উপজাতিরা জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী আদিবাসী পূর্বশর্তসমূহ পূরণ করেনা।

0

Indigenous Peoples যার বাংলা প্রতিশব্দ আদিবাসী মানুষ। প্রশ্নে আসতে পারে কারা এই আদিবাসী মানুষ? আদিবাসী মানুষকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য রয়েছে জাতিসংঘের International Labor Organization (ILO) 169, 1989 ধারা এবং আদিবাসী অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে রয়েছে ঘোষণাপত্র United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples যা UNDRIP নামে অভিহিত৷

ঘোষণাপত্রটি ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর রোজ বৃহস্পতিবার সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। যার পক্ষে ভোট দিয়েছে জাতিসংঘের ১৪৪ টি রাষ্ট্র, বিপক্ষে রয়েছে ৪ টি ভোট (অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এবং ১১ টি রাস্ট্র ভোটদানে বিরত (আজারবাইজান, বাংলাদেশ, ভুটান, বুরুন্ডি, কলম্বিয়া, জর্জিয়া, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, রাশিয়ান ফেডারেশন, সামোয়া ও ইউক্রেন) ছিল। কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি এই ঘোষণাপত্র গৃহীত হওয়ার সময়ে বাংলাদেশ ভোটদান থেকে বিরত ছিল৷ অথাৎ বাংলাদেশ জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেনি। যার মানে দাঁড়ায় বাংলাদেশ সরকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী/উপজাতি জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেনি।

বলাবাহুল্য যে, ২০০৭ সালের জাতিসংঘের এই ঘোষণাপত্রে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য অকল্পনীয় অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।তারমধ্যে ভূমি অধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, স্বায়ত্তশাসন অধিকার, জাতীয়তা লাভের অধিকার তথা এই সব অধিকার বাস্তবায়নে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ পাওয়ার অধিকার অন্যতম।

আন্তর্জাতিক আইন, রাজনৈতিক ও স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা নিঃসন্দেহে আদিবাসী শব্দ নিয়ে যে এদেশে গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে তা অনুধাবন করতে পারার কথা। মনে রাখতে পারার মত বুঝতে পারা একটি দক্ষতা, তবে এটি অপেক্ষাকৃত উচ্চস্তরের দক্ষতা। কিন্তু কেউ জেগে ঘুমালে তার ঘুম ভাঙাবে কে? যেমনটি ‘আদিবাসী’ শব্দটি এ কয়েক বছরে ব্যাপক প্রচারের পরেও দ্বায়িত্বশীলরা রহস্যজনকভাবে নিশ্চুপ আছে। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘আদিবাসী’ হবার পূর্বশর্তসমুহ পূরণ হয়নি তারপরও গণমাধ্যমগুলো আদিবাসী দিবসের কয়েকদিন আগ থেকেই শেষদিন পর্যন্ত দিবসটি ঘিরে প্রচারণায় ব্যস্ত থাকে৷ টকশো, সভা-সেমিনারে ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতির জন্য জোরালো দাবি থাকে আমাদের সুশীল, বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে। এসময় শব্দটির বিপক্ষে অবস্থানকারী যারা আছে তাদের অসন্তোষের দিকগুলো দামাচাপা পড়ে যায়। অধিকন্তু শব্দটি প্রচারে বাধ্যবাধকতা থাকার সত্ত্বেও শব্দটি প্রচারে এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকার দাবিতে মিডিয়া ও বামপাড়ায় চুল-ছেঁড়া বিশ্লেষণ চলে। আমাদের সচেতন মহল একটিবারও আদিবাসী শব্দটির ভালো-খারাপ দিক বিচার-বিশ্লেষণ করেনা। শুধুমাত্র মিশনারী ও পশ্চিমা দেশগুলোর খপ্পরে পড়ে আদিবাসী স্বীকৃতি নিয়ে অতিরঞ্জণ করছে। এনজিও গুলো আদিবাসী দিবসের সভা সেমিনার ও বিভিন্ন সংস্কৃতি প্রদর্শনীর আয়োজক! বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবনার সময় এসেছে। কেন তাদের আদিবাসী নিয়ে এত উৎসাহ?

