সরকার গৃহীত সীমান্ত সড়কের চলমান কাজ বন্ধ করতে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে স্মারকলিপি!

0

রুহুল আমিন তৌহিন, রাঙ্গামাটি থেকে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হোক তা চায়না ইউপিডিএফ-জেএসএস’সহ আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। কারণ এ অঞ্চলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে রাস্তাঘাট, যাতায়াত ব্যবস্থা ও সরকারি অবকাঠামো তৈরি হলে সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি, অপহরণ বাণিজ্য এবং আলাদা রাষ্ট্র গঠন করার পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। মূলত তারই কারণে সন্ত্রাসীরা সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মিত সীমান্ত সড়কের বিরোধিতা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেনাদের বিরুদ্ধে চরম মিথ্যা ও বানোয়াট অপপ্রচার ছড়িয়ে দেওয়াসহ প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছে। মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস) সন্তুর সন্ত্রাসীদের চাপে পড়ে কিছু গ্রামবাসী প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন। স্মারকলিপি প্রদানকারী গ্রামবাসীরা রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বিলাইছড়ি ও জুরাছড়ি সীমান্ত সংলগ্ন গাছবাগান পাড়া ও থুম পাড়ার বাসিন্দা।

তারা আজ মানববন্ধন শেষে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ৪টি দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি প্রদান করে। গাছবাগান পাড়া ও থুম পাড়ার পাহাড়ি অধিবাসীদের পক্ষে স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর প্রদান করেন অজিত কুমার চাকমা, মদন বিকাশ চাকমা, চিবোক্ষ চাকমা ও পূন্যরাণী চাকমা। ফারুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা সজল চাকমার সঞ্চলনায় স্মারকলিপি পাঠ করেন বৃষ্টি চাকমা।

স্মারকলিপিতে বলা হয় যে, “সেনাবাহিনী ঐ এলাকায় সীমান্ত সড়ককে কেন্দ্র করে তাদের পর্যটন ব্যবসার বিকাশের লক্ষে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং স্থানীয় জুম্মদের মৌলিক ও মানবাধিকারকে লংঘন করে জোরজবরদস্তিমূলকভাবে দুই গ্রামের অধিবাসীকে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু করেছে এবং দুটি গ্রামের ১৭ পরিবারদেরকে তাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন জুমচাষে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পর্যটন কেন্দ্র স্থাপিত হলে এবং উক্ত দুই গ্রাম উচ্ছেদ হলে, এর সাথে সাথে শুক্করছড়ি, চঙরাছড়ি, দুলুবাগান, বিলাইছড়ির মন্দিরাছড়া ও জুরাছড়ির মন্দিরাছড়া ইত্যাদি পাহাড়ি গ্রামগুলিও উচ্ছেদ হতে বাধ্য হবে। স্মারকলিপিতে আরো বলা হয় যে, আমরা গাছবাগান পাড়া ও থুম পাড়ায় বর্তমানে ২৩টি পাহাড়ি পরিবার বসবাস করে আসছি। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরপরই ১৯৯৮ সাল থেকে এই জুম্ম পরিবারগুলো সেখানে বসতিস্থাপন শুরু করি। আমাদের প্রধান জীবিকা জুমচাষ। বিগত ২৪/২৫ বছরে তাদের অনেকেই কলাবাগান, আম-কাঠাল বাগান, ঝাড়–ফলের বাগান গড়ে তুলেছি। জুমে অনেকে ধানচাষের পাশাপাশি আদা, হলুদ, তিল, মরিচ ইত্যাদি চাষও করেছি। সেনাবাহিনীর জুমচাষে নিষেধাজ্ঞার কারণে বর্তমানে তারা অত্যন্ত দিশেহারা অবস্থায় পড়েছে। তাদের বাড়ি, ভূমি ও জীবিকা রক্ষায় গ্রামবাসীরা গ্রাম ত্যাগ করার নির্দেশ প্রত্যাহার করা; গ্রাম সংলগ্ন পর্যটন স্থাপন না করা; জুম চাষে কোর বাধা প্রদান না করা এবং বাগান-বাগিচা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা- এই চারটি দাবি জানিয়েছে। গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ পাওয়া এই গ্রামবাসীরা বর্তমানে গভীর উদ্বেগ ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। সদয় অবগতি ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকেও অনুলিপি প্রদান করা হয়েছে।”

পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করার যে অভিযোগ তুলছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। আমরা সমতলেও দেখে থাকি সরকারি উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সাধিত করতে গিয়ে কিছু বাড়ি ঘর বা স্থাপনা সরাতে হয় তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সীমান্ত সড়কের মধ্যে অবস্থিত গাছবাগান পাড়া ও থুম পাড়ার কিছু বাসিন্দা। সীমান্ত সড়কের বেশিভাগ জায়গা সরকারের ১ নং খতিয়ানের জায়গা অথাৎ খাস ভূমি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত এলাকা জুড়ে বিচ্ছিন্ন বসতি রয়েছে৷ এখানে হাজার হাজার বা শত শত পাহাড়ি উচ্ছেদ বা বাস্তুহারার সম্ভাবনা নেই৷ সড়ক নির্মাণস্থলে অবস্থিত কিছু ঘর-বাড়ি সরাতে হচ্ছে। তারজন্য সেনাবাহিনী পরিবারগুলোকে যথাসময় দিচ্ছে এবং বিকল্প জায়গাও দিচ্ছে। কিন্তু এই ঘটনাকে পুঁজি করে জেএসএসসহ আঞ্চলিক দলগুলো সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যেভাবে মিথ্যাচার রটাচ্ছে তা প্রত্যাশিত। সেনাবাহিনী কেবলমাত্র প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে৷ প্রকল্পটি সেনাবাহিনীর নিজেস্ব কোন প্রকল্প নয়। এটি মূলত সীমান্ত সড়ক এবং সরকারের উন্নয়নমূলক কিংবা সীমান্ত সড়ক প্রকল্প। তাই সীমান্ত সড়ক নিয়ে সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলে সচেতন মহল মনে করেন৷ প্রকল্পটি সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হলে সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা যেমন জোরদার হবে তেমনি এ অঞ্চলের সংঘাত, হানাহানি ও অস্ত্রবাজি কমে আসবে। তারই পাশাপাশি খাগড়াছড়ি রামগড় থেকে বান্দরবান বা কক্সবাজার পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হবে।

প্রকল্পটি গুণগতমান নিশ্চিত ও যথাসময়ে সম্পন্ন করতে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কন্সট্রাকশন ব্রিগেডের ১৬, ২০ ও ২৬ ইঞ্জিনিয়ার কন্সট্রাকশন ব্যাটালিয়ন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। কয়েকটি পর্যায়ে সম্পন্ন করা হবে এক হাজার ৩৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সড়কটি। প্রথম পর্যায়ের ৩১৭ কিলোমিটার কাজ শেষ হতে আর কিছু সময় বাকি। ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে সড়কটি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। সড়কটিকে ঘিরে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে পর্যাটন শিল্প বিকাশের। পর্যাটন শিল্প একটি অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন করে দিতে পারে। দেশের একমাত্র সীমান্ত সড়ক নির্মিত হচ্ছে পাহাড়চূড়ায়। এটির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশ্বের কাছে নতুন করে পরিচয় পাবে। এ অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন যেমন হবে তেমনি পর্যটন শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে এখানকার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিশ্বের দরবারে উঠে আসবে, স্থানীয়দের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে।

প্রকল্পের চলমান কাজ বন্ধ করতে জেএসএস বিশেষভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে। তারা গ্রামবাসীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিতে বাধ্য করেছে৷ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জুমচাষ বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগটি ডাহামিথ্যে। সেনাবাহিনী কোনপ্রকার জুমচাষ বন্ধ করেনি। এটি সীমান্ত সড়ক কাজ বন্ধ করতে মিথ্যা ও বানোয়াট ষড়যন্ত্র। এই মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্র করার পেছনের কাহিনী সম্পূর্ণ অন্তরালে। কিন্তু আমাদের গভীর অনুসন্ধানে থলের বিড়াল বের হতে শুরু করেছে। স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্য হতে প্রাপ্ত তথ্য বলছে- বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে রয়েছে ত্রিদেশীয় দেশের সীমানা। ত্রিদেশীয় এলাকায় নেই সীমান্ত সড়ক এবং কাটা তারের বেড়া! যার কারণে সীমান্তে চোরাচালান এবং অবৈধ অস্ত্র আনা নেওয়াসহ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দৌরাত্ম বেড়ে গেছে। স্থানীয়রা বলছে- ত্রিদেশীয় সীমান্ত এলাকায় হওয়ার কারণে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিবেশী দেশগুলোর সংলগ্ন গহীন অরণ্যকে নিজেদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে৷ সীমান্তে প্রায় ৭৪ কিলোমিটার এলাকায় ছিলো না কাটা তারের বেড়া; নেই সীমান্ত সড়ক। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জেএসএস সন্তু, ইউপিডিএফ প্রসিত, জেএসএস সংস্কার, গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ, মগ পার্টি ও কেএনএফ’সহ বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ভারী অস্ত্র সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং দেশগুলোতে আশ্রয় শিবির ও ঘাঁটি করে বসেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অভিযানে নামে তখনি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো প্রতিবেশী দেশের আশ্রয়স্থল ও ঘাঁটি গুলোতে পালিয়ে যায়।
এছাড়াও সীমান্তে চোরাচালান বন্ধে সীমান্ত সড়ক এবং কাটা তারের বেড়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সব দেশে আছে সীমান্ত সড়ক। মূলত সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার এবং এখানকার জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা ও যাতায়াত ব্যবস্থার মানোন্নয়নে সরকার এজন্যেই সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়। সরকার গৃহীত সীমান্ত সড়ক প্রকল্পটির চলমান কাজ করতে সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে ইউপিডিএফ ও জেএসএস। ইউপিডিএফ প্রথম পর্যায়ের দিকে ষড়যন্ত্র করে ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় পর্যায়ে জেএসএসও এই ষড়যন্ত্রের দায়িত্ব নেয় বলে তাদের কর্মকাণ্ডে প্রতিয়মান হয়।

আগের পোস্টতীব্র তাপদাহে জুমের আগুনে জ্বলছে বিস্তীর্ণ পাহাড় প্রকৃতি।
পরের পোস্টবিলাইছড়ি জোনের উদ্যোগে আর্থিক সহায়তা প্রদান।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন