গালিরা। বাংলা নববর্ষ বাঙালির সংস্কৃতি ইতিহাস অঙ্গনে সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব। তাই গ্রামের সবাই সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঘর বাড়ি সাজাচ্ছিল, বাজার সদাই করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কেউ দুপুরে খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। হঠাৎ করে গুচ্ছগ্রামে তথাকথিত শান্তিবাহিনীর উপস্থিতিতে বিশ্বের ভয়ংকর অস্ত্রশস্ত্র হাতে নিয়ে তিব্বতীয়, মঙ্গোলীয়, বার্মা ও ভারত থেকে আগত বৃটিশদের পুনর্বাসিত উপজাতিরা আক্রমণ শুরু করে। এই উপজাতীয়রা মূলত কালে কালে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এদের অতীত ইতিহাস মোটেও ভালো নয়। যাইহোক সে কথা বাদ দিয়ে মূল প্রসঙ্গ নিয়েই কথা বলা শ্রেয়ই।
মুহূর্তের মধ্যে লোগাং শান্ত জনপদটি পরিণত হয় রক্তাক্ত এক জনপদে। ছেলে থেকে বুড়ো, দুধের শিশু থেকে নারীরা পর্যন্ত কেউ রেহাই পায়নি সে আক্রমণ থেকে। কেউ কেউ ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে পালাতে পেরেছে, যারা পালাতে পারেনি তারা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে এবং সবশেষ উপজাতীয়দের দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা গেছে।
চারদিকে লাশের স্তূপ, ছড়িয়ে ছিটিয়েছিল হতভাগ্য বাঙালির অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কিংবা পোড়া হাড়গোড়। সেদিনের সেই সম্মিলিত তাণ্ডবলীলায় প্রায় ১০০০ এর মত বাঙালি নিহত যায় এবং আহত হয় অগণিত। যদিও হতাহতের পরিসংখ্যান আরো বেশি ছিল বলে তৎকালীন বাঙালিরা অভিযোগ করেছিলো। দূর থেকে চোখের সামনেই পিতা-মাতা, ভাইবোন ও আত্মীয় স্বজনদের ভিনদেশি বহিরাগতদের রামদা, তীর ধনুক, বন্দুক, লাঠিসোটা উপর্যুপরি আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে মরতে দেখে কোনোরকমভাবে পালিয়ে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। সে সময়ের নৃশংস হামলার ঘটনার কথা গুলো বেচে থাকা প্রবীণদের মুখে শুনলে চোখে জল এসে যায়।
পরবর্তীতে বলা হয়, সেনাবাহিনী নাকি উপজাতিদের কোন এক জুম্ম চাষিকে ধরে নিয়ে যায় এ কারণে নাকি এ সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে! অথচ মূল ঘটনার কাহিনি হল, একজন বাঙালি মহিলা ঘটনার দিন কয়েক আগে তার গরু চড়াতে মাঠে যায়। পথিমধ্যে সন্ত্রাসী উপজাতি কতিপয় যুবক তাকে ধর্ষণের চেষ্টা চালালে, সে হাতের কাছে থাকা দা দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালায়। তখন উপজাতীয় কতিপয় যুবকেরা আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে, বাঙালি মহিলাকে ধর্ষণ ও হত্যা করার চেষ্টা করে। এমন পরিস্থিতিতে কবির হোসেন নামে এক বাঙালি পেছন থেকে এসে উপজাতি এক যুবকের মাথায় সেগুন গাছের ডাল দিয়ে আঘাত করে। এ সুযোগে মহিলা দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করে। পরে বাঙালি কবির হোসেনকে হত্যা করে উপজাতি কতিপয় যুবকেরা। কবির হোসেনকে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে বাঙালিদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বাঙ্গালি মহিলার কোপে একজন উপজাতি যুবক মারাত্মকভাবে আহত হয়। আহত উপজাতি যুবককে বলির পাঠা বানাই সন্ত্রাসীরা। শান্তিবাহিনী আহত উপজাতি যুবককে হত্যা করে বাঙালি নারী ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনা ও বাঙালি হত্যা করার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ধামাচাপা দিয়ে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করে! সর্বদিকে ছড়িয়ে দেয় উপজাতি যুবককে বাঙ্গালিরা হত্যা করে। এতে করে উপজাতীয়দের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা বিনা উসকানিতে তথাকথিত শান্তিবাহিনীর অংশগ্রহণই অস্ত্রশস্ত্রসহ বাঙালি গুচ্ছগ্রামে হামলা চালায়।
আপনাদের সবারই জানার কথা ১৯৭৯ সালে সরকার যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি পুনর্বাসন করে তখন তথাকথিত শান্তিবাহিনী বাঙালি পুনর্বাসনের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। তাই বাঙালির উপর গণহত্যা সংঘটিত করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো কালে বাঙ্গালিরা প্রথম থেকে কোনো সহিংসতার সূত্রপাত করেনি। সবগুলো ঘটনার সূত্রপাত করেছিল উপজাতি সন্ত্রাসীরা। লোগাং গণহত্যার সূত্রপাত থেকে শেষপর্যন্ত সবকিছুই উপজাতি সন্ত্রাসীদের দ্বারা সংগঠিত হয়েছে। উপজাতিরা বাঙালি গণহত্যা করে সব সময় তথাকথিত গণমাধ্যম দিয়ে প্রচার করতো এসমস্ত ঘটনা বাঙালি, সেনাবাহিনী করেছে।
