জয় দাশ, পার্বত্য চট্টগ্রাম: পার্বত্য চট্টগ্রামে জেএসএস সন্তু দাবি করে তারা নাকি পাহাড়ের জনগণের জন্য আন্দোলন করে। এমনকি তারা বলে পাহাড়ি সকল জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নাকি তারা করছে। আসলে কী জেএসএস সন্তু পাহাড়ে সকল জনগণের পাশে আছে? জনগণের জন্য তারা কাজ করে? বাস্তবতা কি বলে? অনেক গুলো প্রশ্ন সামনে চলে আসে, তাই পাঠকের সামনে জেএসএস সন্তু’র বাস্তবতা তুলে ধরা হলো।
পাহাড়ে শান্তির জন্য আজ থেকে ২৬ বছর আগে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে তৃতীয় কোন পক্ষ ছাড়াই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জেএসএস এর নেতা সন্তু লারমার পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। শান্তি চুক্তির পর ৭২ টি ধারা মধ্যে অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়ন করেছে সরকার, কিন্তু সন্তু লারমা শান্তি চুক্তির পর রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিলেও পাহাড়ে শান্তি আনার বদলে পর্দার আড়ালে অশান্তি সৃষ্টি করেই চলছে। এ যেন সর্ষের ভিতরে ভূতের গল্পের মতোই। দেশের ৬৪টি জেলায় সাধারন মানুষ তার ঘরে ঘুমালেও পাহাড়ে বসবাসকারী নিরীহ পাহাড়ি ও বাঙালিরা স্বাভাবিক ভাবে ঘুমাতে পারে না। সারাক্ষন আতঙ্কে থাকে কখন জানি সন্তু লারমার পোষা সন্ত্রাসীরা কাকে তুলে নিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে, মেয়েরা শঙ্কায় থাকে, কখন যে সে ধর্ষনের স্বীকার হয়, কেউ জানে না কখন যে কাকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ যেন অন্ধকার যুগকেও হার মানায়।
সন্তু লারমা- জেএসএস এর প্রধান। শান্তি চুক্তির সুফল ভোগ করে তিনি বর্তমানে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদাসম পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানও বটে। তিনি শান্তিবাহিনী নামক একটি সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দেন। উল্লেখ্য, সন্তু লারমার আপন বড় ভাই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তথা এমএন লারমা এই সশস্ত্র সংগঠনের সৃষ্টি করেছিলো। পরবর্তীতে, ক্ষমতালোভী সন্তু লারমা তার আপন ভাই এমএন লারমাকে হত্যা করে নিজেই পিসিজেএসএস’র প্রধান হিসেবে ক্ষমতা দখল করে এবং এই সন্তু লারমা সরকারের কাছ থেকে পাহাড়ে বসবাসকৃত নিরীহ পাহাড়ি ও বাঙালিদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য প্রতি বছর একটি বড় অঙ্কের বাজেট পেয়ে থাকে। কিন্তু বিগত সময়ে পাহাড়বাসী বন্যায় ভেসেছে এবং অনেক প্রাণ গিয়েছে পাহাড় ধ্বসে, অনেকেই হয়েছে গৃহহীন, খাদ্যহীন, বস্ত্রহীন। নিদারুণ কষ্টে জীবন যাপন করছিলো তারা। পাহাড়ে ঐ সময় গুলোতে যখন এরুপ ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে তখন জেএসএস এর প্রধান তথা আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা, জেএসএস সন্তু’র কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও সাবেক এমপি উষাতন তালুকদার, পার্বত্য নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন সদস্য কংজরী চৌধুরী,জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নিরুপা দেওয়ান ও স্বঘোষিত তথাকথিত রাজা দেবাশীষ রায় সহ পাহাড়ী আঞ্চলিক দলের শীর্ষ কোন নেতা থেকেই কোন রূপ সহযোগীতা ও ত্রাণ সহায়তা পান নাই পাহাড়ের কোন জনগণ। তখন সাধারণ পাহাড়ীরা প্রশ্ন তুলে বলেছিলো জুম্ম জাতির মুক্তির কথা বলে পাহাড়ি জনগনের কাছ থেকে জোর করে প্রতিবছর যে কোটিকোটি টাকা চাঁদাবাজি আর খাজনা আদায় করে সেই টাকা কোথায় যাচ্ছে? পাহাড়বাসীর বিগত দুর্দিনে কেন তারা এক কানাকড়িও সহায়তা দেয় নি? শান্তিবাহিনীর বোন বাসন্তী চাকমা তো ২০১৯ সালেও বন্যার সময় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে বন্যার্তদের জন্য অর্থ এনে অসহায় বন্যার্তদের পাশে না দাঁড়িয়ে, মানবতার ডাকে সাড়া না দিয়ে গত ১৫ই জুলাই বৈশাখী পূর্ণিমা উপলক্ষে খাগড়াছড়ি সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার ৫৬টি বৌদ্ধবিহারে ৭ লক্ষ ৭৩ হাজার টাকার অনুদানের চেক প্রদান করেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় অর্থ ব্যয় করলে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু বন্যার মতো ভয়াবহ দুর্যোগ চলাকালে একজন সংরক্ষিত সংসদ সদস্য কিভাবে ত্রাণ তহবিলের অর্থ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ব্যয় করেন? পাহাড়িদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্টার্জিত টাকাগুলো দেবাশীষ রায় খাজনা আদায়ের নামে লুটেপুটে খাচ্ছে। তিনিও তো তার প্রজাদের বিগতসময়ের কোন দুর্দিনে একটা পয়সাও দিলেন না।
এরা নাকি স্বপ্নের জুম্মল্যান্ড গঠনের জন্য, পাহাড়িদের অধিকার আদায়ের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করে যাচ্ছে। কিন্তু তাঁরা তো এক মুঠো চাউল নিয়েও অসহায় দুঃস্থদের মাঝে বিগত কোন দুর্যগের সময় সাহায্যের হাত বাড়ালো না। তাহলে তাঁরা পাহাড়ে কিসের অধিকার আদায়ের নামে আন্দোলন করে যাচ্ছে? ভাবতেই অবাক লাগছে সেইসময়ের দুর্দিনেও অসহায় ক্ষুধার্ত পাহাড়ের মানুষের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় নাই ঐ সব তথাকথিত পাহাড়ি নেতারা। সাহায্যের হাত বাড়াবে কিভাবে? তাঁরা তো ওই চাঁদার টাকা দিয়ে নিজের পরিবারসহ বিলাসবহুল অট্টালিকায় জীবন যাপন করছে। নিজের ছেলেমেয়েদেরকে বিদেশে পড়িয়ে করছে উচ্চ শিক্ষিত। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের বিরোধিতা করে পাহাড়ের সাধারণ মানুষগুলোকে বানিয়ে রাখতে চেয়েছে অশিক্ষিত করে। কারন অশিক্ষিত করে রাখলে সেই সব মানুষগুলোকে শাসন ও শোষণ করা তাদের জন্য সহজ। এভাবে অশিক্ষিত পাহাড়িরা ঐ সব ভন্ড নেতাদের অন্ধ বিশ্বাসের গোড়ে পরে বছরের পর বছর ত্যাগ করে যাচ্ছে তাদের ন্যায্য অধিকার। নিরীহ পাহাড়িদের অধিকার আদায়ের নামে ভন্ড নেতারা মিথ্যে অভিনয় করে যাচ্ছে, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে জনগণের সুখে-দুঃখে পাশে না থেকে জনগণকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জিম্মি করে রেখেছে। একদিকে জনগণকে জিম্মি করে রেখে, অন্যদিকে সকল সুবিধা নিজেরা ভোগ করছে,এতে করে নিজেদের আখের গুছিয়ে কায়েমী স্বার্থ কায়েম করেছে। যাতে করে নিজেরা অন্যায় ভাবে সকল সুবিধা ভোগ করলেও অন্যরা কেউ কিছু বলতে না পারে। মানুষ মানবিক কারণে হলেও জনগণের পাশে থাকে কিন্তু জেএসএস সন্তু’র নেতাদের কারণে পাহাড়ে আজ মানবতাই হারিয়ে যাচ্ছে। এতে করে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে জনগণের যে প্রয়োজনের প্রতিফলন তা ঘটে নাই। এর জন্য অন্যতম দায়ী হলো জেএসএস সন্তু।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে কেএনএফ, মগ পার্টি সহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আলাদা আলাদা সশস্ত্র দল তৈরী হচ্ছে এরও অন্যতম কারণ জেএসএস সন্তু ও আঞ্চলিক পরিষদ। কারণ জেএসএস সকল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে বলে দাবি করে বিগত সময়ে এমপি হয়েছে, বর্তমানে উপজেলা চেয়ারম্যান হচ্ছে, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হচ্ছে। অথচ আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারে বসে ও বিভিন্ন জনপ্রতিনিধির চেয়ারে বসে সরকারী বরাদ্দকৃত বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা সকল জনগোষ্ঠীর মাঝে সমানভাবে বন্টন না করে ও এলাকার রাস্তা ঘাট সহ কোন উন্নয়ন না করে সকল সুবিধা নিজেরাই ভোগ করে সম্পদশালী হচ্ছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও দেশের বাহিরে বাড়ী-গাড়ী করছে। এর ফলে সাধারণ পাহাড়ি জনগণ বঞ্চনার শিকার হয়ে অপরাধ মূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