আদিবাসী অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র হল, একটি দেশের ভূখণ্ড কে পৃথক করে আলাদা রাস্ট্র গঠনের চাবিকাঠি। এর আইনগত রূপ, ২০০৭ ঘোষণাপত্র এবং (ILO) 169, 1989 প্রথম পার্টের 1 (B)। তজ্জন্য বাংলাদেশের উপজাতিরা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জোরালো করেছে। খ্রিস্টান মিশনারী, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও পশ্চিমারা যেভাবে অর্থ ও ইন্ধন দিচ্ছে ঠিক সেভাবেই এদেশের তথাকথিত গণমাধ্যমগুলো আদিবাসী শব্দটি বহুল প্রচার করছেন । গণমাধ্যমের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণে দেশের অধিকাংশ মানুষ উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে সম্বোধন করে৷ শব্দটির মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবগুলোর বিশ্লেষণ করে না। শব্দটি বন্ধে রাষ্ট্রীয় কার্যকারী পদক্ষেপ অতীব জরুরী বলে মনে করছেন পার্বত্য বাঙ্গালীরা। বাঙ্গালীরা মনে করেন, শুধু দায়সারাভাবে অনুরোধ পূর্বক প্রজ্ঞাপন জারি করে ‘আদিবাসী’ শব্দ পরিহার করা সম্ভব নয়। শব্দটি ২০০৭ সাল থেকে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে পাহাড়ের আঞ্চলিকদল জেএসএস ও পাহাড়ি উগ্রবাদী অংশ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের এককাতারে নিয়ে আসার জন্য মাঠে তৎপর। পাহাড় ও সমতলের অনেকে বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের আদিবাসী হিসেবে সম্বোধন না করে উপজাতি বলার কারণে অনেক বাঙ্গালীরা উপজাতি উগ্র সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতাকর্মীদের কটুক্তি ও বাধার সম্মুখীন হচ্ছে৷ উপজাতি উগ্রবাদীরা জোরপূর্বক ‘আদিবাসী’ শব্দটি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। সাধারণ বাঙ্গালীরা ‘আদিবাসী’ সংজ্ঞা এবং ‘উপজাতি’ সংজ্ঞা না জানার কারণেই উগ্রবাদীরা ILO (A), (B) ধারার সংজ্ঞার অপব্যাখ্যা দিচ্ছে।

ILO Convention No-169, প্রথমপার্ট 1- ধারার (A) তে বলা হয়েছে-
“স্বাধীন দেশের উপজাতীয় জনগণ যাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা তাদেরকে জাতীয় সম্প্রদায়ের অন্যান্য অংশ থেকে আলাদা করে এবং যাদের মর্যাদা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে তাদের নিজস্ব রীতিনীতি বা ঐতিহ্য বা বিশেষ আইন বা প্রবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়; মূলত তারাই উপজাতি।”

ILO Convention No-169, প্রথমপার্ট 1- (B) তে বলা হয়েছে-
“স্বাধীন দেশের জনগণ যারা বিজয় বা উপনিবেশ স্থাপনের পূর্ব বা বর্তমান রাষ্ট্রীয় সীমানা প্রতিষ্ঠার সময় দেশটিতে বসবাসকারী জনসংখ্যা বা দেশটির অন্তর্গত একটি ভৌগলিক অঞ্চল থেকে তাদের বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে আদিবাসী হিসাবে বিবেচিত হয় এবং যারা, তাদের আইনগত অবস্থা নির্বিশেষে, তাদের নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির কিছু বা সমস্ত বজায় রাখে তারা মূলত আদিবাসী জনগোষ্ঠী।”

(A), (B) দু’টি ধারা থেকে আমরা জানতে পেরেছি উপজাতি ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী নির্ণয় বা নির্ধারণের সংজ্ঞা।

এখন জানার প্রয়োজন বাংলাদেশে বাঙ্গালী ব্যতীত বসবাসরত অন্যান্য জাতিসত্তার আসল পরিচয় কী?

বাংলাদেশ সংবিধানে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, কুকি, সাঁওতাল, গারো ও হাজং সহ আরো প্রায় ৪৫ টি উপজাতি সম্পর্কে কী বলেছে? ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ২৩ (ক) ধারায় সংস্কৃতি সংক্রান্ত একটি অনুচ্ছেদ সংযোজন করে বলা হয়, “রাষ্ট্র বিভিন্ন উপ-জাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।”

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি উপজাতি সম্পর্কে কী বলেছে? ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে জন সংহতি সমিতি স্বাক্ষর করে এবং চুক্তির খ খণ্ডের ১ নম্বর ধারায় জেলা পরিষদের আইনে উল্লেখ করা হয় যে ‘উপজাতি’ শব্দটি বলবৎ থাকবে।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর তথাকথিত প্রথাগত অধিকার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি’ কী বলেছে?
বৃটিশ কর্তৃক প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি- ৫২ ধারা মতে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত।

এ অঞ্চলের বাসিন্দা সম্পর্কে সার্কেল চীফ কী বলেন?
পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি সার্কেল নিয়ে গঠিত৷ এই সার্কেল চীফ রাই উপজাতি জনগোষ্ঠীর মূল প্রতিনিধি। প্রয়াত ১৫ তম বোমাং সার্কেল চীফ অংশৈপ্রু চৌধুরীর নিজে বলেছিলেন, “আমরা আদিবাসী নই, আমরা উপজাতি। আমাদের আদিনিবাস মায়ানমার।”

পাহাড়ীদের জাতি হিসেবে কি নামে অভিহিত করেন উপজাতি প্রসিদ্ধ লেখকরা?
বাংলা ১৩৯২ সালে কলকাতা হতে প্রকাশিত সিদ্ধার্থ চাকমার “প্রসঙ্গ: পার্বত্য চট্টগ্রাম” বইয়ে পাহাড়ীদের “উপজাতি” হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

উপজাতিরা আদিবাসী নয় এ দাবির স্বপক্ষে তথ্য উপাত্ত কী?
১৯৩৮ সালে ভারতের ভোটার তালিকায় উপজাতিরা ভোটার ছিলেন না। তাদেরকে ভারতও অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যার কারণে তারা ভারতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। অথাৎ ভারত উপজাতিদের অভিবাসী হওয়ার কারণে ভোটাধিকার দেননি।

উপর্যুক্ত তথ্য প্রমাণ থেকে এটাই স্পষ্ট যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা কোনকালেই আদিবাসী ছিল না। তারা সবসময় উপজাতি পরিচয়ে এদেশে ছিলেন। জাতিসংঘের ILO সংজ্ঞা মতে এদেশে আদিবাসী আছে কী? তার বিশদ বর্ণনা নিম্নোক্ত বিবৃত হলো।

এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু উপজাতিরা হঠাৎ কেন নিজেদের স্ব-স্ব পরিচয় ও জাতিগত স্বীকৃতি বাদ দিয়ে নিজেদের আদিবাসী দাবি করছে?? এর কারণ জাতিসংঘ ২০০৭ ঘোষণাপত্র। এটি আদিবাসীদের অধিকারের আন্তর্জাতিক দলিল হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

এটি বিশ্বের আদিবাসীদের বেঁচে থাকা, মর্যাদা এবং মঙ্গলের জন্য সর্বনিম্ন মানদণ্ডের একটি সর্বজনীন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে এবং এটি আদিবাসীদের জন্য প্রযোজ্য বিদ্যমান মানবাধিকারের মান এবং মৌলিক স্বাধীনতাগুলিকে বিস্তৃত করে। এখানে এমন কিছু অনুচ্ছেদ আছে যা আদিবাসী জনগণকে একটি ভূমি অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ক্ষমতার প্রেক্ষিতে জাতীয়তালাভের মাধ্যমে স্বাধীন রাস্ট্র উপহার দিবে।

ঘোষণাপত্রটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কারণ আদিবাসী এবং টরেস স্ট্রেইট দ্বীপবাসীসহ আদিবাসীরা এর খসড়া তৈরিতে জড়িত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী/ উপজাতি কী উক্ত আদিবাসীদের মত আদিবাসী হবার পূর্বশর্তসমুহ পূরণ করে?

উপজাতিরা যে এদেশের আদিবাসী না, আদিবাসী মানুষ নির্ধারণের সংজ্ঞা এবং দেশের সংবিধান, পার্বত্য চুক্তি একটি গ্রহণযোগ্য প্রমাণ হতে পারে। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ মর্গানের সংজ্ঞানুযায়ী, “আদিবাসী হচ্ছে, যারাই ভূমিপুত্র কিংবা কয়েক হাজার বছর ধরে যথাস্থানে বসবাস করে বা যাদের বসবাসের ইতিহাস জানা নেই, এমনকি উপনিবেশিক শাসন আমলের পূর্ব থেকে বসবাস করে, যাদের রয়েছে কয়েক হাজার ভাষা।” কিন্তু এদেশের উপজাতিরা মঙ্গোলীয় বংশদ্ভূত। তাদের আদিনিবাস ভারত ও মায়ানমার। ব্রাজিলের আমজান আদিবাসী, অস্ট্রেলিয়ার অবরিজিন আদিবাসী এবং রেড ইন্ডিয়ানদের মত কী বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জাতিসত্তার এদেশের পার্বত্য ভূখণ্ডে বসবাসের সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে? যদি থেকে থাকে তাহলে তাদের আদিবাসী স্বীকৃতির বিষয়ে কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়। তারা তাদের প্রাপ্ত অধিকার বুঝে নিবে। কিন্তু আপত্তি সৃষ্টি হয়েছে তাদের এ দেশের আগমনের ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভাব এবং জাতিসংঘের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংজ্ঞা অতঃপর ২০০৭ সালের ঘোষণাপত্র আলোকপাত থেকেই। ঐতিহাসিকদের মতে এদেশে উপজাতিদের বসবাসের ইতিহাস ৩০০ বছরের বেশি নয়। চেহারা গঠনগত দিক, ভাষা, সংস্কৃতি দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী থেকে অমিল শুধুমাত্র এ ব্যবধানের মধ্য দিয়ে আদিবাসী হওয়া যায় না। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত ৪৫ টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জাতিসত্তা আছে। ILO (No169) 1- (a) উপজাতির সংজ্ঞা মতে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জাতিসত্তাগুলো উপজাতি। জাতিসংঘ স্বীকৃত উপজাতি জনগোষ্ঠীর বিশদ সংজ্ঞা- “একটি দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে ভাষা, সংস্কৃতি, সামাজিক, অর্থনৈতিক ভিন্নতর যারা, তাদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি নিজেস্ব আইন দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচালিত তাদেরকে উপজাতি বলা হয়।” এর ফলশ্রুতিতে তারা বাংলাদেশের সংবিধানে উপজাতি হিসেবে স্বীকৃত।

উপজাতি ও আদিবাসী জনগণ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আইনের অপব্যাখা, এবং এদেশের সংবিধান কী বলে? আর আদৌ কী তারা আদিবাসী হওয়ার দাবি রাখে?

বাংলাদেশের উপজাতিরা জাতিসংঘের International Labor Organization (ILO) C169, 1989, সাধারণ নীতি প্রথমপার্ট 1 এর (A) শর্ত মোতাবেক উপজাতি৷ কিন্তু তারা (A) এর শর্তাবলি মানতে নারাজ এমনকি সুকৌশলে তারা (A) কে এড়িয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর (B) কে অপব্যাখা ও অপব্যবহার করছে৷
তার অন্যতম কারণ- ২০০৭ সালে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত লক্ষ্যে জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র গৃহীত করেন। সবচেয়ে অবাক বিষয় হল, এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ তার আগেও তারা নিজেদের উপজাতি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন!

২০০৭ সালের ঘোষণাপত্রে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জাতীয়তা লাভের অধিকার নিশ্চিত করে। এই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সুযোগ-সুবিধা আর দেশভাগ করার জন্য (B) শর্তাবলি পূরণ না করার স্বত্বেও নিজেদের আদিবাসী দাবি করেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি, এবং আদিবাসী শব্দটির তফাৎ কী?

