বম সন্ত্রাসীরা ‘কুকি-চিন’ হওয়ার মিথ্যা অপপ্রয়াসে লিপ্ত!

0

আমি সানগাপ্রুই কুকি, আমার বাড়ি বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলা। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। সবসময় একটি কথা মানুষ থেকে শুনতে হয় শুধুমাত্র বমখ্যাত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপকর্মের কারণে। কুকি জাতি নয় তবুও ‘বম সন্ত্রাসীরা’ কুকি-চিন হওয়ার মিথ্যা অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়ে আমাদের সমগ্র কুকি জনগোষ্ঠীকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড জাহির করার মাধ্যমে নিজেদের নীলনকশা বাস্তবায়নে লিপ্ত হয়েছে। বমদের সঙ্গে আমাদের কুকি জনগোষ্ঠীর কোন সম্পর্ক নেই। আমরা কুকিরা বিশাল জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশ ও ভারত রয়েছে, আমাদের জনগোষ্ঠী। আমরা ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক বাহক কুকি-চিন জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশ বাঙালি জনগণের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করার আছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। এই বম সন্ত্রাসী জনগোষ্ঠীরা আমাদের কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর একটি শাখা দাবি করে নিজেদের সমগ্র কুকি জনগণের সংগঠন দাবি করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়েছে। যার কারণে আমাদের জীবন বিপন্নতার পথে। আমরা কোনপ্রকার বম সন্ত্রাসীদের কার্যক্রমে জড়িত নয়। বম সন্ত্রাসীরা আমাদের কুকি জনগোষ্ঠীর পরিচয় বহন করার কারণেই আমাদের ভাবমূর্তি সারাদেশে চরমভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে। একটি জাতিসত্তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও রাষ্ট্র বিরোধী অপতৎপরতার দায়ভার কেন আমরা সমগ্র কুকি জনগোষ্ঠী বহন করব? আমরা বাংলাদেশ সরকার ও তার প্রশাসনের আইনকানুনের প্রতি সবসময় শ্রদ্বাশীল। ক্ষুদ্র বম জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতাবাদ ও রাষ্ট্রের প্রতি বৈরী আচরণ আমরা সভ্য জাতি হিসেবে মেনে নিতে পারিনা। বমদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমরা কুকি জাতি ঘৃণার সাথে প্রত্যাখান করি।

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর একজন সচেতন স্টুডেন্ট হিসেবে প্রকৃত সত্যটি সবার কাছে উন্মোচন করা জরুরী- কারণ আমাদের মাথা বিক্রি করে তথাকথিত অধিকার দাবিতে সোচ্চার কেএনএফ নামের বম সন্ত্রাসীরা কতটা মিথ্যা অপপ্রয়াসে লিপ্ত তা সকলের ওয়াকিবহাল হওয়া উচিত। আমাদের কুকি জনগোষ্ঠী সংগঠন পরিচয় দেওয়া কেএনএফ কী সত্যি কুকি-চিন নাকি বম জনগোষ্ঠীর একটি সন্ত্রাসী সংগঠন? কথিত কুকি-চিন বা কেএনএফ সংগঠন থেকে শুরু করে তাদের কার্যক্রমে এখন পর্যন্ত যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে তারা সবাই বম ব্যতিত কেউ না। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক ১১৬জন সকলেই বম জনগোষ্ঠীর সদস্য। আটককৃত কেউ আমাদের কুকি জাতির না। আমরা কুকি চিন বা কুকিভুক্ত ৫টি জাতি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে সম্প্রীতি বজায় রেখেই ভেদাভেদ ভুলে বসবাস করে আসতেছি। সন্ত্রাসী কাজে আমাদের কোন সদস্য জড়িত নাই। একাধিকবার সংবাদসম্মেলনে কুকিভুক্ত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা নাথান বমের বম সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা নাই এমনটা নিশ্চিত করেন। বম সন্ত্রাসীরা শুধুমাত্র নিজেদের সংগঠনের ব্যাপকতা প্রচারের জন্য এবং বাংলাদেশ ছাড়াও বর্হিরবিশ্বে যেসব কুকি আছে তাদের সমর্থন পাওয়াসহ নিজেদের সম্পৃক্ততা বুঝানোর জন্য একটা মিথ্যা অপপ্রয়াসের অংশ হিসেবে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নাম ব্যবহার করছে। বাস্তবিকঅর্থে এরা কেউ কেএনএফ না। এরা হচ্ছে বম সন্ত্রাসী।

