লকডাউনের ৪৮ ঘন্টা আগে অর্থাৎ গতমাসের ২৯ শে জুন (মঙ্গলবার) গিয়েছিলাম খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার মুবাছড়ি ইউনিয়নে। লক্ষ্য-উদ্দেশ্য গরু কিনব। সামনে ঈদ-উল আযাহা (আমাদের মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীও উৎসব কোরবান) এই লক্ষ্যে গরুর চাহিদা তুলনামূলকভাবে প্রচুর বেড়েছে। বেশ করে দেশী পাহাড়ি গরুর চাহিদা অনেক বেশি। পাহাড়ি গরুর মাংস নাকি অনেক সুস্বাদু সেজন্য ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি। তাই বর্তমান বাজারে চাহিদাও বেশি।
তার জন্য রওনা দিলাম পাহাড়ি এলাকায়। স্থানীয় গরু বেপারী আবুল কালাম ও মন্টু বিকাশ চাকমার সাথে যোগাযোগ রেখে চট্টগ্রাম অক্সিজেন মোড় থেকে সকাল ৭টার গাড়িতে পাহাড়িকা সুপার সার্ভিসে করে ১৯০ টাকায় রাঙামাটি মানিকছড়ি উদ্দেশ্য রওনা হলাম। ১ ঘন্টা ৫০ মিনিট লেগেছে মানিকছড়ি পৌছাতে। মানিকছড়ি থেকে ৪০০ টাকায় ভাড়া মোটরসাইকেল যোগে মহালছড়ি বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম সাড়ে দশটার মধ্যে।
মহালছড়ি বাসস্ট্যান্ডের পাশে চায়ের দোকানে দেখা পেলাম আবুল কালাম ও মন্টু বিকাশ চাকমার। তিনজনেই এক সাথে বসে নাস্তা সেরে নিলাম৷ বাসস্ট্যান্ড থেকে একসাথে আসলাম মুবাইছড়ির দুর্গম গ্রামে। ৩-৪ ঘন্টা দুর্গম পাহাড়ি গ্রামে ঘুরে ঘুরে ১৭ টি গরু পছন্দ হয়েছে। পাহাড়ি গরু সাইজে ছোট কিন্তু দামে চড়া। তবুও কেক্রা চাহিদা থাকায় ১৭টি গরু পছন্দ করলাম। দামও একপ্রকার ঠিক হয়েছে। এমন সময় আর্মি পোষাকে অস্ত্র কাঁধে নিয়ে ওয়াকিটকি সহ ২১ থেকে ৪০ বছর বয়সী ১০-১২ জন উপজাতি আসলো৷ এসে আমার পরিচয় জানতে চাইলো! পরিচয় দেওয়ার পর ব্যবসা করার অনুমতি হিসেবে মাসিক ও বাৎসরিক চাঁদার টোকেন আছে কীনা জানতে চাইলো। আমি বললাম গরু ব্যবসা করতে মাসিক ও বাৎসরিক চাঁদার টোকেন করতে হয়, তা আমার জানা ছিল না! আর এমন নিয়ম কেন? এটা কী বাংলাদেশ না? আর আপনারা বা কে? যে এখানে ব্যবসা করতে হলে আমাকে টোকেন সংগ্রহ করে ব্যবসা করতে হবে? এই কথা বলার পরে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে বাৎসরিক চাঁদার টোকেন নেওয়ার জন্য বললো আর চাঁদার রশিদের বই একটা বাহির করলো কাঁধে থাকা ব্যাগ থেকে। আমি টাকা দিয়ে চাঁদার রশিদ নেবো না বলার পর ১০-১২ জন উপজাতির মধ্যহতে ২২/২৩ বসর বয়সী একজন উশৃংখল উগ্রবাদী চাকমা যুবক আমার দিকে তেড়ে আসে অস্ত্র নিয়ে ! এমন পরিস্থিতি দেখে সাথে থাকা বাঙালি আবুল কালাম ও উপজাতি মন্টু বিকাশ চাকমা আমাকে চুপ করে থাকতে ইশারা করলো। আমি চুপ না হয়ে বললাম যদি তোমাদের এতো সৎ সাহস থাকে তাহলে চট্টগ্রাম-ঢাকায় এসে এমনটা করো। পাহাড়ে চিপায় কেন অবৈধ অস্ত্র ও পেশিশক্তির প্রভাব দেখাও? এই কথা বলার পর আমার থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় তারা, এবং আমার চোখ মুখ বেঁধে ফেলার প্রস্তুতি নেয়। পরিস্থিতি আমার অনূকূলে নেই দেখে তাদের কথা মতো ৫০,০০০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে চাইলাম। তারা তা আর মানলেন না, আমার আচরণে নাকি তারা অসন্তোষ হয়েছে। তাই জরিমানা হিসেবে ৫ লক্ষ টাকা চাইলেন। যদি দাবিকৃত জরিমানা না দিই তাহলে আমাকে হত্যা কিংবা অপহরণ করবে বলে সাফ জানিয়ে দিলো! আমি কোন আর উপায় না দেখে তাদের দাবিকৃত ৫ লাখ টাকা দিয়ে দিলাম। আর সেদিন আমার পক্ষে মহালছড়ি মুবাছড়ি হতে গরু নিয়ে আসা আর সম্ভব হয়নি। কারণ গরু কেনার টাকা থেকে ৫ লক্ষ টাকা নিয়ে যায়। আমাকে গরু ছাড়া হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হলো চোখের জল নিয়ে। সেদিন তারা আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে পাঠিয়ে দেয়!
মুবাইছড়ি থেকে মহালছড়ি বাসস্ট্যান্ডে এসে বিষয়টির প্রতিকার চেয়ে স্থানীয় বাঙালি ও উপজাতিদের সঙ্গে কথা বলি। এরপর সবাই আমাকে নিরাশ করে বলেন, এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে নাকি বরং আমার বিপদ হবে, এবং আমি মহালছড়ি থেকে যেতে পারব না! তাই বাধ্যহয়ে চলে আসতে বাধ্যলাম।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ, স্বাধীন বাংলার ভূখণ্ড। এখানে ব্যবসা করতে হলে উপজাতি সন্ত্রাসীদের মোটা অংকে চাঁদা দিতে হবে! কেউ দাবিকৃত নির্ধারিত চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তাকে হত্যা কিংবা অপহরণ করা হয়। এটা এদেশের প্রতিটি মানুষের জন্য যেমন লজ্জা তেমনিই রাস্ট্র ও প্রশাসনের জন্য লজ্জাকর৷ ওখানকার প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যেনো অদৃশ্য কোন কারণে বোবা হয়ে নির্বিকার হয়ে আছে। তাদের কাছে এসব নিয়ে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাওয়া যায় না।
পাহাড়ের ভিতরে গেলে প্রতিটি ব্যবসায়ী সন্ত্রাসীদেরকে চাঁদা দিতে হয়। ওখানকার সব ব্যবসায়ীকে জীবিকার তাগিদে পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করতে হয়। বিষয়টি খুবি দুঃখজনক, এবং নিন্দনীয়ও বটে।
লেখক: মোঃ আমিনুল ইসলাম, হামজারবাগ, চট্টগ্রাম।