লোগাং নামে খাগড়াছড়ি জেলায় একটা জায়গা আছে, যার নদীর নাম ‘লোগাং’ শব্দটির অর্থ রক্তের নদী। লোগাং শব্দটি স্থানীয় ভাষা। এক দিন লোগাং সত্যি সত্যি তার নামের সার্থকতা রেখেছিল!
আজ থেকে ৩২ বছর আগে এই দিনে লোগাং এলাকাটি সত্যি বাঙ্গালির রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল, জানেন সেটা কাদের রক্তে?? আপনাদের ভাষায়, ‘সেটেলার বাঙ্গালি’ অর্থ (পূর্নবাসিত বাঙ্গালির রক্তে) যে বাঙ্গালি আপনাদের জীবনমান উন্নয়ন করেছে সে বাঙ্গালি আজ আপনাদের চোখে ‘সেটেলার চেদহাবা’! আসলে কী ঘটেছিল সেদিন?
১০ এপ্রিল ১৯৯২ সালের দুপুর, আর দুদিন পরেই শুরু হবে বাঙ্গালিদের প্রাণের উৎসব বর্ষবরণ নতুন বছর। তৎকালীন বাংলা নববর্ষ ধুমদাম পালন করত বাঙ্গালিরা। বাংলা নববর্ষ বাঙ্গালির সংস্কৃতি ইতিহাস অঙ্গনে সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব। তাই গ্রামের সবাই সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঘর বাড়ি সাজাচ্ছিল, বাজার সদাই করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কেউ দুপুরে খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। হঠাৎ করে গুচ্ছগ্রামে তথাকথিত শান্তিবাহিনীর উপস্থিতিতে বিশ্বের ভয়ঙ্কর অস্ত্রশস্ত্র হাতে নিয়ে তিব্বতীয়, মঙ্গোলীয়, বার্মা ও ভারত থেকে আগত বৃটিশদের পুনর্বাসিত উপজাতিরা আক্রমণ শুরে করে। এই উপজাতীয়রা মূলত কালে কালে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এদের অতীত ইতিহাস মোটেও ভালো নয়। যাক সে কথা বাদ দিয়ে মূল প্রসঙ্গ নিয়েই কথা বলা শ্রেয়ই।
মুহুর্তের মধ্যে লোগাং শান্ত জনপদটি পরিণত হয় রক্তাক্ত এক জনপদে। ছেলে থেকে বুড়ো, দুধের শিশু থেকে নারীরা পর্যন্ত কেউ রেহাই পায়নি সে আক্রমণ থেকে। কেউ কেউ ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে পালাতে পেরেছে, যারা পালাতে পারেনি তারা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে এবং সবশেষ উপজাতীয়দের দেওয়া আগুণে পুড়ে মারা গেছে।
চারদিকে লাশের স্তুপ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল হতভাগ্য বাঙ্গালির অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কিংবা পোড়া হাড়গোড়। সেদিনের সেই সম্মিলিত তান্ডবলীলায় প্রায় ১০০০ এর মত বাঙ্গালি নিহত হন এবং আহত হয় অগণিত। যদিও হতাহতের পরিসংখ্যান আরো বেশি ছিলো বলে তৎকালীন বাঙ্গালীরা অভিযোগ করেছিলো। দূর থেকে চোখের সামনেই পিতা-মাতা, ভাইবোন ও আত্মীয় স্বজনদের ভিনদেশী বহিরাগতদের রামদা, তীর ধনুক, বন্দুক, লাঠিসোটার উপর্যুপরি আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে মরতে দেখে কোনরকমভাবে পালিয়ে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। সে সময়ের নৃশংস হামলার ঘটনার কথা গুলো বেছে থাকা প্রবীণদের মুখে শুনলে চোখে জল এসে যায়।
পরবর্তীতে বলা হয়, সেনাবাহিনী নাকি উপজাতিদের কোন এক জুম্মচাষীকে ধরে নিয়ে যায় একারণে নাকি এ সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে! অথচ মূল ঘটনার কাহিনী হল, একজন বাঙ্গালি মহিলা ঘটনার দিন কয়েক আগে তার গরু চড়াতে মাঠে যায়। পথিমধ্যে সন্ত্রাসী উপজাতি যুবক তাকে ধর্ষণের চেষ্টা চালালে, সে হাতের কাছে থাকা দা দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালায়। তখন উপজাতীয় যুবকরা আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে, বাঙ্গালী মহিলাকে ধর্ষণ ও