লোগাং এর গণহত্যা নিয়ে নির্লজ্জ মিথ্যাচার করা হয়েছিল।
এরপর আহত নিহতের সংখ্যা আর আক্রমণকারী নিয়ে তৎকালীন গণমাধ্যমে চলে সর্বোচ্চ মিথ্যাচার। এমনকি এর দায়ভার সেনাবাহিনী আর বাঙালি উপর পর্যন্ত চাপিয়ে দেওয়ার নগ্ন চেষ্টা চলে! আর সে সময়ে পার্বত্যাঞ্চলের গণমাধ্যমের প্রবেশ আর বস্তু নিরপেক্ষ সংবাদ ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। সে সময়েও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংবাদে অদৃশ্য সেন্সর আরোপ করে দিত তথাকথিত শান্তিবাহিনী। যেটা আজও জারি রয়েছে। দীপ্তি টিভির সাংবাদিকের কথা মনে থাকার কথা সবার। রাঙ্গামাটি তথাকথিত শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়েছিল। বেধড়ক মারধরের পর তাকে অদৃশ্য ভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। লোগাং এলাকায় সেনাবাহিনী, বাঙালি কর্তৃক উপজাতীয়দের উপর গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে, এই বলে এ বিষয়ে উদ্দেশ্যে প্রণোদিতভাবে ক্যাসেট, মিথ্যা ডকুমেন্ট বানিয়েছে আত্মস্বীকৃত রাজাকার ত্রিদিব রায়ের কুখ্যাত পুত্র কথিত রাজা দেবাশীষ রায়! বিশ্ব দরবারে জানাতে তা প্রচার করতে গিয়ে ভিয়েতনাম যাওয়ার প্রাক্কালে বিমানবন্দরে বাধাপ্রাপ্ত হন দেবাশীষ রায়। তখন তার কাছ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে জঘন্যতম মিথ্যাচার ছড়িয়ে দেওয়ার ‘ক্যাসেট ও মিথ্যা ডকুমেন্ট উদ্ধার করে’।সবচেয়ে দুঃখজনক হল, এখানকার সাংবাদিকরা উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্যে হামলাকে দুর্বৃত্তদের হামলা বলে চালিয়ে দেয়! শান্তিবাহিনীর হত্যা, অপহরণ ও হুমকির ভয়ে গণমাধ্যম সত্য প্রকাশ করত না। আজও সেই সময়ে শান্তিবাহিনীতে থাকা লোকজন সেসব ঘটনার কথা অস্বীকার করতে চায়! খোদ সন্তু লারমা পর্যন্ত মিথ্যা হিসেবে প্রমাণ করতে চায়। কিন্তু সত্য গোপন করতে পারেনা, সত্য সত্য হিসেবেই প্রকাশ পায়। আপনি পড়ছেন HWF এর লেখা।
লোগাং বাঙালি গণহত্যাকে ধামাচাপা দিতে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) তথাকথিত শান্তিবাহিনী পরবর্তীতে লোগাং এলাকায় স্বজাতি উপজাতিদের হত্যার মিশন চালু করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা থেকে কতিপয় গণমাধ্যমের সাংবাদিক এনে উপজাতি গণহত্যার বিষয় টি বাঙালির উপর চাপিয়ে দিয়েই সংবাদ প্রকাশ করা হয়! যেটা এখনো করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে তৎকালীন ভাড়াটে সাংবাদিক দিয়ে কুৎসা রটনা করতো। উপজাতিদের কিছু লাশের ছবি তোলে সংবাদমাধ্যমে বাঙালি কর্তৃক উপজাতি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বলে প্রচার করা হয়। অথচ বাড়িঘরের অগ্নিসংযোগ উপজাতিসহ বাঙালি হত্যা সন্তু লারমার শান্তিবাহিনী করেছিল। বাঙালি গণহত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতে স্বজাতিদের হত্যা করে সন্তু লারমা গংরা। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হওয়াই নিরীহ উপজাতি লোকদের ভারতে যেতে বাধ্য করেছিলো সন্তু লারমার শান্তিবাহিনী। উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের মধ্যে চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সে সংঘাত, রক্তাক্ত পরিস্থিতি ১৯৮১ হতে এম. এন লারমার হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়। এই কথা গুলো অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
বর্তমান প্রজন্মের বাঙালিদের ভিতরে পূর্বের এই লোগাং গণহত্যাটির প্রকৃত সঠিক তথ্য, ইতিহাস জানা নেই! ভুলতে বসেছে লোগাং গণহত্যাসহ সব গণহত্যাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহৎ বাঙালি গণহত্যা এইটি। লোগাং গণহত্যা নিয়ে বিভিন্ন লেখক বিভিন্নভাবে লিখলেও প্রকৃত সত্য কেউ উদ্ঘাটন করতে পারেনি! কতিপয় উপজাতি ও তথাকথিত শান্তিবাহিনীর সে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড পার্বত্য ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। হয়ত লোগাং বাঙালি গণহত্যাকে জাতীয়ভাবে কেউ মনে রাখবে না, রাখার কথাও না। শুধু এই গণহত্যাকে নয়, সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে তথাকথিত শান্তিবাহিনী কর্তৃক সংগঠিত গণহত্যাগুলোর সঠিক তথ্য, ইতিহাস, প্রমাণ চিত্র ও ভিডিও প্রমাণাদি বাঙ্গালিরা সংরক্ষণ করে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। যার কারণে এ প্রজন্মেরর বাঙালিরা অনেকটা উদাসীন। তাই উপজাতীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর হাতে সাধারণ নিরীহ বাঙ্গালিরা প্রাণ দিতে হচ্ছে।
