তার আগে পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানানো উচিত এই উপজেলার অবস্থান এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পর্কে। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার সর্ব-দক্ষিণে বড়থলি ইউনিয়নের অবস্থান। উপজেলা সদর থেকে এ ইউনিয়নের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। এ ইউনিয়নের উত্তরে ফারুয়া ইউনিয়ন; দক্ষিণ-পশ্চিমে বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার আলেক্ষ্যং ইউনিয়ন, রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়ন, রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়ন, রুমা সদর ইউনিয়ন, রেমাক্রীপ্রাংসা ইউনিয়ন, থানচি উপজেলার বলিপাড়া ইউনিয়ন ও থানচি সদর ইউনিয়ন এবং পূর্বে মায়ানমারের চিন প্রদেশ ও ভারতের মিজোরাম প্রদেশ অবস্থিত। বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম এলাকা ভারত ও মায়ানমার সীমান্তবর্তী বড়থলি ইউনিয়ন। উপজেলা সদর থেকে এ ইউনিয়নে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ইঞ্জিন চালিত নৌকা অথবা পায়ে হেঁটে। এছাড়া বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলা থেকেও পায়ে হেঁটে এ ইউনিয়নে আসা যায়। কিন্তু তা অনেক কষ্টসাধ্য। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইউনিয়নের দুর্গম গহীন অরণ্যকে তাদের নিরাপদ আবাসন হিসেবে বেছে নিয়েছে। সন্ত্রাসী কার্য সম্পাদন, দিকনির্দেশনা, শলা, পরামর্শ সবকিছুই বড়থলিতে বসে করা হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা নেটওয়ার্ক এর আওতার বাহিরে ইউনিয়নের অধিকাংশ পাড়া বা গ্রাম গুলো। যার বাড়তি সুবিধা হিসেবে সন্ত্রাসীরা ইউনিয়নে লোকালয় গুলোকে নিজেদের কার্য সম্পাদনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে অন্যান্য অঞ্চলের সন্ত্রাসীরা যখন কোণঠাসা হয় তখনই তারা নিরাপদ আবাসন লক্ষ্যে ফিরে আসে বড়থলির গহীন অরণ্যে। এখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিচরণ একদম নেই।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, দুর্গম এই বড়থলি ইউনিয়নে যাতায়াত ব্যবস্থা ও নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা নাজুক হওয়ার কারণে এবং প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি না থাকার কারণে উপজেলার এই ইউনিয়নের প্রায় পাড়া-গ্রাম গুলো সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যের পরিণত হয়েছে৷
বড়থলি ইউনিয়নের ২৪টি পাড়া গ্রামের মধ্যে- ১৬টি পাড়া গ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) সন্তু গ্রুপের সশস্ত্র গ্রপ তথাকথিত শান্তিবাহিনীকে প্রকাশ্যে সশস্ত্র টহল দিতে দেখা যায়। বাকী ৮টি পাড়া গ্রামে মাসে অন্ততপক্ষে ২/৩ বার সশস্ত্র টহল দিতে দেখা যায় বলে জানায় ওখানকার অধিবাসীরা। কিছু কিছু এলাকায় অন্যান্য সন্ত্রাসী গ্রুপের ও আনাগোনা লক্ষণীয়।
স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- বড়থলি ইউনিয়ন বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার অন্তর্গত একটি ইউনিয়ন। প্রশাসনিক তৎপরতা বৃদ্ধিকরার দিক দিয়ে ইউনিয়ন টি অনেকটাই পিছিয়ে আছে। বলা যায় প্রশাসনিক তৎপরতা এখানেই শুধুমাত্র কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। বাস্তবে এর কিছুই হয়নি। সরকারের এতে উন্নয়নকাজ চলে সারাদেশে। উন্নয়নমূলক কাজের জন্য এতসব বরাদ্দ দেওয়ার পরও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান পরিবর্তনে দেখা যায় না বিশেষ ভূমিকা। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামও সরকারসহ বিভিন্ন দেশী-বিদেশী সংস্থার কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দের পরিসংখ্যান বলতে গেলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনামূলক এখানে বরাদ্দ অনেক বেশি দেওয়া হয়। এসব বরাদ্দ যায় কোথায়? নাকী সব হরিলুট হয়?
