ইউপিডিএফ খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটির বিভিন্ন স্থানে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে, জনজীবনে ঘটছে ব্যাঘাত!

0

তৌফিক বিনা, বিশেষ প্রতিনিধি পার্বত্য চট্টগ্রাম:

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা যে কোন গোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক দাবিদাওয়া শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কিংবা গণতান্ত্রিক উপায় অথবা কূটনীতিক মাধ্যমে অর্জন করা সবচেয়ে ভালো গ্রহণযোগ্য পথ। পৃথিবীর ইতিহাসে দাবিদাওয়া আদায়ে এই নজীরটি সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য। এর বিকল্পভাবে দাবিদাওয়া আদায় কারোরই জন্য মঙ্গল হতে পারেনা। আমরা এটাই ইতিহাস থেকে শিক্ষা পেয়ে থাকি।

সেনাবাহিনীকে জিম্মি ও অপদস্ত করার ভিডিও

পাহাড়ের উপজাতি জনগোষ্ঠীর দাবিদাওয়া সরকার ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে পূরণ করেছে। তারপরও যদি তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবিদাওয়া বাদ থেকে থাকে তা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সরকারের কাছে উত্থাপন করা যেতে পারে। এরপরও যদি আদায় না হয় তখন ভিন্ন পদক্ষেপ তো আছেই। দুঃখজনক ইউপিডিএফ অধিকার বিষয়ক দাবিদাওয়াগুলো শান্তিপূর্ণ উপায়ে উত্থাপন না করে সশস্ত্র সংগ্রাম, অরাজকতা ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আদায় করার চেষ্টা করছে। আজকে পাহাড় জুড়ে ইউপিডিএফ যে, তান্ডবলীলা, নৈরাজ্য ও জনজীবনে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এটি কোন শান্তিকামী সংগঠনের কাজ হতে পারেনা। এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইউপিডিএফ জানান দিচ্ছে তারা পাহাড়ে শান্তি চায়না। তারা চায় পাহাড়ে অরাজকতা। তারা যে সন্ত্রাসবাদ লালন করে এবং সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে সেটি আজকে কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জানান দিয়েছে।

প্রশ্ন আসতে পারে কারা এই ইউপিডিএফ।-
১৯৯৭ সালের সরকার ও জেএসএস মধ্যকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধিতা করে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় এক সম্মেলনের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন দাবিতে আত্মপ্রকাশ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ প্রসিত)। সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস)-এর তৎকালীন সহযোগী অঙ্গসংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসা। খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি তার বাড়ি। তার নেতৃত্বে চুক্তির ১ বছর পর ইউপিডিএফ এর জন্ম হয়। প্রতিষ্ঠা লাভ করার পর থেকে পাহাড়ে একের পর এক দেশ বিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে সংগঠনটি। বর্তমানে ইউপিডিএফ পাহাড়ে এক মূর্তিমান আতঙ্ক আর অরাজকতার ভয়ানক নাম।

আজকে ইউপিডিএফ নিয়ে কথা বলার প্রধানতম কারণটি হলো- অদ্য বুধবার (১৫ মে) ভোর সকাল থেকে শুরু হওয়া আধাবেলা অবরোধ পালন করতে গিয়ে নাশকতামূলক তৎপরতা চালায় ইউপিডিএফ প্রসিত মূলদল সহযোগী অঙ্গসংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন।

আমরা বিভিন্ন সময় ইউপিডিএফ এর চাঁদাবাজি, অপহরণ ও খুন-গুম এবং রাষ্ট্র বিরোধী তৎপরতা নিয়ে কথা বলে থাকি। কিন্তু তার বাস্তবিক অর্থে প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হই কারণে অকারণে। পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে ইউপিডিএফ এর আজকের নৈরাজ্য সৃষ্টির চিত্র হয়তো কিছুটা হলেও প্রমাণ হতে পারে। বিষয়টি তুলে ধরার প্রধানতম কারণ, ইউপিডিএফ উদ্দেশ্য প্রণোদীতভাবে অবরোধের নামে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর তাদের মদদপুষ্ট নারী লেলিয়ে দিয়ে তার ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে জনমনে নেতিবাচক প্রভাব তৈরির একটি ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেসাথে সাধারণ মানুষদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। তাই তাদের কিছু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সকলের জ্ঞাতার্থে তুলেধরা অতি জরুরী।

ইউপিডিএফ সম্পর্কে প্রাথমিক অবস্থায় আমরা যা জানতি পারি- বিচ্ছিন্নতাবাদী ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়াতে আতঙ্কিত পাহাড়ি- বাঙ্গালীরা। ইউপিডিএফ কেএনএফ এর মত দেশবিরোধী একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলা সশস্ত্র সংগঠন৷ তারা পূর্বে পাহাড়ে অনেক বাঙ্গালী ও নিরাপত্তা বাহিনীরসহ অগণিত মানুষ হত্যা, অপহরণ ও খুন-খারাবির সঙ্গে জড়িত। তাদের চাঁদাবাজি ও অপহরণ বাণিজ্যে অতিষ্ঠ পার্বত্যবাসী। ২০০১ সালে তারা নানিয়ারচর থেকে তিন বিদেশী নাগরিককে অপহরণ করে ৩ কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে মুক্তিপণ হিসেবে। যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে। এছাড়াও পাহাড়ে ইউপিডিএফ এর বিরুদ্ধে পাহাড় সমান অভিযোগ। স্বায়ত্তশাসনের দাবির অন্তরালের আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য ইউপিডিএফ পাহাড়ে বিপুল পরিমাণ ভারী অস্ত্র মজুদ করছে৷ ত্রিদেশীয় সীমান্ত ব্যবহার করে ইউপিডিএফ অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে তাদের রয়েছে কয়েক হাজার সশস্ত্র এবং রাজনৈতিক সদস্য।

আজকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অন্যতম কারণ- পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় আইন অকার্যকর করার দাবিতে গত ১৩ মে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জনসমাবেশ পালন করে ইউপিডিএফ; জনসমাবেশ থেকে তারা ১৫ মে অবরোধের ডাক দেয়। আজকে তারা অবরোধের নামে সড়কে প্রতিবান্ধকতা, নৈরাজ্য সৃষ্টি এবং নিরাপত্তা বাহিনীর উপর নারীদের লেলিয়ে দিয়েছে। তার কিছু বাস্তব চিত্র-

রাঙামাটির ভেদভেদি, সাপছড়ি, কতুকছড়ি, নানিয়ারচর, কাউখালী ও বাঘাইছড়ির সাজেক এবং খাগড়াছড়ি মহালছড়ি, রামগড়, মাটিরাঙ্গা, দীঘিনালা,গুইমারা, লক্ষ্মীছড়ি ও পানছড়ি এক যুগে সড়কে আগুন জ্বালিয়ে ও গাছের গুঁড়ি ফেলে প্রতিবান্ধকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে।

বেলা বাড়তে বাড়তে ইউপিডিএফ সড়কে নৈরাজ্য, প্রতিবান্ধকতা ও যানবাহন ভাংচুরে লিপ্ত হয়। বেশ কয়েকটি স্থানে ভাংচুর ও চোরাগোপ্তভাবে হামলা চালায়।

মানিকছড়িতে একটি মোটরসাইকেল ভাংচুর করে। ওত পেতে থাকে বড় ধরনের নাশকতা সৃষ্টি করার। নাশকতা সৃষ্টির মাধ্যমে পার্বত্য পরিস্থিতিকে অশান্ত করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করে। তাই ইউপিডিএফ এর নাশকতা এড়াতে মানিকছড়িতে কয়েকটি স্থানে পুলিশ যানবাহন বন্ধ করে দেয়।

স্থানীয়রা জানিয়েছে, রামগড় সড়কে দুই শতাধিক যানবাহন আটক করে সড়কে প্রতিবান্ধকতা তৈরি করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে। এতে জনজীবনে ঘটছে ব্যাঘাত। এসময় তীব্র তাপদাহে শতশত যাত্রী, স্কুল, কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হয়।

মহালছড়ির চম্পাঘাটে স্কয়ার কোম্পানির ডেলিভারি ভ্যান পুড়িয়ে দিয়েছে ইউপিডিএফ। শত আকুতি মিনতি করার পরও ভ্যানটি পণ্যসহ পুড়িয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা।

আজ বুধবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলা ইউপিডিএফের আধাবেলা সড়ক অবরোধে খাগড়াছড়ি সদরের চম্পাঘাট/আকবাড়ি এলাকায় একটি যাত্রীবাহী ও একটি মালবাহী অটোরিকশা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসময় ইউপিডিএফ কর্তৃক চালকরা মারধর শিকার হন বলে জানা গেছে।আজ বুধবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলা ইউপিডিএফের আধাবেলা সড়ক অবরোধে খাগড়াছড়ি সদরের চম্পাঘাট/আকবাড়ি এলাকায় একটি যাত্রীবাহী ও একটি মালবাহী অটোরিকশা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসময় ইউপিডিএফ কর্তৃক চালকরা মারধর শিকার হন বলে জানা গেছে।

এদিকে মারিশ্যা দীঘিনালা রোড ১০ নম্বর ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও উগ্রবাদী উপজাতি ভয়ঙ্কর নারীদের প্রলব্ধ করে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। এসময় সরকারি মালামাল নিয়ে যাতায়াতরত সেনাসদস্যের গাড়ি আটক করে বড় ধরনের ফাঁদ পেতে ইউপিডিএফ নারীরা। বিশ্বব্যাপী মানবতা, মানবাধিকার এবং পাহাড়ে শান্তি স্থাপনে কাজ করা সেনাসদস্যরা ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এবং নারীদের উপর আক্রমণ ছাড়া এই ষড়যন্ত্র ও পাতানো ফাঁদ প্রতিহত করতে সক্ষম হন।

বাঘাইছড়ি সাজেক উজো বাজারসহ আশেপাশের এলাকায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা আইন- শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি নাশকতামূলক পরিস্থিতি মোকাবেলা করে। সেনাবাহিনীর এই সাহসীকতা ও ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার বিষয়টিকে সাধুবাদ জানিয়েছে স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙ্গালী।

রাঙ্গামাটি সদরের সাপছড়ি, কতুকছড়ি, নানিয়ারচর ঘিলাছড়ি ও কাউখালী বেতবুনিয়া ইউপিডিএফ সহযোগী অঙ্গসংগঠন সবধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে সড়কে অবস্থান নেয়৷ এসময় সড়কে তারা বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করে। স্থানীয় জনসাধারণ এগিয়ে এতে তাদের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে।

শাসনবিধি কী কেন ইউপিডিএফ এর আন্দোলন বা অবরোধ?

ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকরা পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০’ জারি করেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে ১৯০০ সালের ১ মে থেকে এই শাসনবিধি কার্যকর হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্যাঞ্চলে রাষ্ট্রীয় প্রচলিত আইন অকার্যকর। দেশের সাংবিধানিক বিধিবিধান তোয়াক্কা না করে চলছে এই তথাকথিত শাসনবিধি বা মৃত আইন। এই কারণেই একই দেশে দুইটি আইন বিদ্যমান।

ব্রিটিশ কর্তৃক প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি বা পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন (চিটাগং হিল ট্র্যাক্ট ম্যানুয়েল ১৯০০) কে আইন হিসেবে ২০১৪ ও ২০১৬ সালে পৃথক দুই মামলার রায় দেয় সুপ্রীম কোর্টের পুর্ণ বেঞ্চ। hbf এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালে রাঙামাটি ফুডস প্রোডাক্ট লি. এক মামলায় হাইকোর্ট বেঞ্চ পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি কে ডেট ল বা অকার্যকর আইন বলে রায় দেয়। এ রায়ের ফলে ১৯৯৭ সালের ২-রা ডিসেম্বরের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অংশ পার্বত্য জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদসহ এবং শাসনবিধির সৃষ্ট প্রথাগত প্রতিষ্ঠানসমূহ সংকটের মুখে পড়েছিল।
এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা হলে সুপ্রীমকোর্ট ২০১৬ সালে ২২ নভেম্বর শাসনবিধিকে একটি কার্যকর ও বৈধ আইন বলে রায় দেয়।
অন্যদিকে সুপ্রীম কোর্ট বিচারধীন ওয়াগ্গা ছড়া টি স্টেট অপর এক মামলার ২০১৪ সালে ২ ডিসেম্বর রায় দেয়।
দুটি রায়ই শাসনবিধিকে কার্যকর বলে রায় দেয়।

উপরোক্ত এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে সুপ্রীম কোর্টে রিভিউ করেছেন বাঙ্গালীদের পক্ষে খাগড়াছড়ি জেলার বাসিন্দা আব্দুল আজিজ আখন্দ ও আব্দুল মালেক। একাধিক আপিল শুনানির পর পরবর্তীতে রায়টি উচ্চ আদালত বাতিল করে মৃত আইন হিসেবে রায় দেয়। এই শাসনবিধি মৃত আইন হিসেবে রায়টি পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় শক্তিকে মজবুত করে। শাসনবিধি কে আইন হিসেবে বলবৎ করার জন্য আঞ্চলিক দলগুলো সম্প্রতি বিশেষ তৎপর হয়ে উঠেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় উপজাতি হেডম্যান-কার্বারী দিয়ে জনসমাগম করার মাধ্যমে রায়টি বলবৎ রাখার প্রচেষ্ঠা করছে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More