বম, খুমি, মুরুং যুবকদের উশৃংখল ও সন্ত্রাসী জীবন যাপনে অখুশি স্বজাতি তরুনীরা।

0

একটা সময় একজন ভ্রমণ পিপাসু হিসেবে দেশের আনাছে কানাচে ভ্রমণ আমার নেশা ছিল। জীবনের শত ঘাত প্রতিঘাত, প্রতিকূল পরিস্থিতি ও কর্ম ব্যস্থতা সবকিছু মিলিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি এক যুগ। সাংসারিক গ্লানি টেনে এখন আর দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে চলা সম্ভব নয়।

গত ১৩ ই মে বন্ধুবর সালমান আরমান জানালো বান্দরবান নীলগিরি, নীলাচল, চিম্বুক, তাজিংডং, কেওড়াডং সে ঘুরতে যাবে। ওখানে পরিচিত বলতেই কেউ নেই, তাই সঙ্গে আমাকে নিয়ে যেতে চায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণ তো ভ্রমণ পিয়াসুদের জন্য সাইবেরিয়া কিংবা নেপালের হিমালয় পর্বত মালার চেয়ে কম নয়। তাই অন্য চিন্তা না করে শত ব্যস্থতা ও সমস্যা থেকে হাফ ছেড়ে বাঁচতে বন্ধুর কথা মত ভ্রমণে বের হলাম।

গত ১৫ মে পূরবী বাসে করে বান্দরবান পৌছলাম। সেখান থেকে বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি হয়ে রুমা উপজেলায় পৌছলাম। ইচ্ছে ছিল রুমা, থানচি সাধ্যমত ঘুরবো, কারণ সামনের দিকে হয়তো ঘুরার এই পরিবেশ আর তৈরি হবে না। দুই বন্ধু মনে বড় আশা নিয়ে ঘুরতে বের হলাম। কিন্তু পার্বত্য এলাকার এই জনপদ যে এতটাই অশান্ত তা আচঁ করতে পারিনি। যার মাশুল হিসেবে পথে পথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর জিজ্ঞেসাবাদে পড়তে হয়েছে। আমরা যেদিন রুমায় এসেছি সেদিন থেকে স্থানীয় পাহাড়ি- বাঙ্গালীরা আমাদের দেখে ভিন গ্রহের বাসিন্দা দেখলে যেভাবে তাকায় ঠিক সেভাবে তাকায় আমাদের দিকেও। বিষয়টি প্রথম প্রথম স্বাভাবিক মনে হলেও একটা পর্যায়ে মনের খটকা লাগতে শুরু করে। কারণ আসার পর থেকে আইন- শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে ছিলাম আর পাহাড়ি কিছু যুবক ও বাঙ্গালীরাও আমাদের গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখছিল। তাই দুশ্চিন্তা কালো মেঘ দুর করতে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির কাছে রহস্যটা জানতে চাইলাম৷ তিনি জানালেন, “২০২২ সালের অক্টোবর হইতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সন্ত্রাসদমনে অভিযান অব্যাহত রেখেছে৷
ভারতের মিজো রাজ্যের অধিবাসী এবং মায়ানমারের আরকান ও কাচিন রাজ্যের অধিবাসীদের বসবাস এই সম্প্রীতির বান্দরবানে। এরা প্রায় দুইশো বছর ধরে বাস করে। এরা মিজোরামে ও আরকান কাচিনে কুকি চিন বা জো জাতি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বম, খুমি, মুরুং, পাংখোয়া, লুসাইরা কুকি চিন জনগোষ্ঠী।
একসময় এরা ব্রিটিশ শাসন আমলে চাকমা, মারমা কর্তৃক বান্দরবান থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। চাকমাদের সঙ্গে কুকিদের একটা ঐতিহাসিক বিরোধ রয়েছে। এই কুকিরা আবার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী এবং কিছুসংখ্যক দেব দেবীর পুজারি। সবচেয়ে পরিতাপের যে বিষয় সেটি হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে দেশী বিদেশি ষড়যন্ত্র চলমান। এনজিও, আইএনজি, মিশনারী ও দাতাসংস্থা গুলো চাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে পৃথক করে আলাদা একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠন করার জন্য৷ মূলত তারই পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত করার জন্য ইন্ধন যোগাচ্ছেন। কুকি চিন জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা উগ্রবাদী এবং ভারতে ও মায়ানমারে অবস্থান আছে তাদের একটি অংশকে অর্থ, কূটনীতিক ও বিভিন্ন সহযোগিতা দিয়ে এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে রয়েছে ত্রিদেশীয় সীমান্ত। প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলো এসুযোগ কে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে বীজ বপন করতে অবৈধ অস্ত্র, প্রশিক্ষণ দিয়ে এদের বাঙ্গালী ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লাগিয়ে দিয়েছে। বিগত বছরে বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচিতে এই কুকি চিন জনগোষ্ঠীর তথাকথিত অধিকারের দোহাই দিয়ে গর্জে উঠা কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) কর্তৃক নৃশংস হামলা হয়েছে। এসব হামলায় বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ বাহিনী, যাদের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি আছে এবং দেশের জন্য জীবন বাজি রাখতে বিসর্জন দিতে পারে সেই সেনাবাহিনীর ৩ জন সৈনিককে হত্যা করেছে!”

উক্ত জনপ্রতিনিধি থেকে এই কথা শোনার পর আমরা দুই বন্ধু বাকরূদ্ধ হয়ে পড়ছিলাম। মনে হচ্ছিল যেনো আমাদের নিঃশ্বাস বন্ধে হয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হয়ে ভাবলাম যে অঞ্চলে আমাদের রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ দিতে হয় সে অঞ্চলে আমরা কতটুকু বা নিরাপদ এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয়রা আমাদের ভিনগ্রহের বাসিন্দা মনে করাটা অমূলক নয়। এখানকার নির্মম ও করুণ ইতিহাস জেনে হতভম্ব হলাম আর ভাবলাম আমাদের দেশের মানুষ আর নীতিনির্ধারণী মহল কতটা দায়িত্বহীন! একটা দেশের সেনাবাহিনীকে হত্যা করে, জনপদকে হত্যা করে তার পরও নির্বিকার।

বাস্তবতার আলোকে বলতে গেলে আমাদের দেশের সরকার, রাজনৈতিক দল ও সর্বমহল- কে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়ের উপর নতুন করে ভাবতে হবে৷ এবং এই বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

স্থানীয় বিভিন্ন পেশাজীবী মহলের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম- রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচির পাহাড়ি- বাঙ্গালী কেউ ভালো নেই। সবাই আতঙ্কের মধ্যে আছে কে কোন সময় সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পড়ে সেই ভয় কাজ করে। তাই এখানকার পাহাড়ি- বাঙ্গালীদের মনে কালো মেঘ জমেছে। এখানে মানুষের কাছে মনে হয় ২৪ ঘন্টাই সূর্যঅস্ত থাকে। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হয়না৷ একই কথা অকপটে স্বীকার করলেন থানা পুলিশও। প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বসাধারণ।

বম, খুমি, মুরুং তরুণীদের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে হতাশা আর ক্ষোভের আগুন। এই স্বজাতি তরুণীরা যুবকদের কর্মকাণ্ডে অখুশি; তারা চায় না তাদের স্বামী, ভাই, বা প্রেমিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকুক; তারা চায় সন্ত্রাসী জীবন ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে নতুন জীবন গড়ে তুলুক; কারণ এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে প্রিয় মানুষগুলো জঙ্গলে থাকতে হয় পরিবার পরিজনকে সময় দিতে পারেনা; সবসময় আইন- শৃঙ্খলা বাহিনী খুঁজে বেড়ায়; যুদ্ধে কেউ কখন মারা যায় তার কোন নিশ্চয়তা নেই; হানাহানি, রক্তারক্তি সংঘর্ষ আর তারা দেখতে চায়না; তাদের যুবকের কর্মকাণ্ডে এমন অখুশি; স্বামী হিসেবে তারা কোনভাবেই তাদের যুবকদের গ্রহণ করতে আগ্রহী নয়।

১৯ বছর বয়সী এক বম তরণী অকপটে বলেন, “উশৃংখল, মদখোর, সন্ত্রাসী জীবন বেছে নেওয়া এমন যুবককে কোনো ভদ্র তরুণী স্বামী হিসেবে বেছে নিতে পারে না। সবাই সুন্দর জীবন চায় এমন সন্ত্রাসী পুরুষকে জীবন সঙ্গী করে নিজের জীবনকে বিপন্ন করতে চায়না সুস্থ নারী। তাই আমার জাতির যুবকের প্রতি অনুরোধ সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টে যোগদান করে নিজের জীবন এবং জাতির মেয়ের জীবন যেনো ভবিষ্যত অন্ধকার না করে।”

এই ভ্রমনে এসে পাহাড়ের মানুষের করুণ চিত্র দেখলাম! যেখানে নেই জীবনের নিরাপত্তা। প্রতিটি মূহুর্ত কাটে আতঙ্কে।রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচির আনাচে কানাচে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি সাধারণ মানুষের জনজীবন বিপন্ন করে এখানকার পরিবেশকে এক যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের মত করেছে। এখানকার বাচ্চারা সন্ত্রাসীদের আতঙ্কে স্কুলে যেতে পারছে না। মানুষ দৈনিক চাহিদার নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করতে বাজারে যেতে পারছে না এবং প্রশাসন সরকারি কার্যক্রম সঠিক ভাবে পালন করতে পারছে না।

জেলা সদরের সঙ্গে তিন উপজেলার একপ্রকার সবধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন; মানুষের চলাচলা একদম সীমিত; ঘর থেকে বের হওয়ার পরিবেশ নেই; চারদিকে আতঙ্কের ছড়াছড়ি। এমন এক বাকরূদ্ধ বন্ধী জীবন পার করছে অত্রাঞ্চলের জনপদের বাসিন্দারা। কিশোরী থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ্ব নারীর পর্যন্ত বিলাপ চলছে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে। তাদের এই বিলাপের কারণ, তাদের কারো ভাই, কারো স্বামী, কারো আত্মীয়, কারো বা প্রেমিক সন্ত্রাসী জীবন বেছে নিয়ে রাষ্ট্র- সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। যুদ্ধ কোথায় গিয়ে থামে কেউ জানেনা। পাহাড়ে জুমচাষের মত কঠোর পরিশ্রম করে দুমুঠো ভাত খেয়ে তারা সন্তুষ্ট ছিল৷ এখন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে তাদের কিছু যুবককে মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে নাথান বম অস্ত্র হাতে তুলে দিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে। এর কারণে এই শান্ত জনপদ আজ অশান্তির দাবানলে পুড়ছে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More