আসি মূল আলোচনায়, মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও শিক্ষা উন্নয়ন এবং সড়ক যোগাযোগ উন্নয়ন প্রসার না হওয়ার কারণে গভীর অরণ্য ঘেরা এই ইউনিয়ন ১৯৭৫ সালের পর থেকে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। ফারুয়া ইউনিয়ন থেকে শান্তিবাহিনীর মূল ঘাঁটি ভারতে অপসারণ করা হলেও পরবর্তীতে সীমিতভাবে আবারো ঘাঁটি করে এই ইউনিয়নে৷ ২০১৩ সালে ফারুয়া ইউনিয়ন থেকে পৃথক হয়ে বড়থলি ইউনিয়ন সৃষ্টি হয়। এখন এই ইউনিয়ন জেএসএস সন্ত্রাসীদের পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি অবস্থিত বলে সূত্রে জানা যায়।
ইউনিয়নের তিনবানছড়া পাড়া, নতুন পাড়া, শিলছড়ি পাড়া, সারাল্যাছড়া পাড়া, রাইমংছড়া পাড়া, বরেক্যাছড়া পাড়া, মিটিঙ্গাছড়া পাড়া, সাইজাম পাড়া এবং বিল পাড়া, কাইংগছড়া পাড়া, টাইগার পাড়া, সাদারীছড়া পাড়া, সালছড়া পাড়া, সেপ্রæ পাড়া, হাতিছড়া পাড়া ও ডুপানিছড়া পাড়ায় সকাল কি সন্ধ্যায় সামরিক পোষাকে অস্ত্র, ওয়াকিটকিসহ সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দেখা মিলে। লোকালয়ে টহলকারী এই সন্ত্রাসীদের প্রধান টার্গেট থাকে গ্রামবাসীদের মধ্যে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে নিজেদের চাহিদা মত চাঁদা উত্তোলন করার সুযোগ তৈরি করা। সশস্ত্র টহলকারী সন্ত্রাসীরা সহজসরল হতদরিদ্র উপজাতি পরিবারগুলোর ঘাম ঝরিয়ে উপার্জন করা অর্থ চুষে খেতে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে থাকে। প্রতি পরিবার থেকে মাসিক ও বাৎসরিকহারে মোটা অংশের চাঁদা উত্তোলন করেন। যা ২০০০ টাকা থেকে শুরু করে বাৎসরিক ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। এখানে শেষ নয় তাদের এই অন্যায়-অবিচার। রাত্রে ঘুমানোর গন্তব্য অস্থায়ী ক্যাম্প বা ঘাঁটিতে ফিরে না গেলে লোকালয়ের উপজাতি ঘরে ঘুমান তারা। যে ঘরে ঘুমান সে ঘরকে তাদের রাত্রের খাবার ব্যবস্থা করতে হয়। শুধু রাত্রে নয় অধিকাংশ সময় দিন রাত- অবিরত রান্না করে খাওয়াতে হয়। খাওয়ার ম্যানুতে রাখতে হয়- দেশী মোরগ, মাছ, ভর্তা, শাকভাজিসহ হরেক রকমের সুস্বাদু ম্যানু। যেখানে অভাবের তাড়নায় ঠিক মত দুই মুঠো ভাত জুটেনা সেখানে এমন বিলাসী খাওয়ার রান্না করে খাওয়াতে উপজাতি পরিবারগুলোকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। সহ্য করতে হয় শত কষ্ট বেদনা৷
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাড়া কার্বারী অভিযোগ করে বলেন, যে ঘরে সুন্দরী মেয়ে থাকে সে ঘরে সন্ত্রাসীরা আসা-যাওয়া এবং রাত্রে ঘুম বেশি যান। বাঙ্গালীদের মধ্যে প্রচলন আছে গরীবের সুন্দর বউ সকলের ভাবী৷ আর পাহাড়ে প্রবাদ আছে সুন্দরী মেয়ে বা বউ যে ঘরে আছে সে ঘরে আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদের আনাগোনা লেগেই আছে। সন্ত্রাসীদের রাত্রে খাওয়ার পর বাধ্য হয়ে ঘরের সুন্দরী মেয়ে বা বউকে বিছানায় দিতে হয়। এটা অনেকটা গোপনীয় বিষয়। ভয়ে কেউ প্রকাশ করেনা। পানিতে বাস করে যেমন কুমিরের সঙ্গে পারা যায় না তেমনি দুর্গম গহীন অরণ্যে বাস করে সন্ত্রাসীদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করা যায় না। আঞ্চলিক দল কর্তৃক দুর্গম পাহাড়ের প্রতিটি পরিবার নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার৷ এটা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বিষয়। জীবনবাজি রেখে আঞ্চলিক দলের বিরুদ্ধে খুব সহজে কেউ মুখ খুলতে চাই না। দিনের পর দিন উপজাতিরা এইসব অসহ্য যন্ত্রণা, নির্মম অত্যাচার-অবিচার মুখ বুজে সহ্য করে যায়।
পাড়া কার্বারী আরো বলেন, প্রশাসনিক ও আইন-শৃঙ্খলা তৎপরতা অন্যান্য জেলা-উপজেলার মত এখানে সমান্তরালে না থাকায় সন্ত্রাসীরা এখানে অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন-গুম ও ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে। এককথায় বলা যায় এখানে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য। এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযান নেই। রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার ফলে এখানকার সন্ত্রাসীরা অধরাই রয়ে যাচ্ছে। অস্ত্রভান্ডার, জনবল ও অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি সহ তাদের সাংগঠনিক শিকড় এতটাই শক্তিশালী হচ্ছে যা পরবর্তীতে রাষ্ট্রের পক্ষে মোকাবেলা করা কঠিন হবে। এই ইউনিয়নের প্রশাসনিক নিরাপত্তা জোরদার না হলে ভবিষ্যতে সন্ত্রাসীরা প্রচুর শক্তি সঞ্চয় করে রাষ্ট্রের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করতে পারে। কারণ এই ইউনিয়নটি যেমন দুর্গম তেমনি পার্শ্ববর্তী দুটি দেশের সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন। এখানে সন্ত্রাসীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ চলে, নিজেদের সুসংগঠিত করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি টের পেলে প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে যাওয়ার পথও রয়েছে৷ তাই নিরাপদ আবাসন হিসাবে সন্ত্রাসীদের জন্য বড়থলি নিরাপদ অভয়ারণ্য। এদের মোকাবিলায় প্রশাসন তথা সরকারকে এখনই নতুন মাত্রায় ভাবতে হবে।