জাতিসংঘের International Labor Organization (ILO) C169, 1989 এর পার্ট প্রথম সাধারণ নীতির ধারা 1 প্রযোজ্য এর (A) শুধুমাত্র উপজাতি জনগোষ্ঠীর জন্য৷ এদেশের উপজাতিরা এ ধারাটি বরাবরই এড়িয়ে যেতে চায়! দেশের অধিকাংশ মানুষ জাতিসংঘের (ILO) C169, পার্ট প্রথম খণ্ডের 1 এর (A) ধারা সম্পর্কে নূন্যতম জ্ঞান-ধারণা নেই৷ যার কারণে উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে সম্বোধন করে থাকে। তাই সবকিছু গুলিয়ে ফেলে।

উপর্যুক্ত প্রথম খণ্ডের 1 এর (A) ধারা বাংলাদেশের উপজাতিদের জন্য প্রযোজ্য। এ দেশের উপজাতিদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা ও রীতিনীতি বা ঐতিহ্য কিন্তু উপজাতি জনগোষ্ঠীর পরিচয় বহন করে। যা বিবৃত হয়েছে।

(B) শুধুমাত্রই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য-
আমাদের দেশে কাজ করা এনজিও, আইএনজিও, দাতাসংস্থা, মিশনারী এবং এদেশের তথাকথিত সুশীল, গণমাধ্যম বাংলাদেশে শুধুমাত্র (ILO) C169, প্রথম খণ্ডের 1 (B) কে উত্থাপন করে। তাই আদিবাসী শব্দটি বহুল প্রচার পাচ্ছে।

প্রথম খণ্ডের 1 প্রযোজ্য এর (B) কিন্তু বাংলাদেশের উপজাতিদের জন্য কেন প্রযোজ্য নয়?
বাংলাদেশের প্রথম উপনিবেশ সময়ে কিন্তু উপজাতিদের বসবাস বা আগমণ ছিল না। উপজাতিরা এ ভৌগোলিক অঞ্চল এর বংশধর না। তারা মঙ্গোলীয় ও বার্মার চম্পকনগর থেকে এদেশে ব্রিটিশ আমলে আগমণ করেছে। উপজাতি প্রবীণ, লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী চাকমারা এখনো নিজেদের মঙ্গোলীয় এবং চম্পকনগরের বাসিন্দা হিসেবে গর্বের সাথে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আদিবাসী দাবির পক্ষে জেএসএস ও উগ্রবাদী উপজাতিরা যত খোড়া যুক্তি দিকনা কেন তাদের বয়োবৃদ্ধরা কিন্তু অকপটে স্বীকার করে তাদের আদিনিবাস মায়ানমারের চম্পকনগর। তারপরও যেসব উপজাতি নেতা এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবী আদিবাসী দাবির পক্ষে সোচ্চার তারা নিঃসন্দেহে মতলববাজ। প্রথম খণ্ডের 1 প্রযোজ্য এর (B) ধারা আদিবাসী জনগোষ্ঠী নির্ধারণের সংজ্ঞা হিসেবে আদিবাসীদের নিজেস্ব সামাজিক প্রথা, রাজনৈতি ও অর্থনীতি বিকাশের কথা বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে এদেশের উপজাতিদের নিজেস্ব সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনীতি নিজেদের আইন দ্বারা নিযন্ত্রিত বলতে কিছুই নেই৷ তারা ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেয়া প্রথাগত বিধিবিধান মেনে চলছে৷ যা তাদের সামাজিক প্রথা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মধ্যেই পড়ে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি (হিল ম্যানুয়েল ১৯০০) কিন্তু ব্রিটিশ কর্তৃক প্রণীত। আর যে, নিজেস্ব রাজনীতির কথা বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের কোন রাজনীতি করার ইতিহাস নেই৷ তাদের বর্তমান যে, রাজনৈতিক দলগুলোর কথা বলা হচ্ছে, তারা হচ্ছে সশস্ত্র সন্ত্রাসী বিচ্ছিন্নতাবাদী আঞ্চলিকদল। (১) জন সংহতি সমিতি (জেএসএস)-এর সৃষ্টি ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী, এবং সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনীর সৃষ্টি ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি। (২) ইউপিডিএফ সৃষ্টি ১৯৯৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর। বাকী ব্যাঙের ছাতার মত দলগুলো সৃষ্টি ১০ বছরের মধ্যে। সব মিলিয়ে আঞ্চলিকদলগুলোর সৃষ্টি ২০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। উল্লেখ যোগ্য তথ্য হল, এসব আঞ্চলিক দলগুলো রাজনৈতিকদল হিসেবে নিবন্ধন নেই। আর ইউপিডিএফ আদিবাসী স্বীকৃতি আন্দোলনে সম্পৃক্ত নয়। তাদের এ দাবির পক্ষে সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। বলাবাহুল্য, উপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবাই কিন্তু আদিবাসী দাবিদার না। যারা মিশনারী, এনজিও এবং জেএসএস ও বুদ্ধিজীবি, সুশীল ও গণমাধ্যম কর্তৃক প্রবাহিত শুধুমাত্র তারাই আদিবাসী শব্দটি সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে প্রতিবছর ৯ আগস্ট ডামাডোল পিটিয়ে দিবসটি পালন করে থাকে।

