৩৮ বছর পরও বিচার পায়নি পার্বত্য বাঙ্গালীরা।
হানান সরকার লেখক ও মানবাধিকার কর্মী।
২৯শে এপ্রিল খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার পানছড়ি উপজেলা গণহত্য দিবস। ১৯৮৬ সালের এই দিনে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) তথাকথিত শান্তিবাহিনী কর্তৃক পার্বত্য বাঙ্গালী জাতিসত্তাকে নিধন করার অংশ হিসেবে গণহত্যা পরিচালনা করা হয়। জেলার পানছড়ি উপজেলাতে বসবাসরত বাঙালির জীবনে নেমে আসে নৃশংস, বীভৎস, ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় এক কালরাত্রি। রাত আনুমানিক ৯টায় বর্বর শান্তি বাহিনী নিরস্ত্র নিরিহ শান্তিপ্রিয় বাঙালির ওপর হিংস্র দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত দিন। সেদিন পার্বত্যবাসী প্রত্যক্ষ করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের এক নৃশংস বর্বরতা। ঘটনার ৩৮ বছর অতিবাহিত হলেও কোন বিচার পায়নি স্বজনহারানো পরিবার গুলো। নিহতদের পরিবারের সদস্যের কোনপ্রকার সাহায্য-সুযোগিতা করা হয়নি। hbf বলছে নিহতের স্মৃতিচরণসহ সব ইতিহাস মুছে ফেলা হয়েছে।
আলোকিত পাহাড়ের রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায়, ১৯৮৬ সালের ২৯শে এপ্রিল দিবাগত রাঁত আনুমানি ৯টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত মোট ৪ঘন্টা ব্যাপী খাগড়াছড়ি জেলার সীমান্তবর্তী পানছড়ি উপজেলা‘র ১নং লোগাং ইউনিয়ন, ৩নং পানছড়ি সদর ইউনিয়ন ও ৪নং লতিবান ইউনিয়ন (বর্তমানে ৫নং উল্টাছড়ি ইউপি)‘র বাঙ্গালি গ্রামে অগ্নি সংযোগসহ নির্বাচারে গণহত্যা চালায়। শিশু, কিশোর, নারী, পুরুষ, আবাল, বৃদ্ধ-বনিতা যাকে যেখানে পেয়েছে তাকে সেখানেই হত্যা করেছে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্রগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস)‘র অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। তৎ সময়ে বে-সরকারী হিসাবে মাত্র ৪ঘন্টা সময়ে নিরস্ত্র ও নিরীহ ৮শত ৫৩ জন বাঙ্গালীকে হত্যা করা হয়েছে, আহত করা হয়েছে প্রায় ৫শত জনকে, অপহরণ ও গুম করা হয়েছে আরো কয়েক হাজার বাঙ্গালীকে। এর কয়েকদিন আগে ১০ এপ্রিল লোগাং গণহত্যা চালিয়ে হাজারের উপরে বাঙ্গালীকে হত্যা করে। এই দাগ মুছানোর আগে আরেকটি গণহত্যা করে। কতটা হিংস্র, নির্মম, বর্বর ও অত্যাচারি হলে শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা বাঙ্গালীদের এভাবেই নিধন করতে পারে?
২৯ এপ্রিল ১৯৮৬ এই দিনে পানছড়ির পাশাপাশি মাটিরাঙ্গা উপজেলার অনেক স্থানে গণহত্যা চালায় শান্তিবাহিনী। তবলছড়ি, আসালং, শনটিলা, ফাতেমা নগরসহ ৬টি বাঙ্গালী এলাকায় গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যা ইতিহাসে স্থান পায়নি!
৬হাজার ২শত ৪০টি বাড়ি সম্পূর্ন ভাবে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এতে গৃহহীন হয়ে পড়ে হাজার হাজার পরিবার। সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তি বাহিনী‘র গেরিলা যোদ্ধারা সেই হামলায় এত গুলো মানুষকে হত্যা করতে একটি বুলেটও ব্যবহার করেনি। হাত-পা বেঁধে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে, দা দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে, জবাই করে, আগুনে পুড়িয়ে, শিশুদেরকে পায়ে ধরে গাছের সাথে বাড়ি দিয়ে, বেনেট ও অন্যান্য দেশি অস্ত্র দিয়ে খোঁচিয়ে খোঁচিয়ে হত্যা করেছিল। প্রতিটি লাশকেই বিকৃত করে সে দিন চরম অমানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল শান্তি বাহিনীর সন্ত্রাসীরা। ঘটনাটি যারা স্ব-চোখে দেখেছে বা বেচে যাওয়া কিছু কিছু সাক্ষী আজো আছে, কিন্তু ঘটনার কথা মনে পড়লে আজও তারা শিউরে উঠে। এটি ইতিহাসের নৃশংস গণহত্যা দিবস হিসেবে বিবেচিত। সম্মানিত পাঠকমণ্ডলী আপনি পড়ছেন hbf এর লেখা। hbf এর কোন লেখা কপিরাইট নীতি লঙ্ঘন করা যাবে না।
পানছড়ি গণহত্যা ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে উপজাতি এসব সন্ত্রাসীদের দ্বারা বিভিন্ন গণহত্যা সংঘটিত হয়। এসব গণহত্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য লংগদু গণহত্যা, ১৯৭৯ কাউখালি কলমপতি গণহত্যা, বেতছড়ি গণহত্যা, বানরাইবারী, বেলতলী, বেলছড়ি গণহত্যা, তাইন্দং, আচালং, গৌরাঙ্গ পাড়া, দেওয়ান বাজার, তবলছড়ি, বর্ণাল, রামছিরা, গোমতি গণহত্যা,গোলকপতিমা ছড়া, মাইচ্যেছড়া, তারাবনছড়ি গণহত্যা, ভূষণছড়া গণহত্যা, দিঘীনালা গণহত্যা, ২৯ এপ্রিল ১৯৮৬, মাটিরাংগা গণহত্যা, কুমিল্লাটিলা, শুকনাছড়ি, দেওয়ান বাজার, সিংহপাড়া, তাইন্দং গণহত্যা, দিঘীনালা গণহত্যা, ২ জুলাই ১৯৮৬, ভাইবোন ছাড়া গণহত্যা, হিরাচর, শ্রাবটতলী, খাগড়াছড়ি, পাবলাখালী গনহত্যা, লংগদু গনহত্যা ১৯৮৯, নাইক্ষ্যাছড়ি গণহত্যা, মাল্যে গনহত্যা, লোগাং গনহত্যা, নানিয়ারচর গনহত্যা, পাকুয়াখালী গণহত্যা, জুরাইছড়ি গণহত্যা। জেএসএস’র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের রাংগামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা। সে ষড়যন্ত্র থেকে তারা বাঙ্গালীদের হত্যা করে এদেশের খ্যাতিমান সামরিক বাহিনীর অফিসার ও সৈনিক থেকে শুরু করে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরের ৬১৫ জনকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে এইরকম অসংখ্য গণহত্যা করেছে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস শান্তিবাহিনী। গণহত্যা গুলোর কোনটারই বিচার হয়নি। বাঙ্গালী গণহত্যাকারী সন্তু লারমাকে সরকার ১৯৯৭ সনের পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা দিয়ে ভূষিত করে স্বজনহারা বাঙ্গালী পরিবারগুলোর সঙ্গে তামাশা করেছে। এই গণহত্যার স্মৃতিচারণ নেই। সরকারি ভাবে স্বীকৃতি নেই৷ দিবসটি পালন করার জন্য স্থানীয়রাও উৎসাহিত নয়। পার্বত্য বাঙ্গালীরা পূর্বের বাঙ্গালীর উপর চালানো হত্যাযজ্ঞ ভুলে যেতে বসেছে। দিনদিন অকৃতজ্ঞতা ভর করেছে।
এদিকে বাঙ্গালী গণহত্যার দায় থেকে বাঁচতে উপজাতি সংগঠনগুলো বরাবরই উল্টো বাঙ্গালী, বিডিআর ও সেনাবাহিনীর উপর দায়ভার চাপিয়ে দিয়ে পাহাড়িরা গণহত্যার শিকার হয়েছে বলে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। দুঃখজনক যে, এই গণহত্যা নিয়ে তথাকথিত বাঙ্গালী সংগঠনের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। এসব গণহত্যার প্রকৃত ঘটনার দিন তারিখ বা ইতিহাস, প্রকৃত ঘটনা এবং দিনটি স্মরণ করার মতো পদক্ষেপ নেই। নেতৃত্বহীন পার্বত্য বাঙ্গালীরা দিনদিন গণহত্যা গুলো ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলছে।