মোঃ সোহেল রিগ্যান-আজ ৯ সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক পাকুয়াখালী দিবস। ১৯৯৬ সালের এই দিনে পার্বত্য রাঙামাটি জেলার লংগদু -বাঘাইছড়ি সিমান্তবর্তী পাকুয়াখালী নামক স্থানে ৩৫ জন কাঠুরিয়াকে নৃশংসভাবে হত্যা করে মানবজাতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন শান্তিবাহিনী। এটিকে স্থানীয় বাঙালি সম্প্রদায় পাকুয়াখালী ট্রাজেডি হিসেবে অভিহিত করে।
শন্তু লারমার নির্দেশক্রমে অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী উপজাতি মানব খাদকেরা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। সন্তু লারমা এবং তার লালিত রক্তপিপাসুদের উদ্দেশ্য ছিল নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে পাহাড়ে বাঙালি শূন্য করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তাদের স্বপ্নের জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু নরপশুরা জানেনা বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আবদুর রউফের রক্তস্নাত এই পার্বত্য ভূমির এক ইঞ্চি মাটিও কোন সন্ত্রাসীদের জন্য ছেড়ে দেয়া হবেনা।
ঐদিন যা ঘটেছিল: আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদা আদায়সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনার জন্য মাঝে-মধ্যে পাহাড়ে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে কাঠুরিয়াদের বৈঠক হতো। এক পর্যায়ে ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ উপজাতি জঙ্গি সংগঠন শান্তিবাহিনী কর্তৃক একটি বৈঠক ডাকা হয়। এই বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য কাঠুরিয়াদের নেয়ার জন্য শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়। শান্তিবাহিনীর কালেক্টর লংগদু থানার মাইনিমুখ বাজারে এসে ব্যবসায়ীদের চিঠির মাধ্যমে বৈঠকে অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু ইতঃপূর্বে কোনো বৈঠকে ব্যবসায়ীদের এভাবে গুরুত্ব দিয়ে ডাকা হয়নি। ফলে ৯ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে ব্যবসায়ীদের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়ায় ব্যবসায়ীরা বিষয়টি সন্দেহের চোখে দেখে এবং এড়িয়ে যায়। কিন্তু কাঠুরিয়ারা প্রতিদিনের মতো সেই দিন সকাল বেলা স্বাভাবিকভাবেই পাহাড়ে প্রবেশ করতে শুরু করে। তখন শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদেরকে জানানো হয়, বড়বাবু আজ সবার সঙ্গে মিটিং করবেন। তাই আগে মিটিং-এ যেতে হবে। এরপর যে যার কাজে যাবে।
একথা বলেই এক সাথে চার-পাঁচজন বাঙালি কাঠুরিয়াকে কিছুদূর নিয়ে হাত-পা বেঁধে নির্মমভাবে হত্যা করে। সেদিনকার বাঁধা অবস্থা থেকে পালিয়ে আসা এক মাত্র ব্যক্তি মোহাম্মদ ইউনুছ মিয়া। এই ইউনুছ মিয়ার দেখানো পথ ধরেই ১১ সেপ্টেম্বর খুঁজে বের করা হয় ২৮ জনের ক্ষত-বিক্ষত বিকৃত লাশ। কারো হাত নেই, কারো চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে, কারো কেটে নেয়া হয়েছে কান কিংবা পুরুষাঙ্গ। কাউকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে থেতলে দেওয়া হয়েছে মাথা। আবার কাউকে জবাই করা হয়েছে অমানবিকভাবে। অপর ৭ হতভাগার লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমন নির্মম দৃশ্য দেখে সেদিন পার্বত্যাঞ্চলের আকাশ-বাতাস স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। শোকে ভারি হয়ে উঠেছিল সমস্ত পরিবেশ। পরে উদ্ধার করা লাশগুলি এনে লংগদু উপজেলা মাঠ সংলগ্ন খোলা জায়গায় দাফন করা হয়।
পাকুয়াখালী গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার পর সরকার উপজাতি সন্ত্রাসীদের দমন করতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন শান্তিবাহিনীর সাথে ১৯৯৭ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
যার মাধ্যমে সরকার কোনো লাভবান না হলেও উপজাতিরা চারটি সংগঠনে বিভক্ত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত করেছে।
স্বজনহারা পরিবারের আর্তনাদ: পাকুয়াখালী ট্র্যাজেডির পর তৎকালীন সরকারের চারজন মন্ত্রী যথাক্রমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম, শিল্প মন্ত্রী তোফায়েল আহম্মদ, পানি সম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এবং শ্রম ও কর্ম সংস্থান মন্ত্রী এম. এ. মান্নান ঘটনা পরিদর্শন করে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন।
এত বছর পরও মন্ত্রীদের আশ্বাস বাস্তবায়ন না হওয়ার স্বজনহারা পরিবার গুলো মর্মাহত। শুধু পাকুয়াখালী নয় সন্তু লারমার নির্দেশে পাহাড়ে অন্তত ৩৮ হাজার বাঙালি হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হলেও একটিরও বিচার আজও হয়নি।
পার্বত্যবাসীর দাবি: পাকুয়াখালীতে ৩৫ কাঠুরিয়া হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা রক্তপিপাসু সন্তু লারমাকে গ্রেফতার করে অবিলম্বে ফাঁসি নিশ্চিত করতে হবে।
ক্ষতিগ্রস্ত কাঠুরিয়া পরিবারের সদস্যদেরকে যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি চাকরি এবং আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
ভবিষ্যতে পাকুয়াখালী ট্র্যাজেডির মত আর কোনো গণহত্যা সংঘটিত যাতে না হয় সেজন্য উপজাতি সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে অতি দ্রুত অবিলম্বে নিষিদ্ধ করতে হবে।
পাহাড় এখন নিরাপত্তা ঝুঁকির সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করছে, তাই জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে পাহাড় থেকে প্রত্যাহারকৃত সেনা ক্যাম্প পুনঃস্থাপন করতে হবে।