চুক্তি বাস্তবায়নে ছাত্র-যুব সমাজ অধিকতর সামিল হওয়ার ডাক জেএসএসের!

0

হান্নান সরকার, লেখক ও মানবাধিকার কর্মী:

১৯৯৭ সনের ২-রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষে রাজনৈতিকদল পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস)-এর সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন চীপ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এমপি’র সঙ্গে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নামক’ একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে জেএসএস সন্তু বরাবরই অভিযোগ করে আসছে সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয়। চুক্তির অনেকগুলো মৌলিক ধারাসহ ৭৫% ধারা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি বলে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন৷ চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারকে অসহযোগ আন্দোলন এবং মাঝেমধ্যে জঙ্গলে চলে যাওয়ার হুমকি দেন জেএসএস সন্তু গ্রুপ। তবে আগে যেভাবে জঙ্গলে গিয়ে অস্ত্র ধরার হুমকি দিতেন এখন আর সেভাবে হুমকি দিচ্ছেন না বয়সের ভারে নুয়ে যাওয়া সন্তু লারমাসহ বৃদ্ধ বয়সী জেএসএস নেতারা। ধারণা করা হয় জেএসএস এর নেতৃত্বের প্রথম সারির শীর্ষ নেতারা সবাই ষাটোর্ধ। তাই এখন অসহযোগ আন্দোলন আর বৃহত্তর আন্দোলনে ছাত্র-যুব সমাজ অধিকতর সামিল হওয়ার ডাক ছাড়া অন্য হুংকার দিতে পারছেন না।

আগামী ২০ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে জেএসএস সন্তুর সহযোগী অঙ্গসংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি’র) ৩৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং ২৮-তম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল। এ উপলক্ষে চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন অধিকতর করার জন্য ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রচারণা ও শোডাউন দিচ্ছে জেএসএস ও তার সহযোগী অঙ্গসংগঠনগুলো। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাশাপাশি চট্টগ্রাম-ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের প্রচার-প্রচারণা ও পোস্টার, ফেস্টুন ও লিফলেট লাগানো থেমে নেই৷ জেএসএস সূত্র বলছে, আগামী ২০ মে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে ছাত্র-যুব সমাজের ডাকে তাদের বড় সমাবেশ আছে রাঙ্গামাটি জিমনেসিয়াম; ২১ মে আছে তাদের প্রতিনিধি সম্মেলন, সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হবে; এতে উপস্থিত থাকবেন, জেএসএস সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা। চুক্তি বাস্তবায়ন সমাবেশ সফল করতে তাদের এখন স্লোগান হলো- “আত্মমুখিনতা, সুবিধাবাদ ও দোদুল্যমানতা পরিহার করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে জুম্ম ছাত্র-যুব সমাজ অধিকতর সামিল হোন।”

এই সমাবেশের মাধ্যমে জেএসএস সরকারকে কী বার্তা দিতে চায় তা সময়ে বলে দিবে। তবে জেএসএস যে আন্দোলনে বরাবরই পিছিয়ে তা তাদের বিগত কয়েকবছরের কর্মকাণ্ডে প্রতিয়মান। চুক্তির পরও সশস্ত্র কার্যক্রম বিদ্যমান রাখা জেএসএস বর্তমানে ইউপিডিএফ এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারছে না বলে ধারণা স্থানীয়দের। চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারকে বারবার অভিযুক্ত করে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে প্রচেষ্ঠা করলেও কার্যত কিছু করতে পারেনি। এমনকি চুক্তির অবশিষ্ট ধারাগুলো বাস্তবায়নে সরকারকে সময়সীমা নির্ধারণ করে দিতে পারেননি!

চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার কী বলছে?

জেএসএস এর চুক্তি বাস্তবায়ন অভিযোগের বিপরীতে সরকারের প্রতিনিধি জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সংক্রান্ত জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরামের ২৩তম অধিবেশনে পার্বত্য চুক্তির অগ্রগতি তুলে ধরেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মশিউর রহমান বলেন, পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারা মধ্যে ৬৫ টি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চুক্তির ধারাগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। চারটি ধারা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে বলেও তিনি জানান।

জাতিসংঘের বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন জানায়, “পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মশিউর রহমান ঐতিহাসিক ‘পার্বত্য চুক্তি’ বাস্তবায়ন এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের উন্নয়ন ও অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বিকাশে সরকারের গৃহীত কার্যক্রম বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন।

মশিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান দেশের জনগণের মধ্যে ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থান নির্বিশেষে সম-অধিকার দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে কয়েক দশকের সংঘাতের অবসান ঘটেছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণকে এ দেশের উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

এ ছাড়া তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ডিজিটাল ভূমি জরিপ ও ব্যবস্থাপনা উদ্যোগসহ অত্র অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়ন সাধনে সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপ সম্পর্কে ফোরামকে অবহিত করেন। তিনটি পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় তিনজন প্রথাগত সার্কেল চিফ নানাবিধ প্রশাসনিক ও আইনি কর্তৃত্ব ভোগ করেন এবং প্রতিটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে নির্বাচিত হন বলেও উল্লেখ করেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সচিব।

তিনি আরও জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে পরামর্শ করে সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে। জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি সংস্থা ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী এ অঞ্চলে উন্নয়ন কার্যক্রমের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। মশিউর রহমান উল্লেখ করেন স্পষ্টতই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর থেকে এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নে অসামান্য পরিবর্তন ঘটেছে।”

সরকারের এই বক্তব্যের প্রায় সত্যতা থাকলেও জেএসএস কেন সরকারের বিরুদ্ধে চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয় বলে অভিযোগ করে তা বোধগম্য নয়। আর এই বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকেও নেই কড়া জবাব। মিথ্যা ও বানোয়াট ও নেতিবাচক বক্তব্যের বিষয়ে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ না থাকায় হতাশা ব্যক্ত করেন বিশ্লেষকরা।

পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় অধিবাসীরা বলেন, চুক্তির প্রায় ধারা বাস্তবায়িত হলেও জেএসএস চুক্তির ১টি মাত্র মৌলিক ধারা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে জেএসএস। চুক্তির মৌলিক শর্ত লঙ্ঘন করে এখনো অবৈধ অস্ত্র নিয়ে চাঁদাবাজি, অপহরণ বাণিজ্য ও খুন-খারাবিসহ এ অঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে জেএসএস৷ যার কারণে স্থায়ী শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে। অধিবাসীরা আরো বলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে শুধু সরকারই নয় পার্বত্য জনসংহতি সমিতি বা জেএসএসও শর্ত মানতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু তাদের চুক্তির শর্ত মানার আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেকের।

এমনই যখন বাস্তব চিত্র, তখন পার্বত্য চুক্তির ২৬ বছরে দাঁড়িয়ে জনসংহতি সমিতি দাবি তুলছে, চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি সরকার। শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়। এখন বিদেশের মাটিতেও বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক বক্তব্য রাখছেন পাহাড়ের জেএসএস নেতারা। এবার ডাক দিলেন চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে ছাত্র-যুব সমাজ অধিকতর সামিল হওয়ার।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি একতরফাভাবে সম্পাদিত হওয়ার ফলে এ অঞ্চলের বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। চুক্তির সমস্ত সুযোগ-সুবিধা উপজাতি জনগোষ্ঠীর পক্ষে। পার্বত্য চুক্তির এই বৈষম্যের ফলে এ অঞ্চলের বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী দিনদিন অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে।

কিন্তু এসব কিছু চাপিয়ে এখন যেটা জনমনের প্রশ্ন তা হলো- জেএসএস পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষ নিয়ে বা সমস্ত উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দল পরিচয় দিয়ে যে ৯৭’ চুক্তি স্বাক্ষর করার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের ১৪টি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পক্ষে দাবিদাওয়া উত্থাপন পূর্বক সুযোগ-সুবিধা ও অনেক অধিকার আদায় করে নিয়েছে। প্রশ্ন তৈরি হওয়ার অন্যতম কারণ, চুক্তির সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার এককভাবে জেএসএস গিলে খাচ্ছে। সেসময় জেএসএস বলেছিলাম এ অঞ্চলে সবকিছু নিয়ন্ত্রক তারা, তারাই উপজাতীয়দের রাজনৈতিকদল ও অধিকার আদায়ের দল! এখন প্রশ্ন হলো, ইউপিডিএফ প্রসিত, গণতান্ত্রিক বর্মা, সংস্কার এম.এন, মগ পাটি এমএলপি ও কুকি-চিন কেএনএফ এরা কারা?? এরা কেন আলাদা অধিকার দাবিদাওয়া পেশ করছে এবং স্বায়ত্তশাসনের অন্তরালে দেশভাগের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করছে? সরকার চুক্তির মাধ্যমে এত এতো সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরেও কেন এরা সৃষ্টি হলো? এবং এই দায়ভার কী জেএসএসের নয়? জেএসএস যদি চুক্তির মৌলিক শর্ত লঙ্ঘন করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে থাকতে পারে এবং আধিপত্য বিস্তার ইস্যুতে একের পর এক দল-উপদল সৃষ্টি করে পাহাড়ে শান্তি-সম্প্রীতি ও উন্নয়নে বাধাপ্রাপ্ত করার মাধ্যমে হানাহানি, রক্তারক্তি সংঘর্ষ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে রাষ্ট্রের সঙ্গে চরম ধৃষ্টতা দেখায় তখন রাষ্ট্রের বা কী ভূমিকা হতে পারে? সরকার তো চুক্তিতে দেয়া ওয়াদা অক্ষরে অক্ষরেই পালন করেছে। চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৭০টি ধারাই জেএসএস এর অনুকূলে। মাত্র ২টি ধারা বাস্তবায়ন করতে জেএসএসের ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে। পক্ষান্তরে সরকার ৬৫ টি চুক্তির ধারা বাস্তবায়ন করে উপজাতি জনগোষ্ঠী তথা এ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ আন্তরিক বলে প্রমাণ করে দিয়েছেন। অবশিষ্ট ৭টি চুক্তির ধারা বাস্তবায়ন হবে জেএসএস এর অস্ত্র ত্যাগ করার উপরই নির্ভর করে। যদিও ৭টি ধারা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু বিলম্ব হওয়ার কারণে এর দায়ভার বা সিদ্ধান্ত জেএসএস এর উপর। জেএসএস কী চুক্তি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন চায় নাকি অবৈধ অস্ত্র নিয়ে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তার করবে এখন তা তারাই ঠিক করবে।

আগের পোস্টকেএনএফ অসহায় নিরীহ লোকজনকে ভুল বুঝিয়ে এতদিন তাদের সাথে ওঠাবসা করেছিল।
পরের পোস্টঅশান্ত বান্দরবানে চলমান যৌথ অভিযান নিয়ে কিছু কথা: ব্রিঃ জেঃ মো. বায়েজিদ সরোয়ার।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন