বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় এক দশমাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। এই এলাকাটি বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি, ভাষাগত বৈচিত্র, তাদের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, প্রথাগত রীতিনীতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত সাজেক পর্যটন এলাকা, আলুটিলা, রাঙামাটি ঝুলন্ত ব্রীজ, বান্দরবান এর নীলগিরি, বগালেক ও তাজিংডং পাহাড় এর মত উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান এই অঞ্চলেই অবস্থিত বিধায় এই এলাকাটি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত।
শান্তিচুক্তির পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থিতিশীলতা রক্ষার পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা এই অঞ্চলের আপামর জনসাধারণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, খাদ্য সমস্যা, মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত স্থানীয় ব্যক্তিবর্গদের চিকিৎসা সেবা, দরিদ্র ব্যক্তিবর্গদের আর্থিক অনুদান প্রদান করে স্বাবলম্বী হতে সহযোগিতা করা, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা, দুর্গম এলাকায় পানির সমস্যায় জর্জরিত স্থানীয়দের কষ্ট লাঘবে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা এবং বেকার ব্যক্তিবর্গের কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র কারখানা স্থাপন করে আসছে।
এছাড়া তিন পার্বত্য জেলার অরক্ষিত সীমান্ত এলাকাকে নজরদারির আওতায় আনতে বাংলাদেশ সরকারের আহবানে সাড়া দিয়ে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল ও উপজাতি সন্ত্রাসীদের প্রতিকূল অবস্থান মোকাবেলা করে সীমান্ত সড়ক নির্মাণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিবেদিতপ্রাণ হয়ে দায়িত্বপালন করছে।
দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের আত্মত্যাগের বিষয়টি সংক্ষিপ্ত পরিসরে উপস্থাপন করে সেনাবাহিনী সম্পর্কে পাঠকদের ধারণা দেওয়ার ক্ষুদ্র প্রয়াসে এই লেখনীতে সম্পৃক্ত হয়েছি।
এই লেখনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের আত্মত্যাগ ও কল্যাণকর কাজ সম্পর্কে ধারণা পেয়ে সেনাবাহিনীর প্রতি তাদের গভীর ভালোবাসা প্রকাশ পাবে।
স্থানীয়দের পাশে পানির সমস্যা সমাধানে সেনাবাহিনী
দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল খাগড়াছড়ি জেলার আলুটিলা পুনর্বাসন এলাকায় ১৬০টি পরিবারের ৪০০ জন ব্যক্তিবর্গ দীর্ঘদিন যাবৎ পানির সমস্যায় ভূগছিল। সেখানে ছিলনা কোন সুপেয় পানির উৎস।
এই খবর জানার পরপরই ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে খাগড়াছড়ি রিজিয়নের উদ্যোগে সেনাবাহিনী কর্তৃক ১০ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি পানির ট্যাংক স্থাপন করা হয়। যা ৫০০ মিটার গভীর হতে মোটর এর মাধ্যমে পানি সংগ্রহ করতঃ উক্ত পানির ট্যাংকে সংরক্ষিত হয় এবং সেখান থেকে স্থানীয়রা সুপেয় পানি সংগ্রহ করে। সেখানে এই প্রকল্প চালুর পর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পানির সমস্যা সমাধান হওয়ায় সেনাবাহিনীর অনন্য ভূমিকায় আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন।
অতি সম্প্রতি খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার গোলাবাড়ী ইউনিয়নের জংলীটিলা এলাকায় স্থানীয় পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের পানির সমস্যা সমাধানে মহালছড়ি সেনা জোনের মাধ্যমে একটি সুপেয় পানির হাউজ নির্মাণ করা হয়। এতে ঐ এলাকার স্থানীয় জনগণ সেনাবাহিনীর মানবিক দায়িত্ব পালনে অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্ববোধ করছে।
পাহাড়ের অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে দ্রুত পৌঁছে দেন তারা। যে কোনো দুর্যোগে পাহাড়ী মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় তাদের। না এখানেই শেষ নয়, বেকার যুবকদের জন্য ব্যবস্থা করছেন কর্মসংস্থানের। রাত হলে উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কারণে ঘুমাতে পারেন না পাহাড়ি-বাঙালিরা। তাদের শান্তিতে ঘুমোনোর ব্যবস্থাও করছেন এই বাহিনীর প্রতিটি সদস্য।
বলছিলাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পাহাড়ি অঞ্চল- খাগড়াছড়ি, বান্দরবন এবং রাঙামাটিতে সেনাবাহিনীর মানুষের পাশে থাকার কথা। সামাজিক উন্নয়নে এই বাহিনীর ভূমিকা যেমন এখন দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত, তেমনি আস্থা অর্জন এবং সম্প্রীতি বজায়ে তিন পাহাড়ের সব ধর্মের মানুষের কাছে সেনাবাহিনী একটি নির্ভরতার প্রতীক। পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টি এখন একটি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।
চিকিৎসাসেবায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার হাজাপাড়া নামক দূর্গম পাহাড়ী এলাকায় মহামারি আকারে ডায়রিয়া আর অন্যান্য পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিলো কিছু দিন আগে। ঐ সময়ে বেশ কিছু পাহাড়ী যুবক, বৃদ্ধা ও শিশু গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর পাওয়ার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অতি দ্রুত সেখানে ছুটে গিয়ে দূর্গম পাহাড়ী পথে কয়েক ঘন্টা হেটে হাতিরমাথা অতিক্রম করে হাজাপাড়া এলাকায় পৌছায়, সেখানে অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প নির্মাণ করে ১৫০-১৬০ জন মহামারী আক্রান্ত রোগীদের পরম যত্নের সাথে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলে। প্রখর রৌদ্র উপেক্ষা করে দূর্গম ঐ এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা দেশমাতৃকার সেবায় নিজেদের কষ্ট বিসর্জন দিয়ে বিভিন্ন প্রকার চিকিৎসা সেবা এবং জনস্বার্থমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল।
করোনায় যখন সারাদেশের মানুষ নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই খাগড়াছড়ি, বান্দরবন এবং রাঙামাটির দুর্গম অঞ্চলের মানুষকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সেনাবাহিনী। কেবল তাই নয়, করোনা ছাড়াও রাত-বিরাতে অনেক মানুষ হাসপাতালে যেতে পারেন না। তাদেরকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন এই বাহিনীর প্রতিটি চৌকষ সদস্য।
এই বাহিনীর আরও রয়েছে নানান ভূমিকা। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি তারা সেখানকার বসবাসরত লোকজনের জীবনমানোন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে উন্নয়নমূলক প্রকল্প পরিচালনা করে আসছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ৩ বছরে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের আওতাধীন তিন পার্বত্য জেলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৫০ হাজারের বেশি মানুষের ভেতর শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে। এছাড়াও অন্তত এক লাখ মানুষের মাঝে বিভিন্ন প্রকার ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও ২০ হাজার জনকে বিভিন্ন আর্থিক অনুদান প্রদান করেছে। নিয়মিতভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে বিনামূল্যে চক্ষুশিবির।
এসব চক্ষুশিবিরে দুর্গম পার্বত্য এলাকার সুবিধাবঞ্চিত বয়োবৃদ্ধ পাহাড়ী ও বাঙালির চোখের ছানি অপারেশনসহ বিভিন্ন ধরনের চক্ষু সেবা প্রদান করা হয়।
ইতিপূর্বে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা, রাঙামাটির সাজেক ও বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায় হাম আক্রান্ত হয়ে বহু পাহাড়ী শিশু নিহত হবার ঘটেছে। এসব আক্রান্ত এলাকাগুলোতে নিজেদের জীবন বাজি রেখে সুপেয় পানি সরবরাহ, খাবার ব্যবস্থা, অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প করে অসুস্থদের চিকিৎসাসেবা পরিচালনা করে পাহাড়ে হাম আক্রান্ত পাহাড়ীদের জীবন বাঁচানোর মতো মানবিক কাজে সেনাবাহিনীর অবদানও কম নয়।
পাহাড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাস দমন, শান্তি রক্ষায় সেনাবাহিনী বদ্ধপরিকর
বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ের দূর্গম স্থানগুলোতে গর্ভবতী মুমূর্ষ নারীদের পাহাড়ী রাস্তায় কাঁঢ়ে করে এনে হেলিকপ্টার যোগে সিএমএইচ এ নিয়ে সন্তান প্রসবসহ সুস্থ করে তোলার নজিরও রয়েছে অহরহ।
দূর্গম পাহাড়ি এলাকায় ২০২০ সালে ভাল্লুকের আক্রমণে গুরুতর আহত মঙ্গলিয় মুরং (০৬) ও তার দাদা ইয়াংসাই (৪৮) কে আশংকাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে চট্টগ্রাম সিএমএইচ এ নিয়ে চিকিৎসা সেবা ও এরপর ভাল্লুকের আক্রমনে আহত ত্রইল মুরং (৬৬) নামের আরো এক পাহাড়ীকে উদ্ধার করে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম সিএমএইচ এ নিয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলার একমাত্র প্রসংশার দাবীদার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীই।
পাহাড়ে শিক্ষা বিস্তারে অনন্য নজির
শিক্ষাবিস্তারে সেনাবাহিনী এর তত্ত্বাবধানে সর্বশেষ গত ৩ বছরে ২৫০টির বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাহাড়ে নির্মাণ করা হয়েছে। যেখান থেকে প্রচুর স্কুল শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে একধাপ এগিয়ে যাচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায়ও এগিয়ে আছে সেনাবাহিনী। গত ৩ বছরে ২২০টির বেশি ধর্মীয় উপসনালয় গড়ে দিয়েছে তিন পাহাড়ি জেলায়। অবেহেলিত শিশুদের মানসিক বিকাশে তাদের রয়েছে সময়োপযুগী পদক্ষেপ। অনেক স্কুলে পড়ালেখার বই নেই। নেই উপকরণ। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিভিন্ন প্রকার শিক্ষা উপকরণ, ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ড্রেস ও খেলাধুলার সামগ্রী বিতরণ করে তারা মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
পার্বত্য অঞ্চলের অবহেলিত মানুষদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে সেনাবাহিনী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে কম্পিউটার ও সেলাই মেশিন বিতরণসহ ঐ বিষয়ে প্রশিক্ষণও প্রদান করছে তারা। এতে পিছিয়ে পড়া পাহাড়ী-বাঙালি নারীরা স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
দুর্গম পার্বত্য এলাকার জনগণের সুষ্ঠু বিনোদনের জন্য সেনাবাহিনী প্রতিবছর নানা দিবসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। তাদের এসব কার্যক্রম মুক্তবুদ্ধি ও সাংস্কৃতিক চর্চাকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পথে পরিচালিত করছে। যা ইতিবাচক বলে মত দিয়েছেন দেশের আপামর জনগণ।
পাহাড়ীদের জীবন বদলে দিয়েছে সেনাবাহিনী
একসময় ভীষণ অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। ছিলনা শিক্ষার আলো। রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের বা গুরুত্বর অসুস্থ ও আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ছিলনা। এছাড়া তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ী সন্ত্রাসী দলগুলোর পাল্টা-পাল্টি হামলা ও খুনোখুনির কারণে ভয় নেমে আসতো সেখানকার বসবাসরত সাধারণ মানুয়ের ভেতর। সময় গড়িয়ে এখন বদলে গেছে এই পাহাড়ী জনপদ। বঙ্গবন্ধু কন্যা ও বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পাহাড়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে হাতে নিয়েছেন নানান পরিকল্পনা।
আর সেই পরিকল্পনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাত ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে খাগড়াছড়ি, বান্দরবন ও রাঙামাটি জেলায়। যার ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে গুইমারা সেনা রিজিয়নের উদ্যোগে গুইমারা রিজিয়নের পুরাতন কমান্ডার বাংলোতে একটি কম্বল ও ব্যাগ ফ্যাক্টরি উদ্বোধন করা হয়। এতে ঐ এলাকার স্থানীয় জনগণের ক্ষুদ্র কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ায় বেশ কিছু বাঙালি ও পাহাড়ী ব্যক্তিবর্গ শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ লাভ করায় তাদের পারিবারিক ভরণপোষণ ক্ষমতা ও স্বচ্ছলতা বৃদ্দি পেয়েছে। অনেকেই ভাবেননি এসব অঞ্চলে পানি আসবে, থাকবেনা বিদ্যুৎ সমস্যা। দুর্গম পাহাড়ী পথে ঘটবে উন্নয়ন, প্রান্তিক চাষিগণ প্রত্যন্ত এলাকা হতে বিভিন্ন উৎপাদিত কৃষিপণ্য ও ফলফলাদি পরিবহণে সুবিধা প্রাপ্তি হয়ে নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নে অবদান রাখবে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দুর্গম পাহাড়ে এখন জ্বলছে বিদ্যুতের আলো। রাস্তা করা হয়েছে প্রশস্ত। কোথাও পাকা সড়ক। বেড়েছে কৃষিকাজ। বেড়েছে চাষাবাদ। পর্যটন খাতেও উন্নতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সেখানে বাড়ছে বিনিয়োগ। তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এখন চলছে উন্নয়নযজ্ঞ।
আইএসপিআরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য তিন জেলাতে যোগাযোগের উপযোগী রাস্তা ছিল ২ হাজার ৮০৩ কিলোমিটার, বর্তমানে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের তত্ত্বাবধানে নির্মিত সড়ক যোগাযোগের পরিধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯৪৯ কিলোমিটার।
শান্তিচুক্তির পূর্বে তিন জেলায় হাসপাতাল-ক্লিনিক ছিল মাত্র ২৪টি, এখন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও কমিউনিটি পর্যায়ে ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে ২৭০টির বেশি। যাত্রী ছাউনি ও ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে ২০টি। সীমান্তসড়ক নির্মানেও ভূমিকা রয়েছে তাদের। এর সবই সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে।
শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সেনাবাহিনী
পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এবং বাঙালিদের মাঝে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সেনাবাহিনী নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকাগুলো ছিলো একসময় অরক্ষিত। বলা যায়, সন্ত্রাসী আর উগ্রবাদীদের অভয়ারণ্য। গোষ্ঠীগুলোর পরস্পরবিরোধী কার্যকলাপে প্রায়ই ঘটতো মৃত্যুর ঘটনা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আসে।
এরপরই সেখানে শান্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন তৎকালীন ও বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর। সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে কয়েক দফা সংলাপের পর অনুষ্ঠিত হয় পার্বত্য শান্তিচুক্তি। যা ইতিহাসে ঠাঁই করে নেয় সফলতার সঙ্গে।
এই চুক্তির পরপরই কমে আসে পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। স্থানীয় সূত্র মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশের বসবাস তিন পার্বত্য জেলায়। সেনাবাহিনী দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই যেন এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটেছে। তবে শান্তিচুক্তির পরও এখনও পাহাড়ে উগ্র উপজাতি গোষ্ঠী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে তৎপর রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি চার ভাগ হয়ে এখন প্রতিদিনই ঘটাচ্ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। তবে সেনাবাহিনীর কারণে সেখানে অনেক কমে আসছে এই ধরণের ঘটনা।
পাহাড়ে অনেক স্থান ছিলো অনুন্নত। পায়ে হেঁটে যাওয়ার কথা তো ভাবাই যায় না। অথচ সেনাবাহিনীর সদস্যরা পার্বত্যাঞ্চলে দিনরাত পরিশ্রম করে রাতারাতি সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটিয়েছেন।
সন্ত্রাস দমনে ও শান্তি ফেরাতে নির্ভীক সেনাবাহিনী
পাহাড়ে শান্তিকামী মানুষকে প্রায়শয় বিচলিত দেখা যায়। উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। লুটপাট করে। পর্যটক অপহরণ করে নিয়ে যায়। চাঁদাবাজি তো আছেই। এসব অপকর্ম থেকে পাহাড়ের মানুষকে শান্তিতে রাখতে দিনরাত অতন্দ্র প্রহরী হয়ে কাজ করছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
স্থানীয় সূত্রমতে, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি এবং বান্দরবানে একাধিক উপজাতি সন্ত্রাসী সংগঠন রয়েছে। যাদের হাতে জিম্মি রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েক লাখ মানুষ।
শান্তিচুক্তির পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এবং ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং ওয়ান এলিভেন সরকারের পর এ দুইটি সংগঠন থেকে আরও দুইটি উপজাতি সশস্ত্র সংগঠন সৃষ্টি হয়ে তারা বিভিন্ন নাশকতা ও সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে চাঁদাবাজি, অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায়, হামলা ও পাল্টা হামলার মাধ্যমে নিজেদের এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য সরকার কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। অথচ এসব উপজাতিগোষ্ঠী সেখানে উন্নয়ন কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট নামক উপজাতি সংগঠন মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা যখনই কোন ঘটনা ঘটার খবর পাচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ছুটে যাচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে নানা অভিযানে উদ্ধার করা হয়েছে রকেট লঞ্চার, ১৪-এমএম, এম-১৬, এসকে-৩২, সেনেভা-৮১, এম-৪ এবং এম-১ এর মতো ভয়াবহ অস্ত্র।
পার্বত্য এলাকা থেকে সেনাক্যাম্প অপসারণ না করার দাবি সেখানকার লাখো বাঙালির। এই দাবিতে একমত স্বয়ং পাহাড়িরাও। তারা বলেছেন, সেনাবাহিনীর তৎপরতার কারণে পাহাড়ের মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সুখী। কেননা পাহাড়ী-বাঙালি সবার জন্যই এই বাহিনীর সদস্যরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে।
একটি সূত্র জানায়, বিভিন্ন খাত থেকে বছরে এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের আয় ৫০০ কোটি টাকার বেশি। খাগড়াছড়িতে গত ২০ বছরে এমন সংঘাতে ৭শ’র বেশি খুন হয়েছে। এছাড়া রাঙামাটিতে গত ৫ বছরে মারা গেছে অন্তত ৪৫ জন।
পাহাড়বাসীর নিরাপত্তায় আত্নবলিদান
২০১৭ সালের জুন মাসের ১২ তারিখ সোমবার রাত ১৩ তারিখ মঙ্গলবার ভোরে অতিবৃষ্টির ফলে রাঙামাটির বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে, সেখানে ব্যাপক প্রানহানি ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এদিন জেলার মানিকছড়িতে পাহাড় ধসে মাটি ও গাছ পড়ে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে রাঙ্গামাটি জোন সদরের নির্দেশে মানিকছড়ি আর্মি ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনীর ১৬ জনের একটি দল ওই সড়কে চলাচল স্বাভাবিক করতে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে।
উদ্ধার কার্যক্রম চলাকালীন আনুমানিক বেলা ১১টায় পাশেই পাহাড়ের একটি বড় অংশ উদ্ধারকারীদলের সদস্যদের ওপর ধসে পড়ে। পাহাড় ধসের ফলে সেনবাহিনী সদস্যরা প্রায় ৩০ ফুট নিচে পড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই মেজর মোহাম্মদ মাহফুজুল হক ও ক্যাপ্টেন মো. তানভীর সালাম শান্ত নিহত হয়েছেন। পরে এ ঘটনায় আরো ৩ সেনা সদস্যের লাশ উদ্ধার করা হয় এবং ১০ সেনা সদস্য গুরুতর আহত হন।
বাকি নিহতরা হলেন কর্পোরাল মোহাম্মদ আজিজুল হক ও সৈনিক মো. শাহিন আলম ও সৈনিক মোঃ আজিজুর রহমান। পাহাড় ধসে উদ্ধারের বিষয়ে হয়তো তাদের কোন প্রশিক্ষণ ছিল না, কিন্তু দেশের মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোকে নিজেদের কর্তব্য মনে করেই ওরা সেদিন এগিয়ে গিয়েছিল।
এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফেরাতে এসে আজ অবধি বহু সেনা সদস্য মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হয়ে, সাপের কামড়ে কিংবা বন্য জন্তুর আক্রমনে নিহত হয়েছেন। কেউ কেউ আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।
দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত সেনাবাহিনীর বেশকিছু সদস্য পাহাড়ের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে সশস্ত্র আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। বহু সেনা সদস্য আহত হয়েছেন।
সর্বোপরি, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে এ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত সবসময়ে বাংলাদেশের মানুষ তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের আপদে/বিপদে সেনাবাহিনীর সদস্যদেরকে কোন না কোনভাবে নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে যেতে দেখা গেছে, এমন ঘটনা অসংখ্যবার ঘটেছে।
যেসকল ঘটনা আর ইতিহাস এই সীমিত পরিসরে বলে শেষ করা যাবে না