হত্যা করার চেষ্টা করে। এমন পরিস্থিতিতে কবির হোসেন নামে এক বাঙ্গালী পেছন থেকে এসে উপজাতি এক যুবকের মাথায় সেগুন গাছের ডাল দিয়ে আঘাত করে। এ সুযোগে মহিলা দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করেন। পরে বাঙ্গালী কবির হোসেনকে হত্যা করে উপজাতি যুবকরা। কবির হোসেনকে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে বাঙ্গালিদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বাঙ্গালি মহিলার কোপে একজন উপজাতি যুবক মারাত্মকভাবে আহত হয়। আহত উপজাতি যুবককে বলির পাঠা বানাই শান্তিবাহিনী। আহত উপজাতি যুবককে হত্যা করে বাঙ্গালি নারী ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনা এবং বাঙ্গালি হত্যা করার ঘটনাটি সম্পূর্ণ দামাচাপা দিয়ে নতুন করে ইস্যু তৈরির মাধ্যমে উত্তেজনা সৃষ্টি করে! সর্বদিকে ছড়িয়ে দেয় উপজাতি যুবককে বাঙ্গালিরা হত্যা করে! এতে করে উপজাতীয়দের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা বিনা উস্কানিতে শান্তিবাহিনীর অংশগ্রহণে অস্ত্রশস্ত্রসহ বাঙ্গালী গুচ্ছগ্রামে হামলা চালায়।
আপনাদের সবারই জানার কথা ১৯৭৯ সালে সরকার যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালি পূর্ণবাসন করে তখন শান্তিবাহিনী বাঙ্গালি পুর্নবাসনের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। তাই বাঙ্গালির উপর গণহত্যা সংঘঠিত করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন কালে বাঙ্গালিরা প্রথম থেকে কোন সহিংসতার সূত্রপাত করেনি। সবগুলো ঘটনার সূত্রপাত করেছিল উপজাতি সন্ত্রাসীরা। লোগাং গণহত্যার সূত্রপাত থেকে শেষপর্যন্ত সবকিছুই উপজাতি সন্ত্রাসীদের দ্বারা সংগঠিত হয়েছে। সম্মানিত পাঠকমণ্ডলী আপনারা পড়ছেন, HBF এর ইতিহাস ভিত্তিক লেখা; প্রচারের স্বার্থেই শেয়ার করুন এবং কপিরাইট আইন মেনে চলুন। উপজাতিরা বাঙ্গালি গণহত্যা করে সবসময় বামধারার গণমাধ্যম দিয়ে প্রচার করতো। দায়ভার বাঙ্গালি, বিডিআর ও সেনাবাহিনীর উপর চাপানোর চেষ্টা হত! তৎকালীন লোগাং গণহত্যা নিয়ে নির্লজ্জ মিথ্যাচার করা হয়েছিল।
এরপর আহত নিহতের সংখ্যা আর আক্রমণকারী নিয়ে তৎকালীন গণমাধ্যমে চলে সর্বোচ্চ মিথ্যাচার। এমনকি এর দায়ভার সেনাবাহিনী আর বাঙ্গালিন উপর পর্যন্ত চাপিয়ে দেওয়ার নগ্ন চেষ্টা চলে! আর সে সময়ে পার্বত্যাঞ্চলের গণমাধ্যমের প্রবেশ আর বস্তুনিরপেক্ষ সংবাদ ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। সে সময়েও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংবাদে অদৃশ্য সেন্সর আরোপ করে দিত তথাকথিত শান্তিবাহিনী। যেটা আজো বিভিন্ন আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন কর্তৃক জারি রয়েছে। দীপ্তি টিভির সাংবাদিকের কথা মনে থাকার কথা সবার। রাঙ্গামাটি তথাকথিত শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়েছিল। বেধড়ক মারধরের পর তাকে অদৃশ্যভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। লোগাং এলাকায় সেনাবাহিনী, বাঙ্গালি কর্তৃক উপজাতীয়দের উপর গণহত্যা সংঘঠিত হয়েছে, এই বলে এবিষয়ে উদ্দেশ্যে প্রণোদীতভাবে ক্যাসেট, মিথ্যা ডকুমেন্ট বানিয়েছে আত্মস্বীকৃত রাজাকার ত্রিদিব রায়ের কুখ্যাত পুত্র কথিত রাজা দেবাশীষ রায়! বিশ্ব দরবারে জানাতে তা প্রচার করতে গিয়ে ভিয়েতনাম যাওয়ার প্রক্কালে বিমানবন্দরে বাধাপ্রাপ্ত হয় দেবাশীষ রায়। তখন তার কাছ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে জঘন্যতম মিথ্যাচার ছড়িয়ে দেয়ার ‘ক্যাসেট ও মিথ্যা ডকুমেন্ট উদ্ধার করে’।সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, এখানকার সাংবাদিকরা উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্যে হামলাকে দুর্বৃত্তদের হামলা বলে চালিয়ে দেয়! শান্তিবাহিনীর হত্যা, অপহরণ ও হুমকির ভয়ে গণমাধ্যম সত্য প্রকাশ করত না। আজো সেই সময়ে শান্তিবাহিনীতে থাকা লোকজন এবং উপজাতিরা সেসব ঘটনার কথা অস্বীকার করতে চায়! খোদ সন্তু লারমা পর্যন্ত মিথ্যা হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সত্য গোপন করতে পারেনা, সত্য সত্য হিসেবেই প্রকাশ পায়।
লোগাং বাঙ্গালি গণহত্যাকে দামাচাপা দিতে সন্তু লারমার নেতৃত্বধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) বা শান্তিবাহিনী পরবর্তীতে লোগাং এলাকায় স্বজাতি উপজাতিদের হত্যার মিশন চালু করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা থেকে গণমাধ্যমকর্মী এনে উপজাতি গণহত্যার বিষয়টি বাঙ্গালীর উপর চাপিয়ে দিয়েই সংবাদ প্রকাশ করা হয়! যেটা এখনো করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে তৎকালীন ভাড়াটে সাংবাদিক দিয়ে কুৎসা রটনা হত। উপজাতিদের কিছু লাশের ছবি তোলে সংবাদমাধ্যমে বাঙ্গালি কর্তৃক উপজাতি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বলে প্রচার করা হয়। অথচ বাড়িঘরের অগ্নিসংযোগ উপজাতি ও বাঙ্গালি হত্যা সন্তু লারমার শান্তিবাহিনী করেছিল। বাঙ্গালি গণহত্যার ঘটনা দামাচাপা দিতে স্বজাতিদের হত্যা করে সন্তু লারমা গংরা। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হওয়াই নিরীহ উপজাতি লোকদের ভারতে যেতে বাধ্য করেছিলো সন্তু লারমার শান্তিবাহিনী। উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের মধ্যে চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সে সংঘাত, রক্তাক্ত পরিস্থিতি ১৯৮১ হতে এম. এন লারমার হত্যাকান্ডের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়। এই কথা গুলো অস্বীকার করা সুযোগ নেই, এসব ইতিহাস।
বর্তমান প্রজন্মের বাঙ্গালিদের ভিতরে পূর্বের এই লোগাং গণহত্যাটির প্রকৃত সঠিক তথ্য ও ইতিহাস জানা নেই! ভুলতে বসেছে লোগাং গণহত্যাসহ সব গণহত্যাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহৎ বাঙ্গালি গণহত্যা এইটি। লোগাং গণহত্যা নিয়ে বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন ভাবে লিখলেও প্রকৃত সত্য কেউ উদঘাটন করতে পারেনি! একমাত্র HBF লোগাং গণহত্যার প্রকৃত সত্য উন্মোচন করেছে। উপজাতি ও তথাকথিত শান্তিবাহিনীর সে বর্বরোচিত হত্যাকান্ড পার্বত্য ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। হয়তো লোগাং বাঙ্গালি গণহত্যাকে জাতীয়ভাবে কেউ মনে রাখবে না, রাখার কথাও না। শুধু এই গণহত্যাকে নয়, সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী কর্তৃক সংঘঠিত গণহত্যাগুলোর সঠিক তথ্য, ইতিহাস, প্রমাণ চিত্র ও ভিডিও প্রমাণাদি বাঙ্গালিরা সংরক্ষণ করে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। যার কারণে এ প্রজন্মের বাঙ্গালীরা অনেকটা উদাসীন। তাই চুক্তির এতবছর পরেও উপজাতীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর হাতে সাধারণ নিরীহ বাঙ্গালিরা প্রাণ দিতে হচ্ছে এবং লোগাং গণহত্যা নিয়ে ৩২ বছর পরও একচেটিয়া বাঙ্গালী ও সেনাবাহিনীকে দায়ী করা হয়। যা অপ্রত্যাশিত এবং দুঃখজনক।