হিলনিউজবিডি:
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ঠিক ১১ বছর পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের এক নির্মম ও নৃশংস অধ্যায়, লংগদুর রাজনগর গণহত্যা। ১৯৮৬ সালের ৪ জুন ভোররাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সামরিক শাখা তথাকথিত ‘শান্তিবাহিনী’ অতর্কিতে হামলা চালায় নিরস্ত্র বাঙালি নারী, পুরুষ ও শিশুদের ওপর।
সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনীর হায়েনারা গুলি করতে করতে রাজনগর গ্রামে ঢুকে পড়ে। এরপর অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেয় প্রায় ৫০টি বাঙালি পরিবারের ঘরবাড়ি। মুহূর্তেই নিস্তব্ধ পাহাড়ি জনপদে ছড়িয়ে পড়ে কান্না, আগুন ও ধ্বংসের বিভীষিকা। বহু মানুষ আহত হন, শারীরিক ও মানসিকভাবে বিকল হয়ে পড়েন অসংখ্য পরিবার।
স্থানীয়রা জানান, ৩ জুন রাতে সবাই যখন গভীর ঘুমে, তখন ৪ জুন ভোররাতে শান্তিবাহিনী অতর্কিতে হামলা চালিয়ে ১১ জন নিরীহ নারী, পুরুষ ও শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই গণহত্যায় নিহতদের নাম নিচে তুলে ধরা হলো:
১. মো. ওমর আলী (৪৫)
২. বেগম ওমর আলী (৩০)
৩. আব্দুল মালেক (৭), পিতা: ওমর আলী
৪. ফাতেমা বেগম (৪), পিতা: ওমর আলী
৫. মালেকা বানু (২৮), স্বামী: খৈয়র উদ্দিন
৬. নিলুফা আক্তার (১), পিতা: খৈয়র উদ্দিন
৭. এরশাদ আলী মুন্সী (৬৫), পিতা: নছরদ্দিন ফকির
৮. রেজিয়া খাতুন (২৫), স্বামী: হাফিজ উদ্দিন
৯. আজিজুল ইসলাম (১০), পিতা: হাফিজ উদ্দিন
১০. আলিমন বিবি (২৪), পিতা: আব্দুর রহমান
১১. জামেলা খাতুন (২২), স্বামী: সমর আলী
এই হৃদয়বিদারক গণহত্যার তিন যুগ পার হলেও আজও নিহত পরিবারের সদস্যরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত। তারা পায়নি কোনো ক্ষতিপূরণ, পায়নি আইনি সহায়তা কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। লংগদু উপজেলার গুলশাখালী ইউনিয়নের রাজনগরে আজও গণকবরে চিরনিদ্রায় শায়িত এসব শহীদদের কবর দেখতে পাওয়া যায়। কোনোদিন কিছু প্রতিবাদ দেখা গেলেও, গত কয়েক বছর ধরে এই ঘটনা চাপা পড়ে গেছে ইতিহাসের ধূলিসাৎ পৃষ্ঠায়।
স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, লংগদুতে আরও অন্তত দুটি বৃহৎ গণহত্যা সংঘটিত হওয়ায় রাজনগরের এই ভয়াবহ স্মৃতিটি অনেকটাই মানুষের মন থেকে মুছে গেছে। অথচ এই ঘটনায় একটি পরিবারের একাধিক সদস্য নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছেন। স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় রাজনগর জোন। তাদের প্রচেষ্টায় শহীদদের নামের তালিকা সংরক্ষিত হয়েছে কিছু অংশে।
এই গণহত্যায় জড়িত সন্তু লারমা ও তার নেতৃত্বাধীন সংগঠন জেএসএস আজও দায়মুক্ত থেকে পার্বত্য অঞ্চলে বাঙালি হত্যা, অপহরণ ও খুন-খারাবির ঘটনায় সক্রিয় রয়েছে। পাহাড়ে এই সন্ত্রাসীদের বিচার করার মতো কোনো কার্যকর কর্তৃপক্ষ নেই, অপ্রিয় হলেও সত্য যে, রাষ্ট্র এখনো নীরব দর্শকের ভূমিকায়।
প্রতিবছর ৪ জুন আসে আবার, আর নিহত পরিবারের সদস্যদের চোখে উঠে আসে অশ্রুজল, স্বজন হারানোর যন্ত্রণায় নিঃশব্দে কাঁদে পাহাড়ের বাঙালি জনপদ।