গত ১৯ মে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ জেলা শহরের উজানী পাড়া এলাকায় আয়োজিত বিকেল চারটায় এক মানববন্ধন থেকে আমাদের কুকি জনগোষ্ঠী এই বম সন্ত্রাসীদের বর্জনের ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছেন। আমাদের কুকি জনগোষ্ঠীর ব্যানারে কেএনএফ কর্তৃক ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার প্রতিবাদে এ মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়।

আমি একজন কুকি জনগোষ্ঠীর স্টুডেন্ট হিসেবে হলফ ঘোষণা করে বলছি, বম ক্ষুদ্র জাতিসত্তার একটি অংশ, যারা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নাম দিয়ে কুকি জনগোষ্ঠীকে ব্যক্তি স্বার্থে চাঁদাবাজি, অপহরণ ও খুন-খারাবিসহ রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করে আসছে। মোট কথা তারা স্বঘোষিতভাবে কেএনএফ নাম ধারণ করলেও কুকি জাতি না, কুকি সম্প্রদায়কে তারা প্রতিনিধি করেনা। ইতোমধ্যে কুকিভুক্ত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বম সন্ত্রাসীদের সাথেই নিজেদের সম্পৃক্ততা নেই বলে জানান এবং বম সন্ত্রাসীরা কুকিভুক্ত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেনা এমনটা স্পষ্ট করেন।

কুকি ও লুসাই শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে শ্রী রমাপ্রসাদ দত্তের গবেষণামূলক লুসাই কুকিদের ইতিকথা” বইটি ত্রিপুরার গবেষণা অধিকার থেকে প্রকাশিত। বইটি থেকে জানা যায়, ত্রিপুরার কয়েক হাজার পাহাড়ী লোক রয়েছে যাদের ভাষা তিপ্রাদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এবং যারা কুকি ও লুসাই নামে পরিচিত। তারা কুকি নামে আখ্যাত হয়েছে সমতল অঞ্চলের অধিবাসীদের দ্বারা। সেকালের সমতলবাসীরা সেই সব পাহাড়ীদেরই ‘কুকি’ বলে অভিহিত করতো যাদের ভাষা তারা বুঝতো না, বা যাদেরকে তারা দুর্ধর্ষ প্রকৃতির ও মিত্র ভাবাপন্ন নয় বলে মনে করতো।

কুকি নামটি নেহাত আধুনিক নয়। খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রচিত গ্রন্থ ‘রাজমালা’র প্রথম লহরে ‘কুকি’ নামের উল্লেখ আছে। ত্রিপুরার রাজ বংশীয়দের অধিকৃত হওয়ার পূর্বে ত্রিপুরা অঞ্চল বিভিন্ন শাখার কিরাতদের দ্বারা অধ্যুষিত ছিল। এই কিরাত জনেরাই পরবর্তীকালে কুকি নামে আখ্যাত হয়েছে। ত্রিপুরার রাজা হিমতি (হামতারকা বা যুঝারকা) যখন রাঙ্গামাটি (গোমতী নদীর তীরবর্তী ভূ-ভাগ) অধিকার করতে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর অগ্রগামী সেনাদলে ছিল কুকিরা। রাজার বশ্যতা স্বীকারের পর কুকিদের মধ্যে যারা তিপ্রাদের দ্বারা বিশেষভবে প্রভাবিত হয়েছে, ত্রিপুরায় তারাই পরিচিত হয়েছে হালাম নামে। ১৭২৪ খৃষ্টাব্দে অসমীয়া ভাষায় রচিত গ্রন্থ ত্রিপুরা বুরঞ্চীতেও একথার সমর্থন মিলে। ১৭১২ খৃষ্টাব্দে আসামের রাজা রুদ্রসিংহের দরবার থেকে রাজার অধিকারভুক্ত রাঙ্গ রুঙ্গ (১) পাহাড়ে এসে যাদের দেখেছিলেন তাদেরকে কুকি ও হালাম বলেছেন (২) প্রাচীনকালে কুকিরা বশ্যতার নিদর্শন স্বরূপ ত্রিপুরার রাজাকে বার্ষিক ভেট এনে দিত এবং সেই ভেটই কররূপে গৃহীত হতো। কি কি দিতে হবে তার কোন নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। সাধারণত তারা এনে দিত নিজেদের তৈরী নানা রকমের কাপড়, লোহা, পিও ও বাঁশের তৈরী জিনিষ, হাতীর দাঁত, ঘোড়া নানা প্রকার বন্য জন্তু (৩) এছাড়া কুকিরা রাজকরের বিনিময়ে বৎসরে ছয়দিন সোনার খনিতে ও রেশমের কারখানায় কাজ করতে বাধ্য ছিল। সরকারী হাতী খেদার কার্যেও তাদের উপস্থিত থাকতে হত।

পার্বত্যাঞ্চলে সরকারী সংবাদ প্রচার করা, রাজকর্মচারীরা পার্বত্য অঞ্চলে গেলে তাদের জিনিষ পত্র এক পল্লী থেকে অন্য পল্লীতে বয়ে নিয়ে দেওয়া ইত্যাদি কাজও তাদের কর্তব‍্য ছিল। এইসব কারণেই তারা মুক্ত ছিল করের দায় থেকে। পরে কখন এই ‘কুকি’দের উপর ঘর চুক্তি কর ধার্য্য হয়েছে তা জানা যায় না, শুধু জানতে পাই ১৮৭৪- ৭৫ খৃষ্টাব্দে কুকি’দের উপর ঘর চুক্তি খাজনা (Family tax) ছিল ৫।। (পাঁচ টাকা আট আনা)। তখন ‘হালাম’ নামে পরিচিতেরা এই কর দিত প্রতি পরিবারের জন্য ২ টাকা হারে।

কুকি নামে আখ্যাত জনেরা কিন্তু নিজেদের কুকি বলে পরিচয় দেয় না। যে সব নামে তারা নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকে, সে সব নামের উৎপত্তি সাধারণতঃ তাদের প্রধান বা বিখ্যাত দলপতির নাম থেকে। ‘ককবরক’ বা তিপ্রা ভাষায় ‘কুকি’দের বলা হয় ‘ছিকাম’। মণিপুরী ভাষায় বলে হাউ। কুকি ভাষাতেও ‘কুকি’র প্রতিশব্দ রয়েছে- তারা বলে ‘হায়েম’।

লুসাই নামটি ত্রিপুরায় প্রচলিত হতে থাকে খ্রীষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে। অষ্টাদশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে ত্রিপুরার ইন্দ্রমাণিক্য যুবরাজ কৃষ্ণমণিকে পরিবারবর্গসহ পূর্ব কূলে পাঠিয়ে নিজে মুর্শিদাবাদে গিয়েছিলেন নবাবের দরবারে। কৃষ্ণমণির পূর্বকূলে (৪) অবস্থান কালেই লুসাই ও খুচুং কুকিরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিল। (৫) লুসাই নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে ১৩৪০ ত্রিপুরাব্দের ত্রিপুরা রাজ্যের সেনসাস বিবরণীতে বলা হয়েছে, কাছারি গণ ইহাদিগকে লুছাই বলিত, এই ‘লুছাই’ শব্দ এখন লুসাইরূপে পরিণত হইয়াছে। কাছাড়ীদের প্রদত্ত ‘লুছাই’ নাম অর্থ ব্যঞ্জক, ‘লু’ অর্থ মাথা আর ছাই অর্থ কাটা। যাহারা মাথা কাটে তাহারাই ‘লুছাই’।

