ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ারের নিবন্ধ।
বান্দরবান জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত অপরূপ এক ভূখণ্ড। জেলাটির পূর্বদিকে রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলায় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ৫টি পাহাড় শৃঙ্গ অবস্থিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্গম এই অঞ্চলে বাস করে সবচেয়ে প্রান্তিক ও অনগ্রসর কয়েকটি ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠী। শান্তিচুক্তির (১৯৯৭) পর এই অঞ্চলের পাহাড়, হ্রদ, ঝরনা, অরণ্য, নদী পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু অক্টোবর-২০২২ এর পর থেকে সৌন্দর্যের লীলা ভূমি ও সম্প্রীতির বান্দরবানের বাতাসে এখন বারুদের গন্ধ। ‘কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ বা কেএনএফ ও এর সামরিক শাখা ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি’ (কেএনএ)-এর কিছু বিপথগামী তরুণের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও এর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় সবুজ পাহাড়ে আবার প্রবাহিত হচ্ছে হিংসার ঝরনাধারা।
দীর্ঘদিন ধরে রুমা উপজেলায় অবস্থিত ক্রেওক্রাডাং বাংলাদেশের উচ্চতম শৃঙ্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। দুঃখজনক হলো, এই ক্রেওক্রাডাংসহ বেশ কিছু উঁচু ও দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে বৈশাখের প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের মাঝেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তা বাহিনীকে যৌথ অভিযান পরিচালনা করতে হচ্ছে। এই লেখায় মূলত বান্দরবানে চলমান যৌথ অভিযানের কিছু বিষয়ে আলোকপাত করব।
কেএনএফের উত্থানের ফলে ২০২২ সাল থেকে বান্দরবান অশান্ত হয়ে ওঠে। তবে ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা শুরু হলে পরিস্থিতি আপাত দৃষ্টিতে শান্ত ছিল। কিন্তু গত ২-৫ এপ্রিল ২০২৪ সময়কালে, কেএনএফের বেপরোয়া সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বিশেষত ব্যাংক ডাকাতি, অপহরণ, অস্ত্র লুট ও থানায় গুলি বর্ষণ ইত্যাদি ফলে বান্দরবান এলাকার পরিস্থিতি একেবারে পাল্টে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে সংঘাতময় পরিস্থিতি। একই সঙ্গে পাহাড়ে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু দুর্বলতা ও দায়িত্বের শৈথিল্য আলোচনায় এসেছে। কেএনএফের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ব্যাপক প্রচার পেলেও এসবের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের কাছে কেনএনএফ নতুন করে সন্ত্রাস ও আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে। খোদ বম সম্প্রদায়ের মধ্যেও তাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে বলে জানা যায়।
কেএনএফ এর বিরুদ্ধে পাহাড়ে ৩য় যৌথ অভিযান
গত ৭ এপ্রিল থেকে বান্দরবানের রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়িতে সেনাবাহিনীর সার্বিক নেতৃত্ব ও সমন্বয়ে কেএনএফের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে র্যাব, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনী এই অভিযানে অংশ নিয়েছে। উল্লেখ্য, গত দুই বছরে এটি কেএনএফের বিরুদ্ধে পরিচালিত ৩য় অভিযান। কেএনএফের বিরুদ্ধে নতুনভাবে গড়ে ওঠা ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়া’ নামে একটি উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠনকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। এই পটভূমিতে ৯ অক্টোবর, ২০২২ থেকে সেনাবাহিনী ও র্যাব বান্দরবানসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকায় কেএনএফের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। পরে সেনাবাহিনীর ওপর কেএনএফের আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের মে-জুন মাসে সেনাবাহিনী তথা নিরাপত্তা বাহিনী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেছিল। সেই সময়ে রুমা অঞ্চলে কেএনএফের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ও আস্তানা ধ্বংসের সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছিল।
পাহাড়ে অদ্ভুত যুদ্ধ
দীর্ঘদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘কাউন্টার ইন্সারজেন্সি অপারেশনে’ (সিআইও) নিয়োজিত থাকায় বান্দরবানের বর্তমান অভিযানিক পরিবেশ পরিস্থিতি, বিশেষত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের চ্যালেঞ্জগুলো উপলব্ধি, অনুমান করতে পারি। ‘কাউন্টার ইন্সারজেন্সি’ অদ্ভুত একটা যুদ্ধ। প্রচলিত যুদ্ধ সাধারণত বিদেশি আক্রমণের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। কিন্তু নিজ দেশের একটি এলাকার কিছু মানুষ বা জনগোষ্ঠী অস্ত্র তুলে নিয়ে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করলে (বিদ্রোহ/ইন্সারজেন্সি) তাদের দমনের জন্য ‘কাউন্টার ইন্সারজেন্সি অপারেশন’ (সিআইও) বা ‘প্রতি-বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম’ পরিচালনা করা হয়। এই যুদ্ধের মূলমন্ত্র হলো- ‘জনগণের হৃদয় ও মন জয়’। শান্তিবাহিনীর ইমারজেন্সি (বিদ্রোহ) দমন বা মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা নিরাপত্তা বাহিনী ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল (শান্তিচুক্তির স্বাক্ষর) পর্যন্ত ‘সিআইও’ পরিচালনা করেছে। শান্তি চুক্তির পর (ইন্সারজেন্সি উত্তর পরিবেশে) পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে প্রশাসনকে সহায়তা করে আসছে। কিন্তু কেএনএফের সাম্প্রতিক সশস্ত্র কর্মকাণ্ড বান্দরবানের পূর্বাঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রায় ‘সিআইও’-এর ভূমিকায় কাজ করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
চলমান অভিযানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়। শান্তিচুক্তির পূর্বে পার্বত্য অঞ্চলে একটি কার্যকর অভিযানিক কাঠামো ছিল। বর্তমান পরিস্থিতির বিবেচনায়, আগের মতো না হলেও একটি ‘ফাংশনাল কাঠামো’ তৈরি করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে বেশ কয়েক সপ্তাহব্যাপী অসহনীয় দাবদাহ চলছিল। বৈশাখের সেই প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে বান্দরবানের উঁচু দুর্গম পাহাড়ে সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সৈনিকরা বিপথগামী কেএনএফের তরুণদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছিল। যা এখনও চলমান। কেএনএফের হঠকারিতায় সীমান্তবর্তী উঁচু পাহাড়ের এক সময়ের শান্ত জনপদ যেমন ক্রেওক্রাডং, রামজুতাং, সিলোপিপাড়া, থিনদলপে, বাকলাই পাড়া, টেবিল হিল, সাইজাম পাড়া, রেমাক্রি প্রাংসা… এখন প্রায় অনাকাঙ্ক্ষিত রণাঙ্গনের অংশ।
চ্যালেঞ্জগুলো পাহাড়ের মতো উঁচু
অভিযানরত সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সবচেয়ে বড় একটি চ্যালেঞ্জ হলো : এলাকার সাধারণ গ্রামবাসী থেকে কেএনএফের সন্ত্রাসী/অস্ত্রধারীদের পৃথক করা ও সুনির্দিষ্টরূপে চিহ্নিত করা। এই ধরনের যুদ্ধে ইন্সারজেন্টরা (এখানে কেএনএফ) জনগণের মধ্যে মিশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে থাকে। তাদের পৃথক করা খুব কঠিন কাজ। এক্ষেত্রে মাও সেতুং স্মর্তব্য : ‘মাছ যেমন পানিতে বিচরণ করে বেঁচে থাকে, গেরিলারাও জনগণের মাঝে বিচরণ করে তেমনি টিকে থাকে।’
ইতোমধ্যে প্রায় ৭০ জনের মতো (মূলত বম জনগোষ্ঠীর) সন্দেহভাজন কেএনএফ সদস্য/ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীকে খুব ঠান্ডা মাথায়, ধৈর্য ধরে কাজ করতে হবে। এর জন্য পেশাদারত্বপূর্ণ মনোভাবের প্রয়োজন। কেএনএফের কয়েকজন নারী সদস্যকে অপরাধের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শান্তিবাহিনীতে কোনো নারী সদস্য ছিল না। পাহাড়ের সংঘাতে এটি নতুন বাস্তবতা। নারীদের বিষয়গুলো বিশেষ সতর্কতা ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে দেখা প্রয়োজন। কেএনএফের অস্ত্রধারীদের যেমন শাস্তি দিতে হবে, তেমনি নিরাপরাধ ব্যক্তিদের রক্ষা করতে হবে। চলমান অভিযানে নিরীহ কেউ যেন হেনস্তা না হয়। এই ধরনের পরিবেশে শত্রুতাবশত ভুল তথ্য দিয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিকে ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনাও কিন্তু ঘটতে পারে। এটি নিছক অস্ত্র উদ্ধার অভিযান নয়। এটি বিশেষায়িত যুদ্ধ কৌশল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ ধরনের কৌশলে প্রশিক্ষণ ও দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে।
পাহাড়ে যত নতুন বাস্তবতা
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের রাজনৈতিক ও যুদ্ধের বাস্তবতা বদলে গেছে। সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীকে সেই বাস্তবতা মাথায় রেখেই কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। পাহাড়ে যাতায়াত ব্যবস্থা, মিডিয়ার বিস্তার, মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা, নতুন অস্ত্র ও প্রযুক্তি, নারী ইস্যু, পাহাড়ের মানুষের মনস্তত্ত্ব, নিরাপত্তা বাহিনীর মনস্তত্ত্ব ও সমানুপাতিক শক্তির ব্যবহার ইত্যাদি ফ্যাক্টর বিবেচনা করা দরকার। অভিযানিক ক্ষেত্রে এসবের প্রতিফলনও প্রয়োজন।
বম সম্প্রদায়ের ক্ষোভ দুঃখ ও কষ্টের সন্ধানে
আটককৃত সন্দেহভাজন কেএনএফ সদস্যদের অপরাধের সঙ্গে সঙ্গে তাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার মোটিভেশন, বা উদ্বুদ্ধকরণ এর বিষয়টি জানা জরুরি। সংখ্যালঘু বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ, দুঃখ কষ্টের কথা সংখ্যাগরিষ্ঠরা অনেক সময় বুঝতেই পারে না।
বড়াদম ক্যাম্পটি রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদ/লেকের একদম পাড়েই অবস্থিত ছিল। চারদিকে পাহাড় ও হ্রদের কি অপরূপ দৃশ্যাবলি। একদিকে অরণ্য শোভিত রামের পাহাড়, সীতার পাহাড়। অন্যদিকে কালা পাহাড়, বিলাইছড়ি পাহাড়, ফুরোমন পাহাড়…। তখন আমি (১৯৮৫) একজন তরুণ সেকেন্ড লেফটেন্ট্যান্ট। অবসর সময়ে মাঝেমধ্যে কাপ্তাই হ্রদে স্পিড বোটে বেড়াতাম। বয়সের কারণে তখন বুঝিনি, এই কাপ্তাই হ্রদের জলে হাজার হাজার বাঁধভাসি মানুষের চোখের জল মিশে আছে।
বম সম্প্রদায়ের (জনসংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার) মানুষের ক্ষোভ ও দুঃখের বিষয়গুলো জানা জরুরি। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এভাবে অস্ত্র তোলার মতো কী কী সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণ/মোটিভেশন রয়েছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা ও বোঝা দরকার। বিদেশের কোনো শক্তি তাদের মদদ দিচ্ছে কি না এবং তারা অজান্তে কারও ‘প্রক্সি’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না তাও গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।
সংঘাত বড় নয় তবুও সতর্কতা
বর্তমান কনফ্লিক্ট বা সংঘাতটি খুব বড় নয়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি/শান্তিবাহিনী অত্যন্ত শক্তিশালী ও সুসংগঠিত সামরিক- রাজনৈতিক দল ছিল। বাংলাদেশ তখন (১৯৭৬) মাত্র চার বছরের একটি শিশু রাষ্ট্র। সেই অস্থির সময়ে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি শক্তিশালী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ধাক্কা সামাল দিয়েছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা নিরাপত্তা বাহিনী অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে সেই আন্দোলন মোকাবিলা করেছে। একজন তরুণ সেনা কর্মকর্তা হিসেবে এই নিবন্ধকার শান্তিবাহিনী- সংগঠিত ইন্সারজেন্সি (বিদ্রোহের) প্রায় বসন্তকালে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে ঘটনাগুলো দেখেছেন। বিশেষত ২ টি কারণে, মূলত বম জনগোষ্ঠী ভিত্তিক কেএনএফের এই আন্দোলন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার: খ্রিস্টান ধর্ম ও জো জাতীয়তাবাদ।
কেএনএফের আন্দোলনে ‘খ্রিস্টান’ ধর্মের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। বমসহ কুকি-চিনের ৬টি সম্প্রদায়ের অধিকাংশই ‘খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী’। কেএনএফ এই বিষয়টি ইস্যু করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের (বিশেষত পশ্চিমা জগৎ) দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করবে। ইতোপূর্বে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে নিহত কেএনএফ সদস্যদের ‘খ্রিস্টান’ বলে প্রচারণা চালানো হয়েছে। কুকি-চিন-মিজো সমাজের ছোট একটি অংশ নিজেদের ‘বেনে মেনাশে’ নামে ইহুদি ঐতিহ্যের হারিয়ে যাওয়া একটি গোত্র হিসেবে মনে করে।
কেএনএফের বর্তমান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিঃসন্দেহে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। কেএনএফের এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হিসেবে প্রচারণা করার জন্য দেশে ও বিদেশে অনেক কুচক্রীমহল হয়ত উদগ্রীব। এটাকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেয়া উচিত না। বর্তমানে এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্বসহ ‘‘কুপল্যান্ড প্ল্যান’’ ও ‘‘বৃহত্তর খ্রিষ্টান রাষ্ট্র’’-আলোচনায় আছে।
মাউন্ট ভিক্টোরিয়ায় ফুটেছে অপরূপ রডোডেনড্রন ফুল:
কুকি, চিন ও মিজোরা নিজেদের একই এথনিসিটি, একই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মানুষ বলে মনে করে। নৃতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা ওই জাতি গোষ্ঠীগুলোকে একত্রে ‘জো’ বলে অভিহিত করে থাকেন। এই নৃ-তাত্বিক সংযোগ ও মিলের জন্য মনিপুর, মিজোরাম ও চিন রাজ্যের ঘটনা প্রবাহ পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রভাবিত করতে পারে। জো’দের পারস্পরিক বন্ধনকে বিবেচনায় রাখা দরকার। কেএনএফ এর আকস্মিক উত্থানের পেছনে কেএনএফের দূর দূরান্তে থাকা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর অনুপ্রেরণা ও সহানুভূতি কতখানি আছে, তা জানা জরুরি।। আঞ্চলিক বাস্তবতা বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্শ্ববর্তী চিন, মিজোরাম, ত্রিপুরা, মনিপুর, রাজ্যের রাজনৈতিক ঘটনাবলি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে জো জাতীয়তাবাদের ঢেউ ও চঞ্চলতা বোঝা প্রয়োজন।
২০২২ এর জানুয়ারিতে চিন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চিনের এথনিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তীব্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময়ে বাংলাদেশে এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে একটি পত্রিকায় লিখেছিলাম ‘‘মাউন্ট ভিক্টোরিয়ার পার্কে এখন অপরূপ রডোডেনড্রন ফুল ফোটার সময়। কিন্তু এই সময়ে চিন পুড়ছে হিংসার আগুনে। এ আগুন এখন সীমান্তের এপারে থানচি, রুমা, মোদক জনপদের গায়ে লাগারও উপক্রম” (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২১ জানুয়ারি ২০২২)। মিজোরাম, চিন ও কাচিন রাজ্যের বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণের কথা কেএনএফ স্বীকার ও প্রচার করেছে। বিষয়গুলো নিশ্চিত করা দরকার।
পাহাড়ের ওপারে পৃথিবীতে…
কেএনএফের বিরুদ্ধে পরিচালিত যৌথ অভিযানের সময়, বিশেষত ২০২২ এর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বান্দরবান জেলা থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কয়েকশো ব্যক্তি (অধিকাংশ বম সম্প্রদায়ের) পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। পরবর্তীতে কেউ কেউ ফেরত এসেছে। আবার নতুন করেও কিছু ব্যক্তি ওপারে গেছে- এমন আলোচনা আছে।
উল্লেখ্য, নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান ও গ্রেফতারের অজুহাতে কেএনএফ- নেতৃত্ব বম সম্প্রদায়ের মানুষকে সীমান্তের ওপারে বা গ্রাঁম ছেড়ে যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করতে পারে। অতীতে নেতৃস্থানীয় কিছু ব্যক্তি ও আঞ্চলিক দলের প্ররোচনায় এমন দুঃখজনক ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশ কয়েকবার ঘটেছে। বম অধ্যুষিত অনেক গ্রামের মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। তারা কেএনএফ এর প্রচারণা ও হুমকিরও শিকার হতে পারে। এ বিষয়ে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করা প্রয়োজন।
বর্তমান সংঘাতময় পরিস্থিতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: কেএনএফের মিডিয়া (গণমাধ্যম) ও প্রযুক্তির ব্যবহার। পাহাড়ে কেএনএফই প্রথম আঞ্চলিক দল, যারা সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল। পরবর্তীতে তারা সোশাল মিডিয়ায় ঘোষণার মাধ্যমে নিরাপত্তা বাহিনীকে আক্রমণ করেছে। কেএনএফ সরকারের বিরুদ্ধে এক ধরনের “তথ্য যুদ্ধ” বা “ইনফরমেশন ওয়ার” চালিয়ে যাচ্ছে। কেএনএফ মিডিয়া ব্যবহার করে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে পারে। এ বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া এতই ব্যাপ্ত যে, কোন এলাকায় একটি ক্ষুদ্র ঘটনা ঘটলেও তা তৎক্ষণাৎ বিশ্বের নজঁরে চলে আসে।
পাহাড়ে গোয়েন্দা সংবাদ:
এই ধরনের অভিযানে নিরাপত্তা বাহিনীর গোয়েন্দা কার্যক্রম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত ২-৫ এপ্রিলে সংঘটিত ব্যাংক ডাকাতি, অপহরণ, অস্ত্র লুট ও থানায় গুলি বর্ষণের ঘটনায় পাহাড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর গোয়েন্দা কার্যক্রমকে দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কেএনএফের কতগুলো বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জানতে হবে— আন্দোলনের মোটিভেশন, অর্থের সরবরাহ, রিক্রুটমেন্ট, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, গোলাবারুদের উৎস, প্রযুক্তি আইইডি সংক্রান্ত তথ্য, নেতৃত্ব ও বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ।
এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের প্রয়োজন পরিকল্পিত বহুমুখী কৌশল। পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যা কিন্তু রাজনৈতিক। এর সামরিক সমাধান কাম্য নয়। তবে বর্তমানে কেএনএফ এর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যে স্তরে পৌঁছেছে, তা দমনের জন্য সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। আশা করি, পেশাদারিত্ব, উপযুক্ত রণকৌশল, অস্ত্র সরঞ্জামাদি, সমানুপাতিক শক্তির প্রয়োগ, একই সঙ্গে স্মার্ট, তেজোদীপ্ত ও মানবিক বোধ সম্বলিত অভিযানের মাধ্যমে বান্দরবানে শান্তি ফিরে আসবে।
সংঘাত নয়, তৈরি হোক সম্প্রীতির সুবর্ণ সেতু:
অচিরেই বন্ধ হোক এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভ্রাতৃ-যুদ্ধ। এখানে ‘আমরা’, ‘অন্যরা’ বলে কিছু নেই। সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে শান্তির পথে ফিরে আসুক “কেএনএফ” ও এর সামরিক শাখা “কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি” (কেএনএ) এর তরুণরা। বারুদ মাখা রণাঙ্গন নয়, কেএনএফ নেতৃবৃন্দ গণতান্ত্রিক উপায়ে কথা বলুক, আলোচনার টেবিলে। সংঘাত নয় পাহাড়ে তৈরি হোক সম্প্রীতির সুবর্ণ সেতু। বাড়ুক পারস্পরিক আস্থা। পার্বত্য চট্টগ্রামে বমসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষা বোঝা ও সম্মান করার প্রচেষ্টা টেকসই শান্তি নিশ্চিত করতে পারে।
সবাইকে নিয়ে আমরা হাঁটবো শান্ত পাহাড়ে:
পাহাড়ের প্রান্তিক মানুষদের আন্তরিকভাবে কাছে টানতে হবে। রাষ্ট্রকে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতেই হবে। কুকি-চিন গোষ্ঠীর প্রকৃত সমস্যার কথা আমাদের অবশ্যই জানতে ও শুনতে হবে। এর বাস্তবিক সমাধানও প্রয়োজন। এদিকে শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বাস্তবায়নের বাঁধাগুলো ও বিতর্কিত হয়ে যাওয়া ইস্যু ও অনুচ্ছেদগুলো নির্মোহভাবে দেখা দরকার। তবে এর গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবিক সমাধানও দ্রুত করা প্রয়োজন। শান্তিচুক্তির (১৯৯৭) পর অর্থাৎ পাহাড়ে সংঘাত-পরবর্তী পরিস্থিতির ব্যবস্থাপনা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা প্রয়োজন। বিলম্ব হলেও এক্ষেত্রে অ্যাকাডেমিক উদ্যোগ স্বাগত জানানো উচিত।
একই সঙ্গে পাহাড়ের নিরাপত্তা যেন বিঘ্নিত না হয় তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। কেএনএফ ছাড়াও পাহাড়ে আরো ৪/৫ টি সশস্ত্র আঞ্চলিক দল/গ্রুপ/গোষ্ঠী রয়েছে। এই আঞ্চলিক সশস্ত্র দলগুলো বিভিন্ন সময়ে নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ-সংঘাত ও আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে একের পর এক আত্মঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে থাকে। এইসব বিষয়েও সরকারের নজঁর দেয়া প্রয়োজন।
বহুত্ববাদ, সম্প্রীতি ও সহনশীলতাই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের আত্মা। উদার বাংলাদেশের বিপুল বৈচিত্র্যকে মধ্যেই আমাদের সকল সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠি ও জনজাতির সুরভিত ফুল ফুটবে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে, সবাইকে সমমর্যাদায় অভিষিক্ত করেই আমরা একত্রে হাঁটবো শান্ত সবুজ পাহাড়ে।
মো. বায়েজিদ সরোয়ার: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক।
সূত্র: কালবেলা।