বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা!

0

আর্টিকেলঃ প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের প্রাণকেন্দ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম, যা বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের দশ ভাগের একভাগ। ১৩ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই পার্বত্য এলাকায় বাঙালিসহ বসবাস করছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ। এ এলাকার জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করে বিচ্ছিন্নতাবাদকে উস্কে দেয়ার জন্য বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের তৎপরতা রয়েছে। একশ্রেণির এনজিও, আইএনজিও, মানবাধিকার সংস্থা, দেশের তথাকথিত কতিপয় দেশদ্রোহী সুশীল সমাজ এবং বামপন্থী রাজনীতিবিদ সহ বিভিন্ন শ্রেণির প্রভাবশালীরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য দেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন মিথ্যাচার করছে। এরা পার্বত্যাঞ্চল ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে ‘উপজাতি’ অর্থ খাটো ও অপমানজনক শব্দ বলে ভূল ব্যাখা দিয়ে ‘আদিবাসী’ পরিচয় বহন ও স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আন্দোলন সৃষ্টি করে দিয়েছে। যে কারণে এখনাকার উপজাতি/ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা মনে করেন আদিবাসী স্বীকৃতি পাওয়াটা তাদের জন্য সম্মানজনক। কারণ এখানে ‘আদিবাসী’ শব্দের পিছনে একটি ভুল ব্যাখা চলমান রয়েছে। এই ভুল ব্যাখার পিছনে লুকিয়ে আছে রাষ্ট্র ভাগ করার ভয়ংকর পরিকল্পনা। এমন ভয়ংকর পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে এসব ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী।
তবে, বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায়/গোষ্ঠীকে উপজাতি/ক্ষুদ্র জাতিসত্তা/নৃ-গোষ্ঠী। এখানে আদিবাসী দাবী করাটা বোকামি ছাড়া কিছু নয়, এটি উপজাতিদের সম্পূর্ণ অযৌক্তিক দাবী। ঐতিহাসিক তথ্য মতে উপজাতিরা বার্মা, ভারতের তিব্বত, ত্রিপুরা, মিজোরাম, মঙ্গোলীয় এবং চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ১৭৩০ সাল নাগাদ যুদ্ধে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে (পার্বত্যাঞ্চলে) অস্থায়ীভাবে আগমণ করে৷ অনেক চাকমা-মারমা পন্ডিত ও লেখকগণ তাদের লেখা বিভিন্ন বইতে উল্লেখ করেছে, তারা আদিবাসী না, তারা পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে বিতাড়িত হয়ে এদেশে বসতি স্থাপন করেছে। তাদের অধিকাংশের আদি নিবাস বার্মা ও বার্মার চম্পকনগরে।” তারা যে এদেশের আদি বাসিন্দা নয়, এটা তারা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমেও অকপটে স্বীকার করেছে। (সূত্রঃ কার্পাস মহল থেকে শান্তি চুক্তি-আনন্দ বিকাশ চাকমা, বোমাং রাজার সংলাপ)। তাছাড়াও বাংলাদেশ সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই, যারা বহিরাগত দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে এদেশের ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন করেছে তারা ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী/উপজাতি হিসেবে স্বীকৃত।
আইএলও কনভেনশন-২০০৭ অনুযায়ী আদিবাসী হতে হলে- কোন নির্দিষ্ট স্থানে কয়েক হাজার বছর বসবাস করতে হবে, যাদের বসতি স্থাপনের সুনির্দিষ্ট ইতিহাস বিদ্যমান এবং তাদের কথ্য ও লেখ্য ভাষা ভান্ডারে থাকতে হবে কমপক্ষে দেড় হাজার শব্দভাণ্ডার। কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলে যে সকল উপজাতিদের বসবাস তাদের মধ্যে আদিবাসীর কোন সংজ্ঞা বিদ্যমান নাই। তাহলে তারা কিভাবে নিজেদের আদিবাসী দাবী করতে পারে??
এদেশের উপজাতীয় সম্প্রদায়কে কোনো অবস্থাতেই আদিবাসী হিসেবে উল্লেখ না করার বিষয়ে সংবিধানে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সংবিধানের কোথাও ‘আদিবাসী’শব্দের স্বীকৃতি নেই। সংবিধান বিষয়টি পরিষ্কার করে দেওয়ার পরেও এ বিষয় নিয়ে কারো মধ্যে দ্বিধা থাকার কথা ছিল না। গণমাধ্যমে সংবিধান পরিপন্থি ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর তথ্য অধিদপ্তর হতে সাংবাদিকদের পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু সংবিধানকে উপেক্ষা করে এদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা ‘আদিবাসী’স্বীকৃতির জন্য মহলবিশেষ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, বাংলাদেশ নামের এই ভূখণ্ডে কখনোই কোনো আদিবাসীর বসবাস ছিল না। নৃতাত্ত্বিক সংজ্ঞায় আদিবাসী বা ‘এবোরিজিন্যালস’রা হচ্ছে— কোনো অঞ্চলের আদি ও অকৃত্রিম ভূমিপুত্র বা Son of the soil।
প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ মর্গানের সংজ্ঞা অনুযায়ী আদিবাসী হচ্ছে, কোনো স্থানে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী যাদের উত্পত্তি, ছড়িয়ে পড়া এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে, বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, তারা ওই অঞ্চলের অকৃত্রিম ভূমিপুত্র বা আদিবাসী নয়। বরঞ্চ বাঙালিরাই তাদের আগে থেকে সেখানে বসতি গড়েছেন।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তিতে অত্যন্ত সঙ্গতকারণে ‘উপজাতি’শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। চুক্তির (ক) ধারার (১) উপধারায় উল্লেখ করা হয়েছে— উভয়পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করিয়া এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন। পার্বত্য চুক্তির আগে প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থাকাকালে জনসংহতি সমিতির কোনো নেতার মুখে আদিবাসী শব্দের ব্যবহার শোনা যায়নি। চুক্তি পরবর্তী দশ বছরেও এ নিয়ে কেউ চিন্তাও করেনি। জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দ নিজেরাও কখনো আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করেন না। এক্ষেত্রে কিছুটা কৌশলী অবস্থান নিয়ে তারা কখনো উপজাতি আবার কখনো ‘জুম্ম জাতি’উল্লেখ করেছেন।
২০১৪ সালের ১১ আগস্ট সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার রাঙ্গামাটিতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমি ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে যখন প্রথম আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন করেছিলাম, তখন সন্তু লারমা বলেছিলেন এই দেশে কোনো আদিবাসী নেই, এখানে আমরা সবাই উপজাতি। জুম্ম জনগণের আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আদিবাসী দিবস পালন করা হচ্ছে (সূত্রঃ পার্বত্য নিউজ)।
মূলত এদেশে বিশেষ ভাবাদর্শ প্রচারে নিয়োজিত এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীর বক্তৃতা, বিবৃতিতে উপজাতির পরিবর্তে আদিবাসী শব্দটি শোনা যায়। তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত গুটিকয়েক সংবাদ মাধ্যমও আদিবাসী শব্দের ব্যবহারে স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করে। এই প্রবণতা জোরালো রূপ ধারণ করে ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ‘আদিবাসী জনগণের অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র- ২০০৭ গৃহীত হওয়ার পর পরই। আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে তখন নতুন করে প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। যুগ যুগ ধরে উপজাতি হিসেবে পরিচিত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর হঠাৎ আদিবাসী দাবী করে বিভিন্ন মহল থেকে প্রচেষ্টা শুরু হয়, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশে কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস না থাকায় গত, ০৯ আগস্ট ২০২২ তারিখ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত টকশো-তে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে প্রচারের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