শব্দটির উক্তরূপ বুৎপত্তির কথাই বলেছেন।

“Hill Tracts of chittagong and the dwell- ers therrin” গ্রন্থের প্রণেতা T. H. L. win সাহেব। কিন্তু The Lushai Kuki clan গ্রন্থের প্রণেতা লেঃ কর্ণেল সেকসপীয়ারের অভিমত ভিন্নরূপ তিনি লিখেছেন:-

এটি অবশ্যই একটি ভুল, কারণ বংশটি লুসাই নয়, লুসাই, এবং যদিও ‘শা’ মানে ‘কাটা’ এর অর্থ ‘কাটানো’ নয় এবং একজন মানুষের মাথা কাটাতে ব্যবহার করা যায় না,

তিনি আরও বলেছেন যে, নরমুণ্ড শিকার এই সব পাহাড়িয়াদের চিরাচরিত প্রথা এরূপ বদ্ধমূল ধারণা থেকেই উদ্ভব হয়েছে এই ভুল ব্যুৎপত্তির।

কেবল মুণ্ড সংগ্রহের উদ্দেশ্যই ‘লুসেই’রা কোন গ্রাম আক্রমণ করতো, একথা ঠিক নয়, তারা আক্রমণ করত লুণ্ঠন ও দাসদাসী সংগ্রহের জন্য। অবশ্য যে ব্যক্তি যুদ্ধে শত্রু সংহারে সমর্থ হত, সমাজে সাধারণের নিকট তার কৃতিত্বও স্বীকৃত হত, তাই সে নিয়ে আসতো নিহতের মুন্ড তার কৃতিত্বের নিদর্শন। হত্যা ও মুণ্ড সংগ্রহটা ছিল আনুষঙ্গিক ব্যাপার, মূল কারণ কখনও নয়। এদের চীফদের মৃত্যুতে অন্তেষ্টি ক্রিয়ায় নরমুণ্ডের প্রয়োজন বলে তা সংগ্রহের জন্য অবিলম্বে লোক পাঠান হত এই ছিল প্রচলিত বিশ্বাস। কিন্তু তা লুসেইদের বেলায় প্রযোজ্য নয়। থাদোদের মধ্যে প্রচলিত প্রথাকেই ভুল করে লুসেইদের বলে ধরে নেয়া হয়েছে।

‘লুসাই’ শব্দটি বর্তমান সময়ে ব্যাপক অর্থ বহন করছে। ‘লুসাই’ বলতে এখন বহু পরিবারের লোকদের বুঝিয়ে থাকে। ‘লুসেই’ শব্দটির ভুল Transliteration-এর ফলেই ‘লুসাই’ শব্দ সৃষ্টি হয়েছে, ‘লুসেই’ হল বংশের নাম। এই বংশ থঙ্গুর, পড়ুআও ছংতে, ছোংতে, ছোআছেং প্রভৃতি অনেক পরিবারে বিভক্ত। প্রত্যেক পরিবারেও রয়েছে বেশ কয়েকটি করে শাখা।

আজকে যাদেরকে আমরা মিজো বলি তারাও লুসাইয়ের একটি শাখা। ত্রিপুরার জম্পুই পাহাড়ে যারা বাস করে তাদেরকে আমরা মিজো বলে থাকি।

ক্যাপ্টেন সেক্সপীয়ার তাঁর গ্রন্থে সেখানকার অধিবাসীদের বলেছিলেন লুসাই কুকি জাতীয়। সেই থেকে অ-মিজোদের নিকট মিজোরা লুসাই নামে পরিচিত। মিজোদের ভাষায় কুকি মানে শিং এবং অতীত কালে মিজো ও অন্যান্য কুকিরা শৃঙ্গ সমন্বিত টুপি পরতো কিন্তু তা কুকিরা ‘কুকি’ বলতে বুঝত মস্তক শিকারী। মিজোদের ভাষায় ‘লু’ অর্থ হচ্ছে শির, আর ‘সেই’ অর্থ বড়।

মিজোরা অনেকগুলি উপজাতিতে বিভক্ত। যেমন লুসাই, মার, রংরাইতে, জাংতে, রাখমে, সাইলো, জদেং, থাংলিয়া, রিবোং ‘রাংখম’ পাঁচুহীন, শিয়াক, কলনে, তাংজিরা ইত্যাদি। মিজোদের মধ্যে অনেকগুলি কথ্য ভাষা আছে। তার মধ্যে লুসাই ভাষাই সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়, মিজোদের কোন ভাষারই নিজস্ব বর্ণমালা নেই। খ্রীষ্টান ধর্ম প্রচারকেরা লসাই’ ভাষাকে রোমান হরফে ট্রেন্সলিটারেশন বা উচ্চারণ অনুসারে অক্ষরীকরণ দ্বারা মিজো অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রচলন করেছেন। মিজো ছেলে মেয়েরা রোমান হরফে লুসাই ভাষার ইতিহাসে ভুগোল অধ্যায়ন করে, লুসাই ভাষায় ‘x’, ‘y’ ও ‘a’ এর ব্যবহার নেই।

উপরোক্ত ইতিহাস ভিত্তিক তথ্য উপাত্ত ও অন্যান্য গবেষণামূলক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে আমাদের লুসাই বা কুকি জাতীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বম জনগোষ্ঠীর কোনপ্রকার সরাসরি সম্পৃক্ততা নাই; কুকি-লুসাই জনগোষ্ঠীর অনেক শাখা-প্রশাখা আছে। ভারত ত্রিপুরা, মিজোরাম ও বাংলাদেশে কুকিদের অবস্থান। আর বম জাতির আবাসভূমি হচ্ছে মায়ানমারের চিন প্রদেশ। সুতরাং বম জনগোষ্ঠী সরাসরি কুকি লুসাই জনগোষ্ঠীর শাখা নয়। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, কুকি জনগোষ্ঠীর আবাস্থল ও নামকরণ বা উৎপত্তিস্থল ভারত কিন্তু বাংলাদেশে না। আমাদের উৎপত্তি এবং স্থানীয়ভাবে নামককরণ কিন্তু প্রমাণ করে যে আমরা এদেশের ভূমিপুত্র নয় এবং বম জনগোষ্ঠী সমগোত্রীয় নয়। এর ফলে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র দাবি করতে পারিনা। যেখানে আমরা দাবি করতে পারিনা সেখানে মায়ানমারের চিন রাজ্যের বম জনগোষ্ঠীর সন্ত্রাসীরা নিজেদের এখানকার ভূমিপুত্র দাবি করা হাস্যকর। এছাড়াও বমরা মিয়ানমারের চিনভিত্তিক লাই জনগোষ্ঠী (মিয়ানমারে চিন ও ভারতে পাওয়ি নামে পরিচিত) অন্তর্ভুক্ত। তারা কীভাবে পাহাড়ে কুকি জাতীয়তাবাদের ধারণা করে? চিন ভিত্তিক লাই জনগোষ্ঠীর নামটি কুকি জাতির সঙ্গে জড়িয়ে তারা কুকি-চিন জাতিভুক্ত দাবি করছে। বমদের উৎপত্তি মিয়ানমারে হলেও সেখানেই এখন সবচেয়ে কমসংখ্যক বমদের দেখা পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচিতে।
অন্যান্য সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ১০ হাজার ও মিয়ানমারে আড়াই হাজার বম জনগোষ্ঠীর সদস্য বসবাস করছে। তিন দেশ মিলিয়ে বম জনগোষ্ঠীর মোট সদস্য সংখ্যা কম-বেশি ২৬-২৭ হাজার। চিনভিত্তিক লাই জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এমন আরো কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে নতুন একটি স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের দাবি তুলেছে বমরা কেএনএফ নাম দিয়ে। এর ভিত্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে কুকি-চিন জাতীয়তাবাদের ধারণাকে। যদিও ইতিহাস এবং বিভিন্ন গবেষণার সুত্র অনুযায়ী আমরা কুকিরা মনে করি যে বম জনগোষ্ঠী আমাদের কুকি জাতীয়তাবাদের ধারণ করার এখতিয়ার নেই। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও ধর্মীয়ভাবে অভিন্ন হলেও জাতিগত পরিচয়ে আমরা সম্পূর্ণ আলাদা। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে, লাই তথাকথিত চিন-কুকি-মিজোর প্রভাবশালী উপজাতিগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু চিন লাই জনগোষ্ঠী কুকি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয় নিয়ে নানান বিতর্ক ও মতবাদ আছে। কুকি শব্দের সঙ্গে চিন শব্দ যুক্ত করে কুকি-চিন করা হয়েছে। এটা বম জনগোষ্ঠীর হীন উদ্দেশ্য আদায় করার জন্য বরাবরই কুকি জনগোষ্ঠীর বিশাল সম্প্রদায়কে টেনে আনছে। এই থেকে বলতে পারি, বম জনগোষ্ঠী পৈতৃক ভূমি বলে পার্বত্য চট্টগ্রামে কথিত কুকি রাজ্য বা স্বায়ত্তশাসন দাবি কিন্তু মামার বাড়ির আবদার। আমরা কুকিরা রাজ্য বা স্বায়ত্তশাসন দাবি করিনা। আমরা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক বিধিবিধান মোতাবেক মৌলিক অধিকারে সন্তুষ্ট। আজকে সর্বত্র আমাদের একটি প্রশ্নে সম্মুখীন হতে হচ্ছে বম সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আমরা আছি কিনা? আমাদের কুকিভুক্ত ম্রো, চাক, খিয়াং ও পাংখোয়া তথা লুসাইরা কখনো বম সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলনা। পাহাড়ে অশান্তির জন্য একা দায়ী বম সন্ত্রাসীরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি এবং রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি ও বাঘাইছড়ি আমাদের কুকি বা লুসাই জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে আমাদের কুকি সম্প্রদায়ভুক্ত জাতির জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৭৬,৫৮১ জন। আর বম জনগোষ্ঠী হলো মাত্র ১৩,১৯৩ জন। এর মধ্যে দেশবিরোধী সশস্ত্র বম সন্ত্রাসীদের সদস্য সংখ্যা গণমাধ্যম প্রকাশিত সংবাদ থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১ হাজার পর্যন্ত হতে পারে৷ ১৩,১৯৩ বম জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ হাজার বম সন্ত্রাসী কীভাবে ৭৬,৫৮১ জন কুকি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি করে? তারা আমাদের সংগঠন নয়। মূলত বম সন্ত্রাসীরা বিপুল সংখ্যক কুকি জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগঠন পরিচয় দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার মাধ্যমে এ অঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি করে কুকি জনগোষ্ঠীকে বিপদে ফেলেতে অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। আমরা কুকি জনগোষ্ঠী বম সন্ত্রাসীদের স্পষ্ট বলতে চাই, আমাদের জাতির পরিচয় দিয়ে যদি কোনপ্রকার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পাহাড়ের শান্তি বিনষ্ট করেন কুকি জনগোষ্ঠী বসে থাকবে না। আপনাদের স্বমূলে উৎপাটন করা হবে। একইসাথে দাবি করি সরকার যেন বম সন্ত্রাসী নির্মূলের মাধ্যমে বান্দরবানে চলমান নৈরাজ্য অবসান করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে।

আগের পোস্টরাঙ্গামাটি জোন কর্তৃক বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ও ঔষধ প্রদান।
পরের পোস্টকুকি চিন কী সত্যিই কুকি চিন?

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন