আতিকুর রহমান শুভ, রাঙামাটি:
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী উপজাতীয়দের মধ্যে অন্যতম চাকমা জনগোষ্ঠী। তিন পার্বত্য জেলা— খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান চাকমাদের বসবাস রয়েছে। চাকমারা বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী উপজাতীয় জনগোষ্ঠী। তবে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় সবচেয়ে অধিক চাকমা বসবাস করে। শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি-বাকরি, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সর্বক্ষেত্রেই পাহাড়ে চাকমাদের প্রাধান্যতা লক্ষণীয়। এই চাকমারা নিজেদের জুম্ম জাতি হিসেবে মনে করে। চাকমা নেতৃত্বশ্রেণী এই জুম্ম জাতীয়তাবাদ ধারণা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষীর ১৩টি উপজাতি জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দিতে চায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে অঘোষিতভাবে শাসনভার চাকমাদের হাতে ন্যস্ত। সর্বক্ষেত্রেই চাকমাদের আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ শোনা যায়। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দ্বিতীয় পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি ‘সংক্ষেপে’ জেএসএস অত্রাঞ্চলের সব জনগোষ্ঠীর অভিভাবক সংগঠন হিসেবে দাবি করে। কিন্তু সংগঠনটির নেতৃত্বের সিংহভাগই চাকমা। একই রূপে ইউপিডিএফ। তারা জুম্ম জাতীয়তাবাদ লালনে একপ্রকার বাধ্য করছে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীদের। চাকমা নেতৃত্ব মনে করেন এ অঞ্চলের সবধরনের উপজাতি জনগোষ্ঠীর ভাগ্য তাদের হাতে।
যদি উদাহরণ দিয়ে বলি, ১৯০০ সালে পার্বত্য অঞ্চলকে চাকমা, বোমাং ও মং সার্কেলে বিভক্ত করা হয় এবং প্রতিটি সার্কেলের চিফ নিযুক্ত করা হয়। বর্তমানে রাঙামাটি জেলার বৃহত্তর অংশ ও খাগড়াছড়ি জেলার কিছু অংশ নিয়ে চাকমা সার্কেল গঠিত। এই সার্কেল চিফ নিজেকে রাজা হিসেবে দাবি করেন কিন্তু সরকারিভাবে তার স্বীকৃতি নেই। চিফরা মূলত জেলা প্রশাসকের নিয়োগকৃত প্রতিনিধি। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, চিফ এখন রাজার আসনে অবতীর্ণ হয়েছে! পাহাড়ের মানুষ এখন তার প্রজা!! বিশ্বের প্রতিটি দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন-ক্ষমতার পালাবদলের পরিক্রমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের ভূমিকাই মুখ্য। অথাৎ বাংলাদেশে জনগণ প্রজা নয় বরং জনগণেই সকল ক্ষমতার উৎস। সেখানে পাহাড়ে চাকমা নেতারা অন্যান্য উপজাতিদের উপর তাবেদারি করার বা কে? চাকমা কথিত রাজা তার সার্কেলের আওতাধীন সকল উপজাতি জনগোষ্ঠী, এবং বাঙালিকেও তার প্রজা মনে করে থাকেন। সরকার থেকে কর আদায়ের ক্ষমতা পেয়ে নিজেকে ভিন্ন ভাষাভাষী উপজাতি জাতিসত্তার রাজা দাবি করা যেমন চাকমা নেতৃত্ব প্রভাবিত করার লক্ষণ তেমনি সার্কেলের সবাইকে প্রজা মনে করা চাকমা জুম্ম জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেয়ার সামিল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পিছিয়ে পড়া উপজাতিরা চাকমা নেতৃত্বের কাছে অসহায়। চাকমা নেতৃত্ব এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে উপজাতি জাতিসত্তাগুলো বাধ্য হয়ে মৌলিক ও নাগরিক সুবিধা গ্রহণ করতে তাদের কাছে আসতে বাধ্য হন।
রাঙামাটি আসামবস্তি নামকরণ থেকে স্পষ্ট এখানে চাকমার বাহিরে অন্যান্য জনজাতির আবাস আছে। আসামবস্তিতে বসবাসকারী জনজাতির অভিযোগ, আমরা চাকমা নেতাদের দাসত্ব শিকলে বন্দি। হেডম্যান রিপোর্ট ও অন্য প্রয়োজনে চিফের কাছে গেলে নিজেকে অনেক অসহায় মনে হয়। সরকারি কাজে গেলে দায়িত্বরত চাকমারা আমাদের সঙ্গে প্রজার মত আচরণ করে! নানা কটূক্তির শিকার হতে হয়। এ তিক্ত অভিজ্ঞতা পাহাড়ের উপজাতিদের আছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিযুক্ত বা সুবিধাভোগী হতে হলে চাকমা নেতৃত্বের পায়ের ধুলো নিতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা, ত্রিপুরা, তংচঙ্গ্যা, পাংখোয়া, চাক, খুমি, বম, লুসাই, মুরং ও বাঙালি জাতিসত্তা এই অপ্রিয় সত্য অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। পার্বত্যাঞ্চলের বসবাসরত অধিবাসীদের যে রাজনৈতিক অধিকার ছিল চুক্তির পর ২৭ বছরেও আদৌ তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছতে পারেনি তার মুল কারণ হচ্ছে: চাকমা নেতৃত্বের উগ্র সম্প্রদায়িকতা, বৈষম্য ও ক্ষমতার লোভ। চাকমাদের দেশান্তরিত যাযাবর ইতিহাস ও অকৃতজ্ঞর চরম পরিচয় লেখক আতিকুর রহমানের পার্বত্য তথ্য কোষের বিভিন্ন খণ্ডে বিবৃত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈষম্য, অন্যায়- অনিয়ম সৃষ্টিকারী চাকমাদের প্রজা হয়ে থাকতে চায়না উপজাতিরা। পাহাড়ে চাকমা নেতৃত্বের তাবেদারি অবসান হোক এই দাবি সকল উপজাতির। স্বগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়াতে চায় উপজাতিরা।