মোঃ সোহেল রিগ্যান– পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো একটা সময় অস্ত্র ক্রয়, সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা এবং বেতন-ভাতার জন্য চাঁদা উত্তোলন করতে বাঙ্গালী গ্রামগুলোর লোকালয়ে আসতো এবং চিঠিপত্র আদানপ্রদান করতো। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এবং বাঙ্গালী দালালদের দৌরাত্ম বেড়ে যাওয়াই সাম্প্রতিক সময়ে তারা আগের পুরাতন রীতি অনুযায়ী আর মাসিক, বাৎসরিক ও যে কোনধরনের চাঁদা উত্তোলন করেন না। স্থানীয় বাঙ্গালীদের মধ্যে একটা অংশ রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়ীক সুবিধার জন্য উপজাতি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর চাঁদা যথাস্থানেই পৌছে দিয়ে আসেন৷ পর্যাবেক্ষণে এমনই সত্যতা মিলেছে। কিছুই জায়গাতে ব্যতিক্রম রয়েছে৷ শুধুমাত্র যে জায়গাগুলোতে চাঁদার জন্য হামলা, অপহরণ, হত্যা ও যানবাহন টার্গেট করা হয় তা না। এখন আর চাঁদা আদায়ে সন্ত্রাসীদের বেগ পেতে হয়না৷ ব্যতিক্রম শুধু বাজার/হাটের দিন গুলোতে।স্থানীয় বাঙ্গালী দালালরা সসম্মানে চাঁদা নিয়মমাফিক সন্ত্রাসীদের হাতে পৌঁছিয়ে দেয়!
এই নিয়মে চাঁদা আদানপ্রদানের সত্যতা জানতে দীর্ঘদিন থেকে আমরা পর্যাবেক্ষণে রেখেছিলাম চিহ্নিত কিছু রাজনৈতিক দলের নেতা, ঠিকাদার, গরু ব্যবসায়ী, অবৈধ গাছ ব্যবসায়ী,বাঁশ ব্যবসায়ী,যানবাহন চালক,পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন।
এখানে উল্লেখ্য যে, নিরাপত্তা জনিতকারণে আমরা প্রসঙ্গের স্থানকাল ও বিস্তারিত উল্লেখ করছি না। শুধুমাত্র চাঁদা কারা কীভাবে দিচ্ছে তার ধরনটা উল্লেখ করছি-
একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলের কাজ পেয়েছেন এক ঠিকাদার। পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক সন্ত্রাসী কবলিত এলাকা বা তাদের নিয়ন্ত্রণ এলাকায় কাজ করতে হলে কাজের বরাদ্দের ৫% দিতে হয়। এটা তাদের নির্ধারিত করা কিন্তু অভিযোগ আছে তারা যেমন খুশী তেমনও চাঁদা আদায় করে এবং ১০% হারেও চাঁদা আদায় করে। উক্ত ঠিকাদার ১০% হিসেবে করে ২২ লক্ষ্য টাকা চাঁদা সন্ত্রাসী সংগঠনের এর চীফ কালেক্টর এর নিকট পৌছে দিয়েছে ১৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে। এক রাজনৈতিক নেতা নির্বাচনে অংশ নিবে জয় নিশ্চিত করতে ৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ১৪ লক্ষ্য টাকা দিয়ে এসেছেন! গরু ব্যবসায়ী তাদের পাহাড়ের ভিতরে গিয়ে গরু কিনতে হয়, তাই তাদেরকে টোকেন, পাহাড়ে ভিতরের গিয়ে সংগ্রহ করতে হয়। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এই ব্যবসায়ীরা বাৎসরিক টোকেন করেন ৬ থেকে ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে এবং এর মধ্যে কিছু ব্যবসায়ী দুমুখো নীতি অবলম্বন করেন। একদিকে তারা স্থানীয় সেনাক্যাম্প গুলোর সোর্স, অন্যদিকে কিন্তু আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বার্তা বাহক এবং A গ্রেড এর সোর্স। তাদের মাধ্যমে সেনাক্যাম্পের ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর যাবতীয় সব তথ্য পেয়ে থাকেন সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। এই ব্যবসায়ীদের জন্য কিন্তু পাহাড়ের আনাচে কানাচে ঘোরাঘুরি উন্মুক্ত ৷গাছ ব্যবসায়ী যারা তাদের মধ্যে একশ্রেণী আছে তারা সেনাটহল/উপস্থিতির এর তথ্য সন্ত্রাসীদের আদান প্রদান করেন। তারা সন্ত্রাসীদের রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকায় যাতায়াত করার অনুমতি পেয়ে থাকেন। কোন কোন ব্যক্তি/ক্ষেত্র থেকে চাঁদা নেওয়া যায় ,সে সকল তথ্য কিন্তু এই অবৈধ আসাধু গাছ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পেয়ে থাকে সন্ত্রাসীরা। তারা মাসিক বাৎসরিক চাঁদার টোকেন সংগ্রহ করেন এবং পারমিট গাছের ফুট প্রতি ১০০ টাকা করে চাঁদা দিয়ে থাকেন৷ তারা বাঙ্গালী এলাকা হতে বিভিন্ন চাঁদা উত্তোলন করে সন্ত্রাসীদের নিকট পৌঁছে দেন। তাদের মত একই নিয়ম অনুসরণ করেন ভাড়া চালিত মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিক্সাসহ বিভিন্ন যানবাহন৷ তারাও সন্ত্রাসীদের গিয়ে চাঁদা পৌঁছে দেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালীদের থেকে সন্ত্রাসীরা এখন এই রীতিতে চাঁদা আদায় করে৷ বিষয়টি প্রকাশ্যে-গোপনে হলেও সংশ্লিষ্ট মহলগুলো এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে অনিচ্ছুক, কেননা বিশাল অংকের মাসোহারা তারাও পেয়ে থাকেন৷ পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বত্র এই নিয়মে চাঁদা দেওয়া হচ্ছে৷ কিন্তু এই চাঁদা প্রদানকারী বাঙ্গালী দালালদের বিরুদ্ধে কোনপ্রকার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না এবং তাদের এই রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম বন্ধে কোন পদক্ষেপ নেই৷ সংশ্লিষ্ট মহলের এই রহস্যজনক নীরবতার ভূমিকায় বাঙ্গালী দালালরা নির্ভয় ও নির্বিঘ্নে সন্ত্রাসীদের পাহাড়ের গভীরে গিয়ে চাঁদা দিয়ে আসেন। তাই সন্ত্রাসীরা আর বাঙ্গালী লোকালয়, জেলা বা উপজেলা সদর না এসেও চাঁদা পেয়ে যাচ্ছেন। মূলত একারণে সন্ত্রাসীরা এখন অনেকটা ধরাছোঁয়ার বাহিরে থাকে। দুই দশকে যেভাবে চাঁদা আদায়কালে সন্ত্রাসীরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে, বর্তমানে সে তুলনায় পরিসংখ্যান অনেক নগন্য।
সন্ত্রাসীরা চাঁদা গ্রহণ করার সময় বিশেষ কায়দা কৌশল অবলম্বন করে। যে কারণে তারা ধরাছোঁয়ার বাহিরে থাকছে। যে বাঙ্গালী দালাল তাদের গন্তব্যেস্থানে গিয়ে চাঁদা প্রদান করে তাকে সন্ত্রাসী অথবা আঞ্চলিক দলগুলোর টোল কালেক্টরের ৩/৪ স্তর ডিঙ্গিয়ে, ভেরিফিকেশন করে তা প্রদান করে এবং নির্ধারিত সময় ও স্থান বারবার পরিবর্তন করেই-নিশ্চিত হওয়ার পর চাঁদার টাকা গ্রহণ করে।
এছাড়া অন্যান্য পন্থা তো রয়েছেই,যেমন-রকেট,বিকাশ, পাঠাও প্রভৃতি। ঘটনাক্রমে একটি ডিমের জন্যও পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্র প্রধানের সাথে একজন সাধারণ জনতার সাক্ষাতে নিরাপত্তার যত আয়োজন ও ঝামেলা পোহাতে হয়,তার চেয়ে বেশি ঝামেলা পোহাতে হয় চাঁদা প্রদান করতে।আর সেটা না দিলে তো আরো মহাবিপদ-মৃত্যুঝূকি!
তারপরও স্থানীয় বাঙ্গালী দালালরা নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য রাষ্ট্রের বৃহৎ ক্ষতি করে চাঁদা প্রদান করেই যাচ্ছে। এদের সাথে অসামরিক-প্রশাসনের সকলেই কম বেশি জড়িত। কারণ ঘুষ, উপঢৌকন ও চাঁদাবাজি স্থানীয়দের রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। এটা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে এদের বিরুদ্ধে কাজ করবে কে? তাই অতিসত্বর এদের লিস্ট করে, ব্ল্যাকলিস্ট বানিয়ে এদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা এবং পাহাড় থেকে চিরতরে নির্মূল না করা হলে চাঁদাবাজি অব্যাহত থাকবেই।