পাহাড়ে নতুন সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি উপজেলার দুর্গমে ও রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নে নাশকতা মূলক তৎপরতা শুরু করে। তাদের দাবি, তারা বম, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি, খেয়াং ও ম্রোদের অধিকারের জন্য সশস্ত্র আন্দোলন করছে। কিন্তু ৬টি জাতি তা স্বীকার করছে না। সংগঠনটি গড়ে ওঠে মূলত বান্দরবানের রুমা উপজেলায়। এর প্রধান রুমা উপজেলা সদরের ইডেন পাড়ার বাসিন্দা নাথান বম। তিনি ২০০৮ সালে কুকি-চিন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনস (কেএনডিও) নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। সেটি পরবর্তী সময়ে কেএনএফ নামে সশস্ত্র সংগঠনে রূপান্তর করেন।
কেএনএফ এর দাবি-
বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, বিলাইছড়ি, রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি নিয়ে পৃথক প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রণয়নসহ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল দেওয়ার। এই অঞ্চলের নামও তারা দিয়ে দেয়, ‘কুকি-চিন টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল’ বা কেটিসি। ১৩ টি উপজাতির মধ্যে তারা ক্ষুদ্র কুকিভুক্ত একটি মাত্র বম জাতি স্বায়ত্তশাসন বা স্বশাসন ব্যবস্থার মত একপেশে দাবিদাওয়া ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের ভূখণ্ড এবং জনসাধারণের জন্য হুমকিস্বরুপ। একটি স্বাধীন সার্বভৌমত্ব ছোট দেশে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মতামতকে উপেক্ষা করে স্বায়ত্তশাসনের মতো গনবিরোধী দাবি করে কেএনএফ যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায় তা বাংলাদেশের ভূখণ্ডের জন্য যেমন হুমকি তেমনি জনসাধারণের জন্যও হুমকিস্বরূপ। গনবিরোধী দাবি করে কেএনএফ অস্ত্র হাতে নিয়ে একের পর এক নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে। তাদের স্বায়ত্তশাসন বা স্বশাসন দাবি যদি রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয় তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পৃথক করার দুয়ার খোলে যাবে। অধিকার বিষয়ক যৌক্তিক দাবি না করে গণবিরোধী উত্থাপন করে রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকাণ্ড করছে। যা মানুষ ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করছে।
যেসব নাশকতা ও রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকাণ্ড করেছে-
কেএনএফের গোপন আস্তানায় সমতলের জঙ্গিগোষ্ঠী জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ নেয় বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়। কেএনএফের কথিত সামরিক শাখার নাম কেএনএ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত বছরের অক্টোবরে কেএনএফ ও শারক্কীয়া জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। সেসময় ৩৭ জনকে আটক করে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেএনএফ এর হামলায় মোট ৬ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং আরো বেশ কয়েকজন সাধারণ নিহত হন। কেএনএফ পর্যটকদের উপর হামলার পাশাপাশি, মোবাইল ও টাকা পয়সা লুটপাট করেছে৷ জেলা জুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে পর্যটন শিল্পে ধ্বস নামিয়েছে। সাম্প্রতিক সময় অথাৎ গত ২ ও ৪ এপ্রিল রুমা, থানচি ব্যাংক ডাকাতি এবং পুলিশ ও আনসার সদস্যের অস্ত্র লুটপাট করার ঘটনা দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অভিযানের নির্দেশ দেয়। এই অভিযানে ৭৪ জনকে আটক করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এর আগে সরকার তাদের সঙ্গে সৃষ্ট সমস্যা রাজনৈতিক উপায়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করে। কেএনএফের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর অভিযানের মধ্যে ২০২৩ সালের ৩০ মে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’ গঠিত হয়। এর প্রধান বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা। ওই বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে কমিটির সঙ্গে কেএনএফের কয়েকবার ভার্চ্যুয়াল বৈঠকও হয়। পরে গত নভেম্বরে ও এ বছরের ৫ মার্চ কেএনএফের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সরাসরি দুটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। কেএনএফ এর সঙ্গে সরকারের শান্তি কমিটি মাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়। আলোচনার মধ্যেই তারা ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুট করে! আলোচনা প্রত্যাখ্যান করে তারা এমন কর্মকাণ্ড করার কারণে শান্তি কমিটি তাদের সঙ্গে আলোচনা বাতিল করে। সরকারের কাছে কেএনএফ এর দাবিদাওয়া ছিল একপেশে ও আকাশচুম্বী। যা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে সার্বভৌমত্ব হরণ করে। এই দাবিদাওয়া বাস্তবায়নের মাধ্যমে একক আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর প্রতি অবিচার করার প্রচেষ্ঠা করে আসছিল কেএনএফ। তাদের এই দাবিদাওয়া জনসাধারণ যথা- পাহাড়ি- বাঙ্গালীর জন্য হুমকিস্বরূপ৷ তারা এমন কিছু দাবি করেছে যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে এবং যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য না।
সর্বমহল আশা করেছিলো, কেএনএফ এর দাবি সংবিধান সম্মত হবে। কিন্তু সেরুপ হয়নি। তাদের দাবিদাওয়া অপ্রত্যাশিত। যা কোনভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাদের উচিত সংবিধান সম্মত দাবি পেশ করা যা সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য হয় এবং শান্তি স্থাপনে ভূমিকা রাখে।