একদিকে বাংলাদেশে কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস নাই অন্যদিকে এই আদিবাসী শব্দটির ব্যবহার পরিহারে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে সবসময় আমাদের উপরোক্ত বিষয়গুলোর উপর লক্ষ্য রাখাটা জরুরী। তবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আদিবাসী স্বীকৃতির দাবির যৌক্তিকতা অনুধাবনের জন্য আদিবাসী শব্দের ব্যবহার বাংলাদেশের জন্য কতটা প্রাসঙ্গিক তা জানা অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত, এক্ষেত্রে সাধারণত জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র এবং আইএলও কনভেনশনের দোহাই দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু জেনে রাখা ভাল যে, এই ঘোষণাপত্র এবং কনভেনশনের কোনোটির সংজ্ঞা বাংলাদেশে নেই। জাতিসংঘের ফ্যাক্টশিটে বলা হয়েছে, আদিবাসীদের বৈচিত্র্যের কথা বিবেচনা করে, জাতিসংঘের কোনো সংস্থাই এই শব্দটির কোনো আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা প্রণয়ন করেনি। সংজ্ঞা স্পষ্ট না করেই আদিবাসীদের বিভিন্ন ধরনের অধিকার এবং সুবিধাদির কথা বিবৃত হয়েছে। এ কারণে আদিবাসী শব্দটিকে সুযোগসন্ধানী চক্র তাদের স্বার্থ আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

লেখক: আর জে রিমন
লামা, বান্দরবান

আগের পোস্টজাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক অস্পষ্ট ঘোষণাপত্র এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট।
পরের পোস্টশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুজিব কর্ণার ব্যানার স্থাপন করেছে ২৩ বিজিবি।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন