সীমান্ত সড়ক নির্মাণে পাহাড়ি জনপদে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।

0

অপূর্ব সাচিং, পার্বত্য চট্টগ্রাম

রাষ্ট্রের উন্নয়ন দর্শন মূলত রাষ্ট্রের জাতিরই উন্নয়ন দর্শন৷ সেই দর্শন দূর্গম পাহাড়ী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দর্শনে পরিণত করেছে সরকার। বাংলার এক দৃশ্যদন্দিত চোখ জুড়ানো স্বপনীল ভূস্বর্গ হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম।
অপার সম্ভাবনার এ ভূস্বর্গটি শান্তিচুক্তির সম্পাদনের পূর্বে ছিল অশান্ত দূর্গম প্রতিকূল এক ভয়ংকর জনপদ। এ অঞ্চল ঘিরে বাংলাদেশের কোন সরকার উন্নয়নের কাজ সম্পাদনে ব্যাপকহারে হিমসিম খেতে হতো। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য দক্ষতায় ১৯৯৭ সালে ২ রা ডিসেম্বর সম্পাদন হয় পার্বত্যচুক্তি। এর পর থেকেই পাল্টে যায় উন্নয়নের চিত্র। পার্বত্যচুক্তি সম্পাদনের পূর্বে পাহাড়ী জনপদে উন্নয়ন করা ছিল এক চ্যালেন্জিং বিষয় ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী জনপদে যখন আদিমযুগের মত পায়ে হেটে, বোট, নৌকা আর কলার ভেরালী দিয়ে চলতে হতো, পাহাড়ী দূর্গম এলাকাগুলোতে যখন শিক্ষার আলো ছড়ায়নি, বিভিন্ন দূর্গম অঞ্চলে যখন কোন শিক্ষার আলো পৌছায়নি। স্বাস্থ্য সেবা ছিল মানুষের জন্য এক অনিশ্চিত বিষয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য জনপদ ছিল চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রনে। এমন এক কালো অনিশ্চিত জীবনধারার বাস্তবিক অধ্যায়কে সামনে রেখে বর্তমান সরকার ২০১৯ সালে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ কাজের সূচনা করে। সীমান্ত সড়ককে ঘিরে মানুষ এখন নতুনভাবে স্বপ্ন বুনছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, তথ্য প্রযুক্তি, পর্যটন শিল্পের প্রসার এবং জীবনমানের ব্যাপক পরিবর্তনে সীমান্ত সড়কটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে প্রকল্পের  ৯৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ। দুর্গম হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে এক সময় পিছিয়ে পড়া অঞ্চল বলা হলেও বর্তমান সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নবযুগের সূচনা হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে সড়ক যোগাযোগে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে। সীমান্ত সড়কের নির্মাণের ফলে পাহাড়ি জনপদগুলোতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। পুরো সড়ক নির্মাণ শেষ হলে ভারত-বাংলাদেশের যোগাযোগে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের যেমন প্রসার ঘটবে, তেমনি যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। সীমান্ত সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ১০৩৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে একনেকে ৩১৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ের কাজের মধ্যে ৯৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রকল্পটির আরও ১৩২ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল – জুন ২০২৪ এ অবশিষ্ট ৯০ কিলোমিটারের সম্পন্ন হবে বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
চলমান পাহাড়ের উন্নয়নের সমেস্যাকে নিরসন করার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে সরকার । যার অধিকাংশ অংশিদার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। যাদের মাধ্যমে অধিকাংশ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জনপদে। ১৯৭১–১৯৯৭ সাল পযর্ন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় শত কোটি টাকার উন্নয়ন করা হয়েছে যার অধিকাংশ ছিল সরকারি ভবন ও বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা। জনজীবনের উন্নয়ন করা ছিল কঠিণ ও বাধামুখী। অশান্ত ও সন্ত্রাসীর বেড়াজালে পাহাড়ি জনগদ ছিল আতংকের এক দৃষ্টান্ত। কিন্তু চুক্তি সম্পাদনের সাথে সাথে উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে উঠা পার্বত্য চট্টগ্রামের চিত্র দিন দিন পাল্টে বর্তমান তা এক ভূস্বর্গীয় রুপধারণ করেছে।
পার্বত্যচুক্তি সম্পাদনের পর থেকে উন্নয়নের জোয়ার দেখে পার্বত্যবাসী। যাতে ১৯৯৭-১৯৯৮ অর্থ বছরে ব্যয় বা বরাদ্দ করা করা হয় ৪৪.৯০ কোটি টাকা। যা ২০১৯-২০ অর্থ বছরে এসে দাড়িয়েছে ১১৯৪ কোটি টাকায়। এবং ২০২০-২১ অর্থ বছরের তা বৃদ্ধি পায় ১,২৩৫ কোটি টাকায়। ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে ১৯৯৪ কোটি টাকায় দাড়ায়। ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে তা আরো বেড়েছে। উন্নয়নের রোল মডেল পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী অগ্রনী ভূমিকা অতুলনীয়। আর এত পরিমাণ উন্নয়ন সাধন সম্ভব কেবল মাত্র সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়ার ফলে হয়েছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পার্বত্য চট্টগ্রামে যোগাযোগ মান বৃদ্ধির জন্য দিন দিন উন্নয়ন করা হচ্ছে রাস্তা কালভার্ড ও সেতু। যেখানে দেশ স্বাধীণতার ১৯৭১ সালের পর পাকা ও পিস ঢালাই রাস্তা ছিল মাত্র ৫০ কিঃমিঃ চলমান বছরে এসে তা দাড়িয়েছে প্রায় ১৬০০ কিঃমিটারে। দৃশ্যমান স্বপ্নের চেঙ্গি, নানিয়ারচর, মাইনী-গাঁথাছড়া, সহ প্রায় ছোট বড় শতশত সেতুর কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। সীমান্ত নিরাপত্তা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সূবর্নজয়ন্ত্রীতে উদ্ধোধনের মাধ্যমে যুক্ত হয়েছে ৩১৭ কিঃ মিটার দীর্ঘ সীমান্ত সড়ক। যা পাহাড়ের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে এক উন্নত শীর্ষে পৌছিয়েছে। শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে গড়ে তুলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, কারিগরি শিক্ষা, উচ্চবিদ্যালয়, মাদরাসা, প্রাথমিক, প্রাক প্রাথমিক,সহ এক হাজারের অধিক পাড়া কেন্দ্র। যা পাহাড়ী দূর্গম প্রতিকুল অঞ্চলে শিক্ষা প্রসারে এক অগ্রনী ভুমিকা পালন করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করছে। ২ শতাং শিক্ষার হার থেকে ৪৫.৫০ শতাংশে উন্নতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমান সরকারে ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজ নিজ ভাষায় এখন শিক্ষা লাভ করতে পারছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সম্প্রদায় শিক্ষার্থীরা। যা সংস্কৃতির এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনগণের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে গড়ে তুলা হয়েছে, মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। ২৮ সরকারি হাসপাতাল ও অসংখ্য কমিউনিটি ক্লিনিক । কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্যে ক্ষুদ্র কুটির শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা হয়েছে। সড়ক ও নৌ  পথের উন্নয়নের ফলে পাহাড়ে উৎপাদিত দ্রব্যাদি ও কৃষি পণ্য বানিজ্যিক রুপ অনেক বেশি চাহিদা বেড়েছে। যার কৃষক তাদের কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হচ্ছে। দূর্গম পাহাড়ী জনপদে বিদুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বিচ্ছিন্ন স্থানে সোলার বিতরণ করে আলোকিত করা হয়েছে। যোগাযোগ উন্নত স্থানে বিদুৎ সরবরাহের মাধ্যমে বিদুৎতায়িত করা হয়েছে, এবং হচ্ছে। শ্রমজীবি খেটে খাওয়া জনগণের জন্য বিশেষ সুদবিহীন কৃষিলোনের ব্যবস্থা করে তাদের স্বাবলম্বী করা হচ্ছে। কণর্ফুলী ও কাচালং সহ বিভিন্ন নদীতে মৎস পোনা অবমুক্ত করনের মাধ্যমে জেলেদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন ও জীবিকা অর্জনের মাধ্যমে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। দূর্গম পাহাড়ী জনপদে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতি সাধনে ২০০৮- ২০০৯ অর্থ বছরে মোবাইল নেটওয়াকের আওতায় আনা হয় পার্বত্য চট্টগ্রামকে। যা ‍পার্বত্য অঞ্চলকে উন্নয়নের এক উন্নত শিখরে পৌছাতে সহায়ক হয়ে উঠে। বিভিন্ন কর্মমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বেকার জনগোষ্ঠীকে কর্মমূখী করে গড়ে তুলা হচ্ছে। সংবিধানের ৮২ অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০’ প্রণয়ন করা হয়েছে ৷ যার আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। এই আইনের ৯ (ড) ধারায়, কালচারাল ট্যুরিজম ডেভেলপ করার জন্য বলা হয়েছে ৷ যার আদলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ট্যুরিজম অঞ্চল ঘোষণা করার অপেক্ষায় আছে। এবং দেশি বিদেশী পযর্টকদের জন্যে গড়ে তুলা হয়েছে রা্ঙ্গামাটিতে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্পিলওয়ে, কর্ণফুলী হ্রদ, পর্যটন মোটেল ও ঝুলন্ত সেতু, পলওয়ে, অরণ্যক, সুবলং ঝর্ণা, শুকনাছড়া ঝর্ণা, ধুপপানি ঝর্ণা, মুপ্পোছড়া ঝর্ণা, পেদা টিং টিং, টুকটুক ইকো ভিলেজ, রাইংখ্যং পুকুর, রাজবন বিহার, ঐতিহ্যবাহী চাকমা রাজার রাজবাড়ি, কর্ণফুলি পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, চিৎমরম বৌদ্ধ বিহার, সাজেক ভ্যালী, ন-কাবা ঝর্ণা, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র, কাট্টলীবিল, তিন টিলা বনবিহার, বৈচিত্র বিলাস, এগাত্তর, নানিয়ারচর বনবিহার, রবকল বনবিহার।
খাগড়াছড়ি জেলায়, আলুটিলা গুহা ও ঝর্ণা, রিছাং ঝর্না, দেবতা পুকুর, মহালছড়ি হ্রদ, পানছড়ি/শান্তিপুর অরণ্য কুটির, মানিকছড়ি মং রাজবাড়ি,মায়াবিনী লেক, কৃষি গভেষণা কেন্দ্র, পুলিশ লাইন, বিডিআর স্মৃতিসৌধ, রামগড় লেক ও চা বাগান ।
বান্দরবান জেলায়, বাকলাই ঝর্ণা, বগা লেক, বুদ্ধ ধাতু জাদি, চিম্বুক পাহাড় রেঞ্জ, চিনরি ঝিরি ঝরণা, ফাইপি ঝর্ণা, জাদিপাই ঝর্ণা, কেওকারাডং, মেঘলা পর্যটন কমপেস্নক্স, মিরিংজা পর্যটন, নাফাখুম, রেমাক্রি, নীলাচল, নীলগিরি, থানচি, পতংঝিরি ঝরণা, প্রান্তিক লেক, রাজবিহার, উজানিপারা বিহার, রিজুক ঝরণা, সাংগু নদী, শৈল প্রপাত, তাজিডং, উপবন ইত্যাদি পর্যটন গোটা পর্যটনের প্রসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম কে ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির একটা কেন্দ্র হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি লাভ করছে ৷ দুর্গম এ নৈস্বর্গীক মাতৃভূমিকে স্বর্গীয় রুপধারনে সরকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে পর্যটন শিল্পকে উন্নয়ন করে পার্বেত্য জনগোষ্ঠীর জীবন যাত্রার মান অনেক বৃদ্ধি করেছে। এর ফলে পাহাড়ে খেটে খাওয়া অনেক জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের চাকা রাতারাতি পাল্টে গিয়েছে । এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের দৃশ্যরুপ এখন স্বপ্নেরমত আশ্চার্যিত ভাবে উন্নতির শিখরে পৌছেছে। দৃশ্যমান পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান উন্নয়নকে অগ্রগতি ও বাস্তবায়িত করতে সরকার পরিপূর্ণভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দায়িত্ব দিয়ে কাজ সম্পন্ন করার জোর দাবী জানাই। এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে অনুরোধ জানাচ্ছি। যাদের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অনিরাপদ ও উন্নয়নের পথে বাধা হিসেবে কাজ  করছে।পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক অবাকময় উন্নয়নদৃশ্য যা বিশ্বের বুকে একটি নজির সৃষ্টি করেছে। এর সুফলভোগ করছে পাহাড়ি জনপদের সকল সম্প্রদায়।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More