নিজেস্ব প্রতিবেদক: পার্বত্য চট্টগ্রাম
পাহাড় বেষ্টিত তিন জেলাতেই বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা উপজাতি জাতিসত্তার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী দাবীদার অন্যতম চাকমা জনগোষ্ঠী। চাকমারা বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের সংখ্যা ৪ লাখ ৮৩ হাজার ২৯৯ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে শতকরা হিসাবে যা ২৯.২৯ শতাংশ। চাকমাদের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, সামাজিক অবস্থান, সংস্কৃতি, ধর্মীয় প্রভাব ও অর্থনৈতিক অবস্থা কিন্তু ব্যাপক। গত কয়েক দশকে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলায় বসবাসকারী চাকমা জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। অত্রাঞ্চলে চাকমাদের একক প্রাধান্য ও আধিপত্যে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোণঠাসা। এর ফলে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ, হতাশা ও চাকমা বিরোধী মনোভাব। বিগত বছর গুলোতে সশস্ত্র সৃষ্ট সংগঠনগুলো চাকমা নেতৃত্বের শাসন-শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেই কিন্তু গঠন হয়েছে।
চাকমাদের প্রভাব বিস্তার কীভাবে হয়েছে?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে। দেশের ৫০টি উপজাতি জাতিসত্তার ৫% কোটা সুবিধার ৭১ শতাংশ কোটা সুবিধা চাকমারা লুফে নিয়েছে। বিশেষ করে, শিক্ষা- চাকরি নিশ্চিত করেছে কোটা সুবিধার মাধ্যমে। যদিও আধুনিকতার ছোঁয়া অনেক অগ্রসর করেছে তাদেরকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে গড় স্বাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৮। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটির দুর্গম এলাকায় বসবাসরত চাকমা জনগোষ্ঠীর মানুষের গড় শিক্ষার হার ২০২২ সালে ছিল ৭৩ শতাংশ বর্তমানে প্রায় ৭৬ শতাংশের কাছাকাছি। যা সমতল জেলা থেকে অনেক ভালো বলা যায়।
গবেষক সুগত চাকমা রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ছিলেন। সুগত চাকমার গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত কয়েক দশকে চাকমাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এ জনগোষ্ঠীর লোকজন মূলত কৃষিজীবী হলেও সনাতন পদ্ধতি ছেড়ে এখন অনেকেই আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করছেন। বাড়ছে কলের লাঙলের ব্যবহার। প্রান্তিক এলাকাগুলোতে সীমিত পরিমাণে জুমচাষ হলেও এখন এর ওপর নির্ভরশীলতা কমেছে। পাহাড়ি এলাকায় ফলের বাগান করে আয় বাড়িয়েছেন অনেক কৃষক।
জেলায় চাকমাদের মধ্যে শিক্ষার হারও বেড়েছে। দেখা গেছে, কোনো কোনো চাকমা গ্রামের শতকরা ৪০ ভাগ লোক শিক্ষিত। আবার কোথাও এই হার এর দ্বিগুণ। শিক্ষিত চাকমাদের বিরাট অংশ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থায়, ব্যাংকে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা পদে চাকরি করছেন। কয়েক বছর আগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, খাগড়াছড়ি জেলার নয়টি কলেজে চাকমা জনগোষ্ঠীর ৭০ জন শিক্ষকতা করছেন। জেলায় সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে ৩০ জন চিকিৎসক কর্মরত আছেন। নয়টি ব্যাংকে ৬৮ জন চাকমা কর্মরত আছেন, যা মধ্যে ৪৬ জন পুরুষ ও ২২ জন নারী। এ ছাড়া ফল, কাঠ, মসলা ও ভোগ্যপণ্যের ব্যবসাও করছেন অনেকে। তবে শহরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত চাকমাদের মধ্যে আয় বৈষম্য বাড়ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে চাকমাদের শিক্ষার হার অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে এগিয়ে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের একক আধিপত্য বিস্তারে শক্তির উৎস কী?
চাকমাদের রয়েছে, এমপি, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান, চাকমা সার্কেল চীপ, হেডম্যান, কারবারী, বিসিএস ক্যাডার, কূটনীতিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবি ও তথাকথিত প্রথাগত আইন, এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী কয়েকটি সশস্ত্র গেরিলা সংগঠন। যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ, জাতিগত সংঘর্ষ, ভেদাভেদ, বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করার মাধ্যমে এ অঞ্চলকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ধাবিত করেছে। আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এত দল-উপদল সৃষ্টির পেছনে চাকমাদের একক আধিপত্যবাদ এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতিসত্তার মৌলিক অধিকার জোরপূর্বক ভোগ করার প্রেক্ষিতে হয়েছে। চাকমাদের অন্যান্য জাতির প্রতি বর্ণবাদ ও সহিংসতা আচরণ কিন্তু এ অঞ্চলের শান্তির পথে প্রধান বাধা সৃষ্টি হয়েছে।
চাকমারা পাহাড়ে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিতে কতটুকু আন্তরিক বা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ?
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ৯ টি মূল মানবাধিকার চুক্তির সমস্ত মানবাধিকার সমানভাবে ভোগ করে বলে বোঝা যায়। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকারের উপর জাতিসংঘের কাঠামোর মূল উপাদানগুলি, বিশেষ করে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসাবে অস্তিত্বের সুরক্ষা জড়িত; অ-বৈষম্য; তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্ম এবং ভাষার উপভোগ; সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং জনজীবনে কার্যকর অংশগ্রহণ; সিদ্ধান্ত গ্রহণে কার্যকর অংশগ্রহণ; তাদের নিজস্ব সমিতির রক্ষণাবেক্ষণ; এবং সীমান্ত জুড়ে যোগাযোগ এবং সম্পর্ক রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি।
এই প্রেক্ষাগৃহে পাহাড়ে সরকারি, বেসকারি ও দেশ-বিদেশী উন্নয়ন সংস্থা কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীভুক্ত ১৪টি জাতিসত্তার ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। গত (৬ জুন) অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেন।
বরাদ্দকৃত এই বিপুলপরিমাণ অর্থ যাবে কোথায়?
যদিও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিস্থিতির একটি বিশাল বৈচিত্র্য বিদ্যমান। সকলের কাছে সাধারণ এই সত্য যে, প্রায়শই চাকমা জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য ও আধিপত্যে বিভিন্ন ধরণের বৈষম্যের সম্মুখীন হয় তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, চাক, খিয়াং, খুমী, পাংখোয়া, বম ও লুসাই। যার ফলে প্রান্তিকতা এবং বর্জন হয়। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকমা ছাড়া অন্য অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব না থাকায় তারা পিছিয়ে গেছেন বলে দাবি করেছেন স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিরা। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সুযোগ-সুবিধা চাকমা জনগোষ্ঠী অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীদের মাঝে সমবন্টন না করার কারণেই মূলধারা থেকে পিছিয়ে পড়েছে।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কার্যকর অংশগ্রহণ অর্জন এবং তাদের বর্জনের অবসানের জন্য সরকারের চেয়েই চাকমা জনগোষ্ঠীকে মানবাধিকার মানগুলির প্রচার ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বৈচিত্র্যকে আলিঙ্গন করতে হবে। দিন শেষে এই আশা প্রত্যাশা আমরা সকলেই করলেও পক্ষান্তরে দেখা গেছে, পাহাড়ে অনেকগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠী চাকমাদের আধিপত্যবাদের কারণে কোণঠাসা। চাকমাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ঐতিহ্য রয়েছে। এইটার প্রতি রাষ্ট্রের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙ্গালীসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শ্রদ্ধাশীল এবং আন্তরিক। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। চাকমাদের মত অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি জাতিসত্তার নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ঐতিহ্য রয়েছে। এক্ষেত্রে চাকমারা অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিকার সম্পর্কে কতটুকু আন্তরিক কিংবা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা সমবন্টনের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ? তা নিয়ে বিবেচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। তার মধ্যে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।’
‘এখানে উপজাতি অনেক গুলো জাতিসত্তা এবং বাঙ্গালী হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ বড়ুয়া ও খ্রিস্টান- সবাই মিলেমিশে বসবাস। আমরা পাহাড়ি বাঙ্গালী সবাই ভাই ভাই, আমরা সবাই একসঙ্গে চলি, একসঙ্গে খাই, একসঙ্গে উৎসব পালন করি। এই সম্প্রীতির উদাহরণ দেশময় ও বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ুক এটাই প্রত্যাশা করি।’ কিন্তু পাহাড়ে যে বৈষম্য অনিয়ম ও অশান্তির দাবানলের সংবাদ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় অধিবাসী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি থেকে পাচ্ছি তা কিন্তু সত্যি দুঃখজনক এবং হতাশার।
পাহাড়ে বৈষম্যের চিত্র কতটুকু?