অতএব, সংবিধানের ২৩ অনুচ্ছেদ (ক) ধারা উপজাতি স্বীকৃতি, উপজাতি কোটা সুবিধায় চাকরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির খ খণ্ডের ১ ধারার জেলা পরিষদ আইনে উপজাতি শব্দ বলবৎকরণ (জেএসএস ও সরকার চুক্তি), আদিবাসী শব্দ প্রচারে সংবিধানের বাধ্যবাধকতার তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন ১৯ জুলাই ২০২২), পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণায়ল কর্তৃক চাকমা সার্কেল চীফকে আদিবাসী শব্দ ব্যবহারে বিধিনিষেধ চিঠি প্রেরণ কিন্তু বলে দেয় যে বাংলাদেশের এসব জাতিসত্তা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি। এবং তারা এদেশে স্ব-স্ব পরিচয়ে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল, হাজং ইত্যাদি। এই তথ্য উপাত্তের আলোকে বলা যায়, ILO ( No-169) 1 এর (B) বাংলাদেশের উপজাতিদের জন্য কোনক্রমেই প্রযোজ্য নয়। আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দাবি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদীত প্রচেষ্ঠা।

পাশকাটিয়ে কোনভাবেই যদি উপজাতিরা আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করেন, তাহলে আদিবাসী জনগোষ্ঠী হিসেবে দাবিদাওয়া বা মনোভাব কেমন হতে পারে? প্রথমে বলে রাখি আদিবাসী মানুষদের জাতীয়তা লাভের অধিকার আছে, যখন একটি জাতি জাতীয়তা লাভের অধিকার পেয়ে বসে তখন তারা বাংলাদেশ থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ক্ষমতায় দেশ থেকে পৃথক হতে আন্দোলন করবে। জাতিসংঘের সহযোগিতা চেয়ে তারা তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় গণভোটের আয়োজন করবে৷ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী পার্বত্য চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ নিবে। ভূমি অধিকার বলে এ অঞ্চলে আদিবাসী জনগোষ্ঠী ব্যতীত রাস্ট্রের অন্যান্য জনগণ এ অঞ্চল থেকে ভূমি অধিকার হারাবে। এছাড়াও আদিবাসী এলাকায় সামরিক কার্যক্রম নিষেধ। সুতরাং বলা যায় তখন এ অঞ্চলে রাস্ট্রীয় নিরাপত্তা শক্তি থাকবে না। এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠী গণভোটের মাধ্যমে ঠিক করবে তারা কী বাংলাদেশের সঙ্গে থাকবে নাকি পৃথক রাস্ট্র গঠন করবে। আমরা যদি ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো গণভোটের মাধ্যমে সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ থেকে কিভাবে খ্রিস্টান দেশে পরিণত হয়েছে৷ তাই বলা যায়, জাতিসংঘের আদিবাসী ঘোষণাপত্রের ক্ষতিকর প্রভাব অনেক৷ কোনভাবেই যদি এ আইনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে এবং ৪৫ টির মত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করে অচিরেই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন হওয়ার দারপ্রান্তে চলে যাবে। এ পর্যন্ত ‘আদিবাসী’ শব্দটি বন্ধে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। পদক্ষেপ যথাযথ বাস্তবায়নে আন্তরিক হলে অচিরেই আদিবাসী ষড়যন্ত্রের অবসান হতে পারে।

লেখক: হান্নান সরকার, মানবাধিকার কর্মী

আগের পোস্টশিক্ষা উন্নয়নে ভূমিকা রাখায় অনগ্রসর জাতির আলোর প্রদীপ সেনাবাহিনী।
পরের পোস্টগারো নারীকে ইউপিডিএফ কর্তৃক অপহরণের চেষ্টা; অতঃপর সেনাবাহিনী কর্তৃক উদ্ধার।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন