বম বা বমজো বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়। বমরা মিয়ানমারের চিনভিত্তিক লাই জনগোষ্ঠীর (মিয়ানমারে চিন ও ভারতে পাওয়ি নামে পরিচিত) অন্তর্ভুক্ত। উৎপত্তি মিয়ানমারে হলেও সেখানেই এখন সবচেয়ে কমসংখ্যক বমদের দেখা পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে। পার্বত্য বান্দরবান জেলার চারটি উপজেলা ও রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়িসহ ৫টি উপজেলাতে এই বম জনগোষ্ঠীর বসবাসের দেখা মিলে। তারা একটি ‘শান্তিপ্রিয় বম জনগোষ্ঠী’ হিসেবে পরিচিত। নিজেস্ব সংস্কৃতি ঐতিহ্যের ধারক বাহক বমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন উজ্জ্বল করেছে। বৈচিত্র্যময় বম জনগোষ্ঠীর রয়েছে কুষ্টিকালচার, বাঁশ নৃত্য ও নানা ঐতিহ্য। বমদের সাথে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিরোধ থাকলেও বাঙালিদের সঙ্গে ছিল অনেক আগ থেকে সুদৃঢ় সম্পর্ক। পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বম জনগোষ্ঠী ও বাঙালিরা এক সম্প্রীতির মেলবন্ধন তৈরি করেছে। রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি ও বান্দরবান সদরের বম জনগোষ্ঠী অনেক শান্তিপ্রিয় ও অতিথিপরায়ণ হিসেবে নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার রেখেছে। আকস্মিক কেন শান্তিপ্রিয় বম জনগোষ্ঠীর মধ্যে অশান্তির দাবানল?
জানা যায়, বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার ২ নং রুমা সদর ইউনিয়নের ইডেনপাড়ার বাসিন্দা মৃত জাওতন লনচেওর ছেলে নাথান লনচেও বম। বাবা পেশায় জুমচাষি। মা মৃত রৌকিল বম গৃহিণী। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে নাথান ছোট। নাথানের মধ্যে আকস্মিক জেগে উঠে জেএসএস সন্তু তথা চাকমা বিরোধিতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদ ধারণা। এই থেকে শতাধিক সদস্য মিয়ানমারের কাচিন ও কারেন প্রদেশ এবং ভারতের মণিপুর রাজ্যে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় ২০১৯ সালে ফিরে আসে। গত ২০২২ সালের ২৪ জুলাই বম সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) বা বম সন্ত্রাসীদের সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার আল ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার যোগাযোগের নতুন তথ্য সামনে আনে র্যাব। এরপর শুরু হয় তাদের বিরুদ্ধে অভিযান।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা যায় বান্দরবানের রুমা সীমান্ত ও মিজোরাম সীমান্তের জাম্পুই পাহাড়ে এর সশস্ত্র ও নিরস্ত্র মিলিয়ে কেএনএফের সশস্ত্র শাখা কেএনএর ৬০০-এর বেশি সদস্য আছে। তাঁরা চাঁদাবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে পুরো জেলায় আতঙ্ক তৈরি করেন। রুমা ও থানচি উপজেলায় তাঁদের উৎপাত বেশি। স্থানীয়রা বলছে, নামান বমের নেতৃত্বে বমদের মধ্য হইতে কিছু বিপদগামী যুবক পাহাড়ের শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্ন ঘটাতে উক্ত বম সন্ত্রাসী সংগঠন গঠন করে। সংগঠনটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ২টি জেলার ৯টি উপজেলা নিয়ে স্বায়ত্তশাসন দাবি করছে!
তাদের এই দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও খামখেয়ালি। যার ফলে ‘শান্তিপ্রিয় বম জনগোষ্ঠী’ অশান্তির দাবানলে।
বম সন্ত্রাসীরা কুকি-চিন জাতীয়তাবাদী ধারণাকে সামনে নিয়ে আসার সম্ভাব্য কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নৃবিজ্ঞানীরা বলছেন, বম জনগোষ্ঠী সংখ্যার দিক থেকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র। বাংলাদেশে বমদের মোট জনসংখ্যা ১৩ হাজার ১৯৩ বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ আদমশুমারির তথ্যে উঠে এসেছে। আরো বৃহৎ পরিসরে কার্যক্রম চালানো এবং সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্য থেকেই কেএনএফের মতো সংগঠনগুলো এখন কুকি-চিন গোত্রভুক্ত নৃগোষ্ঠীগুলোর সম্মিলিত জাতীয়তাবাদী ধারণাকে সামনে নিয়ে আসছে। বম সন্ত্রাসীরা মূলত কুকি-চিন জনগোষ্ঠী পরিচয়কে ব্যবহার করে বিশেষ কোন উদ্দেশ্য হাসিলে এমনটা করছে বলে মনে হচ্ছে।
বম সন্ত্রাসীরা নিজেদের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দাবি করলেও তারা যে বম জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেনা তার প্রমাণ বম সোশ্যাল কাউন্সিলের বক্তব্য:
গত ১১ মে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে বান্দরবান শহরের নিউ গুলশান এলাকার বাংলাদেশ খ্রিষ্টান চার্চ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভার পর ভিডিওবার্তায় বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি লাল জারলম বম, জানিয়েছেন, বম সন্ত্রাসী (কেএনএফ) সন্ত্রাসী তৎপরতার কারণে বম সম্প্রদায় অধ্যুষিত পাড়াগুলোতে এখন খাদ্য সঙ্কটসহ প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সেখানকার লোকজন এখন জুম চাষ করতে পারছে না, বাগানে উৎপাদিত ফল বিক্রি করতে পারছে না। এ অবস্থায় আমরা কেএনএফের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি তারা যাতে অবিলম্বে ব্যাংকের লুট হওয়া ১৪টি অস্ত্র ফেরত দেয়। এছাড়া সন্ত্রাসী তৎপরতা ছেড়ে তারা যাতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। আর যদি তারা তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায় তবে তাদের বিরুদ্ধে গ্রামে গ্রামে সাধারণ বম সম্প্রদায় প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। ইতোমধ্যে ২০০ যুবক প্রতিরোধে অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। বম সোশ্যাল কাউন্সিলের নেতৃবৃন্দ আরো জানিয়েছেন কেএনএফ অস্ত্র ফেরত দিয়ে আলোচনায় বসতে চাইলে বম সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ সহায়তা করবে এবং আলোচনার জন্য সরকারের দুয়ার সব সময় খোলা রয়েছে।
বম সোশ্যাল কাউন্সিলের বক্তব্য এটাই প্রমাণ করে যে, বম সন্ত্রাসীরা শান্তিপ্রিয় বম জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেনা। সব বম সন্ত্রাসী নয় তাদের কিছু অংশ উগ্র চেতনাবাদী ধারণা থেকে পাহাড়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। এবং নিজেদের বম জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি দাবি করছে। যা উদ্দেশ্য প্রণোদীত।