পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান অংশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারী গোষ্ঠীটি হচ্ছে বম সম্প্রদায়। তারা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট সংক্ষেপে ‘কেএনএফ’ হিসেবে কথিত। তাদের সশস্ত্র শাখার নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি বা (কেএনএ)। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি সাজেক, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও বান্দরবান জেলার রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি, লামা ও আলীকদম উপজেলা নিয়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত একটি পৃথক কুকি রাজ্য দাবি করে সর্বপ্রথম আলোচনায় আসে এ সংগঠনটি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ, দাবিদাওয়াসহ কুকি রাজ্যের মানচিত্র দেখা যায়। এসবের পরও তবে নিজেদের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিসেবে তুলে ধরা থেকে বিরত রয়েছে তারা। তাদের দাবি, সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের প্রতিপক্ষ নয়। পাহাড়ের বঞ্চিত, নির্যাতিত-নিপীড়িত কুকি জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায় তাদের মূল লক্ষ্য। এই দাবিতে স্বায়ত্তশাসনের অংশবিশেষ স্বাধীন কুকি রাজ্যের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করে আসছে। এ বছরের এপ্রিলে সরকারের সঙ্গে চলমান শান্তি প্রক্রিয়ার আলোচনার পথ বন্ধ করেই অরাজকতা, ব্যাংক ডাকাতি ও নিরাপত্তারক্ষীদের অস্ত্র লুটের ঘটনার পর থেকে সংগঠনটির কমকাণ্ড নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে সর্বস্তরের জনগণ।
বম সন্ত্রাসীদের কথা ও কাজের ফারাক স্পষ্টই দৃশ্যমান। পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণে মদত এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে একাধিকবার সংঘর্ষেও লিপ্ত হয় সংগঠনটি। পাশাপাশি নিজেদের সামরিক অবস্থান জানান দিতে শুরু থেকেই পাহাড়ে সশস্ত্র অবস্থানে রয়েছে তারা। মিয়ানমারে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে তাদের স্বজাতি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। আর বান্দরবান সীমান্তের মিয়ানমারের চিন প্রদেশ তাদের শক্তিশালী ঘাঁটি। এর মধ্যেই হঠাৎ করে স্বায়ত্তশাসন দাবিতে সশস্ত্র অবস্থান–বড় ধরনের কোনো পরিকল্পনা নিয়েই কাজ করছে সংগঠনটি বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকেরা সংগঠনটিকে বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির কিছু অংশে বসবাসরত লুসাই জাতীয় কুকি জনগোষ্ঠীর সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অনিচ্ছুক। তাদের দাবি এটি কোন কুকি জনগোষ্ঠীর সংগঠন নয়। শুধুমাত্র বিপদগামী বম যুবকদের দ্বারা সংগঠনটি গঠিত। কোন অশুভ শক্তির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সংগঠনটি কুকি জনগোষ্ঠীর পরিচয় ধারণ করেছে। অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয় তা সংগ্রহ করতে চাঁদাবাজি ও খুনের মত নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এছাড়াও তাদের নাথান বমসহ কিছু শীর্ষ নেতা বিদেশে অবস্থান করে ব্যক্তিগত স্বার্থে বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে তারা নিজেদের কুকি জনগোষ্ঠীর সংগঠন পরিচয় দিচ্ছে! এর ফলে মানুষের মধ্যে বিরূপ ধারণা তৈরি হচ্ছে সংগঠনটি নিয়ে। কিন্তু স্থানীয় জনগোষ্ঠী, রাজনৈতিক নেতা ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এটি বম সম্প্রদায়ের সৃষ্ট সন্ত্রাসী সংগঠন। তারা এমন কিছু সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করেছে যা তাদের বম সম্প্রদায়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। সর্বস্তরের মানুষ তাদের প্রতি ঘৃণা জানাচ্ছে। এই অপকর্ম দামাচাপা দিতেই তারা কুকিসহ উপজাতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা বলছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসান আল শাফী বলেন, ‘তারা বিভিন্নভাবে ইস্যুটাকে সাংস্কৃতিকভাবে লালন করে এসেছে। কুকি-চিন নাম দেয়ার কারণ হতে পারে, এর মধ্য দিয়ে তারা হয়তো একটি বৃহত্তম প্লাটফর্ম তৈরি করতে পারবে। কুকি-চিন বার্মাতেও আছে, ভারতের মিজোরাম, মণিপুর, ত্রিপুরা—এসব জায়গায়ও কুকি-চিন ভাষাভাষী আছে। সেজন্য বমরা সংখ্যায় মাত্র কয়েক হাজার হলেও এটা যখন কুকি-চিন নাম দেয়া হবে, তখন তা সংখ্যায় বেড়ে যাবে। অন্যান্য কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর কাছ থেকেও তারা হয়তো বড় একটা সমর্থন পাবে। সেক্ষেত্রে তাদের পক্ষে হয়তো প্রতিবেশী দেশের এ ভাষাগোষ্ঠীর আওতাভুক্তদের মোবিলাইজ করা যাবে। সেজন্যই হয়তো তারা কুকি-চিন নাম দিয়ে রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরি করেছে।’
বম সন্ত্রাসী সংগঠনটি নিয়ে কুকি জনগোষ্ঠীর নেতৃদ্বয় বলছেন, বম সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নেই। এই সংগঠন তাদের কুকিভুক্ত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেনা। বম সন্ত্রাসীদের কোন অপকর্মের দায়ভার তারা নিবেনা। তারা বম সন্ত্রাসীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে বারবার অনুরোধ জানিয়েছেন। সভা-সমাবেশের মাধ্যমে বিষয়টি তারা স্পষ্ট করেছেন।
আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে, একটি ক্ষুদ্র বম সম্প্রদায়ের কিছু বিপদগামী যুবকের ফাঁদে পড়ে আমরা যেন তাদের কুকি-চিন বলে প্রকৃত কুকি-চিন জনগোষ্ঠীকে অসম্মান না করি।