বর্তমানে কেএনএফের প্রসঙ্গ যদি আসে তাহলে দেখা যায় কেএনএফ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান গ্রহণের পরপরই জেএসএস সন্তু’র সাথে নানাভাবে সম্পৃক্ত নেতৃত্ব কেএনএফের প্রতি সহানুভূতিশীল নানা পোস্ট দিতে শুরু করেছে। অথচ কেএনএফ বারবার তাদের অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার অন্যতম কারণ বঞ্চনা, শোষণ বলে দাবি করেছে। বলা বাহুল্য বাংলাদেশ সরকার বা বাঙালিরা পাহাড়ের প্রান্তিক ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীকে শোষণ ও বঞ্চিত করেনি। কেএনএফ বিভিন্ন সময় তাদের দাবি দাওয়ায় অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে তারা বলেছে, শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে ও সেখানকার ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার যে বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিয়েছে তা এককভাবে ভোগ করেছে জেএসএসের বর্তমান ও সাবেক নেতাকর্মী এবং তাদের পরিবারের সদস্যবৃন্দ। বিশেষ করে জেএসএসের সাথে জড়িত চাকমা সদস্যবৃন্দ ও তাদের পরিবারবর্গ। একই অভিযোগ মারমা ন্যাশনাল পার্টিসহ আরো অনেকের। পাহাড়ের বৃহৎ ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী যদি প্রান্তিক ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীদের এই শোষণ ও বঞ্চনার দিকে ঠেলে না দিতো তাহলে নাথান বমের হাতে আজ শিল্পীর তুলি থাকতো, আগ্নেয়াস্ত্র নয়। অথচ আজ তারাই কেএনএফের প্রতি কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করছে।
কেএনএফ যখন শোষণ ও বঞ্চনার অভিযোগ তুলে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল তখন কিন্তু এই জেএসএস সন্তু’র চাকমা নেতৃত্ব তাদের সাথে বসে যদি তাদের শোষণ-বঞ্চনার সুষ্ঠু বিধান দিতেন তাহলে আজকের দিনটি হয়তো তাদের দেখতে হতো না। কিন্তু সেটা তো তারা করেনইনি বরং রণকৌশল চাকমা নামক এক কোম্পানী কমাণ্ডারের নেতৃত্বে সেখানে বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেছিল কেএনএফকে নিধন করতে। কিন্তু রণকৌশল রণকৌশলে কেএনএফের কাছে ধরা খেয়ে গেলে উল্টো কমাণ্ডারসহ সবাই নিহত হয়। এরপর থেকে একেরপর এক জেএসএস কেএনএফকে নিধন করতে বিরতিহীন যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এতে দুইপক্ষেরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সাধারণ মানুষেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবুও জেএসএস বান্দরবানে তাদের হারানো নিয়ন্ত্রণ আর কখনোই ফিরে পায়নি। যুদ্ধে কেএনএফের সাথে এঁটে উঠতে না পেরে জেএসএস কেএনএফ নিরাপত্তা বাহিনীর সৃষ্টি বলে প্রচারণা চালানো শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে জেএসএস যখনই যার সাথে পেরে ওঠে না তখনই তার নামের সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট বলে ট্যাগ লাগায়। এটা তাদের চিরাচরিত স্বভাব।
এখন প্রশ্ন উঠছে জেএসএস সন্তু শান্তিচুক্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের মাধ্যমে যে সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে তা যদি সাধারণ সকল জাতিগোষ্ঠীর পাহাড়িদের মাঝে সমানভাবে বন্টন করতেন তাহলে আজকের কেএনএফ, মগ পার্টি জাতি ভিত্তিক এসব আলাদা আলাদা সশস্ত্র গ্রুপ সৃষ্টি হতো না।
তাই পাহাড়ের সচেতন মহল আজ সোচ্চার হয়েছে, জেএসএস সন্তু’র সুবিধাবাদি নেতাদের বিরুদ্ধে। এবং আহ্বান জানিয়ে বলছে, হে পাহাড়িবাসী জেএসএস সন্তু গ্রুপের জুম্ম জাতির অধিকার আদায়ের নামে এতসব ভন্ডামি দেখার পরও কি তোমাদের ঘুম ভাঙবে না? এবার তোমরা জাগো এবং এই সব ভন্ড, মুখোশধারী, সুবিধাবাদী আর স্বার্থপর নেতাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হও। তা নাহলে সারাজীবন এভাবেই তাদের মায়াজালে আটকে নিঃস্ব হয়ে যেতে হবে আর অকালে প্রাণ দিতে হবে জেএসএস সন্তু’র সন্ত্রাসীদের হাতে।