জন সংহতি সমিতি (জেএসএস) পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের নেতৃত্বদাতা হিসেবে ১৯৯৭ সনের ২-রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামক একটি চুক্তি সম্পাদিত করে। এই চুক্তিতে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতিসত্তার সকল অধিকার স্বীকৃতি দেয়৷ চুক্তির আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠি হয়। এরমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার পরিষদকে চুক্তির মাধ্যমে স্থানীয় শাসন-ব্যবস্থার চাবিকাঠি হাতে দেওয়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডকে চুক্তির আলোকে এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে অর্থের ভান্ডারে পরিণত করা হয়। যেহেতু চুক্তি পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষে চাকমা নেতৃত্বের জেএসএস৷ সেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের ন্যায অধিকার সমবন্টনের গুরুত্ব দায়িত্ব পরে চাকমা জনগোষ্ঠীর হাতে। এখন এই চাকমা জনগোষ্ঠী কতটুকু আন্তরিকতা এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধভাবে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জাতিসত্তার অধিকার নিশ্চিত করেছে তা আমরা তথ্যের আলোকে দেখব-
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য রেমলিয়ান পাংখোয়া দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, পাংখোয়া এখন দেশের বিলুপ্ত প্রায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। গত ৫০ বছরে পাংখোয়া সম্প্রদায়ের বিসিএস ক্যাডারে কোনো প্রতিনিধি নেই। তাহলে কী আমরা উচ্চ শিক্ষায় পিছিয়ে আছি? উচ্চ শিক্ষায় বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তো আমরা ভর্তির কোনো সুযোগ পাচ্ছি না। এ জন্য বিদ্যমান কোটাতে পাংখোয়াদের বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে।
একটি পরিসংখ্যান জেনে নেয়া যাক-
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ, ‘‘ রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ’’ নামে রুপান্তরিত হয়েছে।
৩৩ জন সদস্য এবং ১জন চেয়ারম্যান নিয়ে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হয়েছে। প্রত্যেক পরিষদে ২জন উপজাতীয় এবং ১জন অ-উপজাতীয়সহ মোট ৩ জন মহিলা সদস্যের পদ সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
১। চেয়ারম্যান (উপজাতী) = ১জন।
২। সদস্য সংখ্যাঃ
(ক) অ-উপজাতীয় =১০জন।
(খ) চাকমা =১০ জন।
(গ) মারমা =০৮জন।
(ঘ) তঞ্চঙ্গ্যা =০২জন।
(ঙ) ত্রিপুরা = ০১ জন।
(চ) লুসায় = ০১জন।
(ছ) পাংখো =০১জন।
(জ) খিয়াং = ০১জন।
(ঝ) উপজাতীয় মহিলা সংরক্ষিত = ০২ জন।
(ঞ) অ-উপজাতীয় মহিলা সংরক্ষিত = ০১ জন।
সর্বমোটঃ ৩৪জন।
উপজাতির জন্য সংরক্ষিত ২৪ জন সদস্যের মধ্যে চাকমা আর মারমা আছে ১৮ জন! অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীভুক্ত ১২টি জনগোষ্ঠীর জন্য মাত্র ৬ জন সদস্য! এখানে বৈষম্যের চিত্রটা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। প্রায় একই চিত্র খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদেও। আঞ্চলিক পরিষদের ২৩ সদস্যের মধ্যেও চাকমা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
