পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) প্রকাশ শান্তিবাহিনীর প্রতিষ্ঠার সময় নিয়ে নানান তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। তথ্যসূত্র বলছে সদ্য বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ১ বছর পর ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম.এন লারমা)-এর নেতৃত্বে তথাকথিত শান্তিবাহিনী গঠন করা হয়। কিন্তু জেএসএস দাবি করছে ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারী শান্তিবাহিনী গঠন হয়! ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের গণপরিষদে যে সংবিধান পাস করা হয়, তাতে বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি ছিল না। তারা যে ‘৭২ সালে থেকে যাত্রা শুরু করেছিল তার প্রমাণ বহন করে ‘৭২ সংবিধানে, তাদের মাথাচাড়া দেওয়ার টক্কর। ‘৭২ সংবিধানে নিজেদের অন্তর্ভুক্তি এবং স্বায়ত্তশাসন দাবীসহ দেশখন্ডিত করার দাবি নিয়ে এম.এন লারমা হাজির হয়েছিল জাতীয় সংসদে। যা বঙ্গবন্ধু প্রত্যাখ্যান করেছিল। তখনই বোঝা গিয়েছিল এম.এন লারমার উগ্রভাব এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির ইঙ্গিত। এই এম. এন লারমার জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি পার্বত্য জেলার নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের মহাপুরম গ্রামে। তাঁর ডাকনাম ছিল মঞ্জু। এই এম.এন লারমা ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা। তিনি সাবেক পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ এবং বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের পার্বত্য চট্টগ্রাম-১ আসন থেকে নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। পাহাড়ি জাতিসত্তার অধিকার আন্দোলনের আড়ালে ছিল তার জুম্মল্যান্ড নামক আলাদা রাষ্ট্র/দেশ গঠনের পাঁয়তারা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি উঠে দাঁড়ানোর পূর্বেই বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করেন
এই দেশ দ্রোহী এম এন লারমা।
জেএসএস শান্তিবাহিনী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের জন্য গঠিত হলেও তারা ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উপরে হামলার মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য জানান দেয়। রাষ্ট্রীয় স্থাপনা ও বনকর্মী হত্যার মধ্য দিয়ে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা যাত্রা শুরু করে। ১৯৭৭ সালে বান্দরবান সাঙ্গু নদীতে টহলকারী ৫ সেনা সদস্যকে গুলি করে হত্যা করে। কোন প্রকার উস্কানী ছাড়াই এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী একের পর এক হামলা অব্যাহত রাখে। সরকার যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য সমতল থেকে বাঙ্গালীদের পুনর্বাসন করে তখন শান্তিবাহিনী ব্যাপারটি মেনে নেয়নি। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে পুনর্বাসিত বাঙ্গালীদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে শান্তিবাহিনী। যেমনটি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীরা করেছিল। তারা নিষ্ঠুর বর্বরতা ও নির্মমতা পার্বত্য বাঙ্গালীদের উপর করেছিল৷ বৃদ্ধা- বণিতা-আবদাল কাউকে ছাড় দেয়নি শান্তিবাহিনীর নেতৃত্বে থাকা মানবজাতির রক্তপিপাসুরা। এক সময় জেএসএস এম.এন গ্রুপ ও প্রীতি গ্রুপের মধ্যে অন্তর্দলীয় বিরোধ তৈরি হয়। ক্ষমতার লোভ ও চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগি ছিল বিরোধের মূল কারণ। ১০ নভেম্বর এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে এম.এন লারমা নিহত হয়। ১৯৮৩ সালে এম.এন লারমার যুগের সমাপ্তি ঘটে। নেতৃত্বে আসে তারই আপন ছোট ভাই বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। সন্তু লারমাও তার ভাইয়ের মত হিংস্র মনোভাবের বাঙালি বিরোধী৷ পাহাড়ের জন্য সে এবং তার জেএসএস মূর্তিমান আতঙ্ক।
উল্লেখ করা প্রয়োজন- শান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্তির পেছনে মূল দায় এ শান্তিবাহিনী গঠন। শান্তিবাহিনী গঠন না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩৮ হাজার নিরস্ত্র বাঙ্গালী হত্যাকাণ্ডের শিকার হতেন না। শান্তিবাহিনী পাহাড়ি জাতিসত্তার অধিকার আন্দোলনের অন্তরালে চাঁদাবাজি ও খুন-গুম করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা একটি জুম্মল্যান্ড নামক রাষ্ট্র গঠন করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। এই সশস্ত্র সংগ্রামের বলি হয় নিরীহ পাহাড়ি-বাঙালি। শান্তিবাহিনীকে নিরস্ত্র করতে সরকার ১৯৯৭ সালের ২-রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত করে। এই চুক্তিতে শান্তিবাহিনীর সব ধরনের দাবি-দাওয়া মেনে নেয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে শর্ত ছিল মাত্র একটি। শর্তটি ছিল শান্তিবাহিনী যেন সম্পূর্ণ অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে এজন্য সরকার তাদের অধিকার ও কর্মসংস্থানসহ জীবন পরিবর্তনে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। কিন্তু জেএসএস চুক্তির একটি মাত্র শর্তের কথা রাখেনি। তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার পরেও সম্পূর্ণভাবে নিরস্ত্র হয়নি৷ আন্তদলীয় বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজি টাকা ভাগাভাগি নিয়ে তারা একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পূর্বের ন্যায় বিদ্যমান রয়েছে।
শান্তিবাহিনীর সে নরকীয় হত্যাকাণ্ড ও থাবা আজও পার্বত্যবাসী ভুলেনি। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা এখনো পূর্বের ন্যায় পাহাড়ের চাঁদাবাজি, অপহরণ ও খুন-গুমসহ রাষ্ট্রদ্রোহিতা মূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত রয়েছে।