বান্দরবানের সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমা, বিতর্কিত সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত। সে তার এক কলামে বলেন, বান্দরবানের ম্রো জনগোষ্ঠীর কথা ধরা যাক। পার্বত্য বান্দরবানে বসবাসরত ১১টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে তাঁরা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ। মারমাদের পরে তাঁদের স্থান। সরকারি পরিসংখ্যানে তাদের জনসংখ্যা প্রায় ৪২ হাজার। এই জনগোষ্ঠী থেকে কোনো বিসিএস কর্মকর্তা নেই। এমনকি বিসিএসের প্রাথমিক পরীক্ষায়ও যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। ম্রোদের মতো আরও ছয়টি জনগোষ্ঠীর একই অবস্থা। জনগোষ্ঠীগুলো হলো বম, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি, খিয়াং ও ত্রিপুরা। যদিও রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বিসিএস কর্মকর্তা রয়েছেন। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় বসবাসরত চাক জনগোষ্ঠীর একজন চিকিৎসক রয়েছেন। প্রায় তিন হাজার জনসংখ্যার জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিনি একমাত্র প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। বম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। এই পর্যন্ত কয়েকজন বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সোনার হরিণের ধারে-কাছেও যেতে পারেননি। সমতলের বিভিন্ন জেলায় ৩৯টি জনগোষ্ঠীর বসবাস। মণিপুরী, গারো, হাজং, সাঁওতাল ও রাজবংশী ছাড়া সম্ভবত অন্য জনগোষ্ঠী থেকে ক্যাডার সার্ভিসে কেউ আছেন কিনা জানা নেই।
তার এই অভিযোগ থেকে একটা স্পষ্ট যে পাহাড়ে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ব্যতীত অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ পিছিয়ে৷ এখন এই পিছিয়ে পড়ার দায়ভার কী একাকী সরকারের নাকী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী চাকমা জনগোষ্ঠী? ৫% উপজাতি কোটা ১৯৮৫ সাল থেকে বিদ্যমান থাকার পরেও একটি বিশেষ জাতি ছাড়া অন্য জাতিগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি?
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা,
বাঙ্গালী নেতা বশির লিডার কাছে পাহাড়ের বাঙ্গালীদের হালচাল জানতে চাইলে তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালীরা সর্বক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার। শিক্ষা, চাকরি ও নানাবিধ দিক থেকে অনগ্রসর জাতিতে পরিণত হয়েছে। গুচ্ছগ্রামের বন্দিশালায় সীমিত জায়গাতে বাঙ্গালীরা তিন দশক ধরে বন্দি। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা হামলার ভয়ে বাঙ্গালীরা নিজেদের ভূমিতে যেতে পারছে না। আমরা আমাদের জমিতে চাষাবাদ করতে পারিনা। সন্ত্রাসীরা সাধারণ পাহাড়িদের আমাদের বিরুদ্ধে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। পার্বত্য চুক্তির সুফল একটি জাতি ভোগ করলেও বাঙ্গালীরা বঞ্চিত হচ্ছে। বাঙ্গালীসহ অনেক জাতি বঞ্চিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম চলে। এই রাজত্ব কায়েম বন্ধে আমরা প্রশাসনের সহযোগিতা চাই।
সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের হালচাল বিভিন্ন বৈষম্য ও অনিয়মের বিষয়টি জানতে, সরকারি, আধা-সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং এনজিও ও উন্নয়নমূলক সংস্থার অফিসগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন দেখে এর স্বপক্ষে বাস্তব প্রমাণও মিলে। বরাদ্দ ও সুযোগ-সুবিধা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ছাড়া অন্য সম্প্রদায়ের জন্য লাভ করা এখানে কঠিন। চাকরিরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেশিভাগ চাকমা ও মারমা জনগোষ্ঠী থেকে। এখানে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ব্যতীত অন্যান্য জাতির লোক তেমন নেই৷ বিষয়টি যেমন বিস্ময়কর তেমনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র একটি জনগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।
স্থানীয় অধিবাসী, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ বলেন,
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এবং রাঙামাটি,খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী বাঙ্গালী মুসলমান, হিন্দু, বড়ুয়া এবং তনচঙ্গা, সাঁওতাল, অহমিয়া, গুর্খা, কুকি, পাংখোয়া, লুসাই (মিজু), চাক, খুমি, খিয়াং ও ম্রো জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা সংরক্ষণ হাতে গোনা। পার্বত্য চুক্তির ২৭ বছরেও চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির তুলনায় বর্ণিত জনগোষ্ঠীর লোকজন ২৭ বছরে অনেক বেশী পিছিয়ে পড়েছে। কেউ মানুক বা না মানুক এটাই সত্য কথা। পার্বত্যাঞ্চলের বসবাসরত অধিবাসীদের যে রাজনৈতিক অধিকার ছিল চুক্তির পর ২৭ বছরেও আদৌ তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছতে পারেনি তার মুল কারণ হচ্ছে: চাকমা নেতৃত্বের উগ্র সম্প্রদায়িকতা, বৈষম্য ও ক্ষমতার লোভ। চাকমাদের দেশান্তরিত যাযাবর ইতিহাস ও অকৃতজ্ঞর চরম পরিচয় লেখক আতিকুর রহমানের পার্বত্য তথ্য কোষের বিভিন্ন খণ্ডে বিবৃত হয়েছে।
পার্বত্যাঞ্চলে ৯০% রাষ্ট্রীয় সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন তিনটি জনগোষ্ঠীর লোকজন বাকি ১০% বাঙ্গালী মুসলিম, হিন্দু, বড়ুয়া ও তনচঙ্গা,সাঁওতাল, অহমিয়া, গুর্খা, কুকি, পাংখোয়া, লুসাই (মিজু), চাক, খুমি, খিয়াং ও ম্রো জনগোষ্ঠীর লোকজন। বিশাল ধরনের বৈষম্যে এ অঞ্চলে চলমান। যার কারণে সহজ-সরল জনগোষ্ঠীর লোকজন ছোট-ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে। আগামীতে আরো কয়েকটি জনগোষ্ঠীর লোকজন অস্ত্র হাতে তুলে নিবেনা তার কোন নিশ্চয়তা নাই। এখনো কী সময় হয়নি চাকমা জনগোষ্ঠীর অন্যান্য জাতিসত্তার অধিকার কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দেওয়ার?
স্বাধীকার বা নিজেদের অধিকারের জন্য নেংটি,ছেড়া লুঙ্গি আর গামছা পরে যাঁরা চাকমা সশস্ত্র সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন, বছরের পর বছর চোখ বাঁধা অবস্থায় মাটির গর্তে মৃত্যুর প্রহর গুনেছে, স্ত্রী,পুত্র, মা,বাবাকে রেখে জীবন,যৌবন কারাগারে কাটিয়েছেন পাহাড়ি-বাঙ্গালীরা অশিক্ষিত মূর্খ কামলারা কিন্তু পার্বত্য চুক্তির সুফল ২৭ বছরেও পায়নি। এর জন্য দায়ী কে? বা কোন পক্ষ সরকার না-কি চাকমা জেএসএস?
প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সামাজিক নিরাপত্তা পার্বত্য ক্ষমতার মসনদে আসীন হওয়া চাকমা নেতৃত্বশ্রেণী কতটুকু ভূমিকা রেখেছে? কোটা সুবিধা নিয়ে চাকমা ছেলেমেয়েরা নামি-দামি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে চাকরি পেলেও প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সুযোগ পায়নি৷ মাতৃভাষা শিক্ষা চালু ও প্রসার চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষায় শুরু হলেও বান্দরবান জেলার জেলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য চালু হয়নি। এর ফলে চাকমা জনগোষ্ঠী অগ্রসর হলেও পিছিয়ে পড়ে আছে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা।