শান্তি চুক্তির পরেও পাহাড়ে অশান্তির কারণ কী?

0

তাপস কুমার পাল, খাগড়াছড়ি:

শান্তি চুক্তির প্রেক্ষাপট ও চলমান বাস্তবতার আলোকে বিশ্লেষণধর্মী পর্যালোচনা।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন করে দানা বাঁধে কাউন্টার ইনসাল্টেন্সি তথা আঞ্চলিক সহিংসতা।পাহাড়ে দীর্ঘ দুই দশক ধরে চলমান সংঘাত-সহিংসতা ও যুদ্ধে প্রচুর পরিমাণ প্রাণহানি ঘটে উপজাতি-বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের। বিপর্যস্ত পাহাড়ের পরিস্থিতি পরিবেশ ব্যাপক অশান্ত হয়, সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি আর বারুদের গন্ধে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠে। সারিবদ্ধ লাশ ও রক্তের হোলি খেলায় এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয় যা তৎকালীন সময়ে এখানকার মানবতার বিপর্যয় ডেকে আনে।

মানবতার বিপর্যয় এড়াতে ও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির সুবাতাস ছড়াতে একটি চিহ্নিত সন্ত্রাসীগোষ্টীকে নির্মূলের জন্য বল প্রয়োগ না করে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির স্বাক্ষর করেছিল তা বিশ্বমহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে।

যদিও বাঙালি সম্প্রদায়ের দাবি চুক্তির বেশিরভাগ ধারা মূল সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ও একতরফাভাবে উপজাতি আঞ্চলিক দলগুলো ও তাদের সমর্থনপুষ্ট সন্ত্রাসী আর্ম গ্রুপ /গোষ্ঠীকেই প্রাধান্য দিয়ে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদিত করা হয়েছে। উপজাতীয়দের মধ্য থেকেও খোদ সন্তুর জেএসএস এর একাংশ চুক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে ইউপিডিএফ গঠন করে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে।

বাঙালি নেতারা বলছে-

পার্বত্য বাঙালিদের মৌলিক অধিকার হরণ করে একতরফাভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জেএসএস তথা সন্তু লারমার শান্তিবাহিনীর সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন অনেকটা বিতর্কিত।
বাঙালি নেতাদের দাবি যৌক্তিক মনে হলেও সরকারের উদ্দেশ্য ছিল উপজাতিদের কিছুটা ছাড় দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়ন করে পাহাড়ে রক্তপাত বন্ধ করা, সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ করা এবং অবৈধ অস্ত্র পরিহার করে উপজাতিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর থেকে আজ অবধি সময়কাল বিবেচনায় আনলে শান্তিচুক্তি অনেকটা অর্থহীন মনে হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, চুক্তির দীর্ঘ দুই যুগ অতিক্রম করার পরও সে পূর্বেকার ন্যায়ে পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রধারী বিদ্যমান।শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর কারী খোদ জেএসএস ও অস্ত্রবাজী পরিহার করেনি।তারা চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, অপহরণ, খুন-গুম ও রাষ্ট্র বিরোধী তৎপরতা হরহামেশাই করে থাকে প্রশাসনের নাকের ডগায়।
তবে সরকার সহনশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে চুক্তির বেশিরভাগ ধারা বাস্তবায়ন করলেও জেএসএস তা অস্বীকার করে আসছে।

শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে সরকার।শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের সামান্য পরিসংখ্যান-

চুক্তির পর রাস্তাঘাট হয়েছে ৩৫৯০.৫ কিলোমিটার, হাইস্কুল ৪০৪টি, কলেজ ২৬টি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৩টি, মেডিকেল কলেজ ১টি, হাসপাতাল ১২১টি, বৌদ্ধ উপাসনালয় ৫৯০টি, খ্রিস্টান গির্জা হয়েছে ৩৩৮টি, হিন্দু মন্দির ১৭৯টি, মসজিদ ৭২৩টি, শিল্প কলকারখানা ২৭টি, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প ৫০৩৩টি। সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-২৩টি এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক নিয়মিত সহায়তা প্রদান করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৫৮টি।

এরপর শিক্ষা-চাকরি এবং কোটা সুবিধার মাধ্যমে উপজাতীয়দের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছে।

সরকারের পক্ষ হতে শান্তিবাহিনীকে দেয়া শুধুমাত্র একটি শর্ত ছিলো ‘অবৈধ অস্ত্র পরিহার করা’। এই একটি মাত্র শর্ত অবৈধ অস্ত্র পরিহার তাও বাস্তবায়ন করেন নি জেএসএস সভাপতি সন্তু লারমা! ৪ খন্ডের পার্বত্য চুক্তির বেশিরভাগ শর্ত বা ধারা শান্তিবাহিনীর পক্ষে। তার পরেও সন্তু লারমার লালিত সন্ত্রাসীরা অবৈধ অস্ত্র পরিহার করেন নি। অবৈধ অস্ত্র পরিহার না করার বিষয়টি সন্তু লারমা নিজেই ২০১৩ সালে বেসরকারি টিভি চ্যানেল ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের সাংবাদিক শামীমা বিনতে-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অকপটে স্বীকার করে অহংকারের সাথে বলেন, “আমরা চুক্তির সময় সম্পূর্ণ অস্ত্র জমা দেইনি। আমাদের এখনো কয়েকশো সশস্ত্র জনবল রয়েছে!”

সন্তু লারমার এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বলা যায়, জেএসএস পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সুবিধা গ্রহণ করলেও চুক্তির বরখেলাপ করেছে।

শন্তু লারমা প্রকাশ্যে শান্তিচুক্তি বিরোধী এমন বক্তব্য দেয়ার পরও আমাদের সমতলের অনেক তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল নামধারীদের কর্ণকুহরে তা পৌছায় না।তাদের কাছে যা পৌছায় তা হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির মূল “বাঙালি ও সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ।

বুদ্ধি বিক্রিকারি তথা বুদ্ধিজীবিদের অভিযোগ বানোয়াট যার প্রমান একটু ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলেই দেখা যায়। ১৯৪৭-শে বৃটিশরা যখন ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে যায় তৎসময় ভারত হতে ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের অংশে পড়ে। তৎকালীন এই নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত চাকমা ও মারমা সম্প্রদায়ের কথিত রাজারা তার বিরোধীতা করে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারত ও মায়ানমারের পতাকা উত্তোলন করেন!

পূর্ব পাকিস্তানের পার্বত্য চট্টগ্রামেকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার পক্ষে ছিল উপজাতি নেতৃত্বশ্রণী। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট সকালে জনসমিতির নেতা স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বে রাঙামাটি ডিসি অফিস ও কোতোয়ালি থানায় ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। অন্যদিকে বান্দরবানেও বোমাং রাজ পরিবারের নেতৃত্বে বার্মার পতাকা উত্তোলন করা হয়। কিন্তু বেলুচ রেজিমেন্ট সশস্ত্র শক্তির জোরে ভারতীয় পতাকা এবং বার্মার পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় । তখন কিন্তু বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়নি। যদিও সুযোগ-সুবিধা পেয়ে এবং আত্মীয় বন্ধনের ফলে পরবর্তীতে আত্মস্বীকৃত রাজাকার ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের অনুসারী হয়ে যান। ১৯৭১ সালে যুদ্ধে ত্রিদিব রায় বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান করে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন৷ তার এ ভূমিকার কারণে পাকিস্তান সরকার তাকে নিরাস করেন নি। তাকে মন্ত্রী ও কূটনীতিক পদমর্যাদা প্রদান করে। বিষয়টি সকলেরই জানা। এ নিয়ে বিশদভাবে ব্যাখা করার যৌক্তিকতাও নেই।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে যখন নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ব্যস্ত ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধুর ৭২ সংবিধানকে অস্বীকার করে নিজেদের আবির্ভাবের জানান দেয় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এমএন লারমা) অথাৎ সন্তু লারমার আপন বড় ভাই। ১৯৭২ সালে ভারতের সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে জন সংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস বা জেএসএস) এবং তার সশস্ত্র শাখা তথাকথিত শান্তিবাহিনী আত্মপ্রকাশ করে। বিষয়টি পরিষ্কার হয় ১৯৭৩ সালে। পরবর্তীতে আরো পরিষ্কার হয়, ১৯৭৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের স্থাপনা যেমন বনবিভাগের উপর হামলা করে শান্তিবাহিনী নিজেদের জানান দেয়।
আজকের তথাকথিত ভূমি পুত্র (আদিবাসী দাবিদার) ‘উপজাতি’ যারা ভারত, বার্মার ও মঙ্গোলীয় অঞ্চল হতে বিতাড়িত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমণ করেন, তাদর আগমণের পূর্ব হতে কার্পাসমহল ও কাপ্তাই এলাকায় বাঙালির বসবাস ছিল।

অথচ সমতলের কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল, জ্ঞানপাপী, বুদ্ধিবিক্রি করা মহলটি বারবার অভিযোগ করে আসছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির মূলে বাঙালি ও সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ!

শান্তিচুক্তির পরেও পাহাড়ে অশান্তির মূল কয়েকটি কারণ হলো-

১)উপজাতি সন্ত্রাসীরা চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও তারা তা বাস্তবায়নে আন্তরিকতা দেখাচ্ছে না।

২)সমতলের কিছু বুদ্ধিজীবী নামক পরজীবি পার্বত্য ইস্যু জিইয়ে রেখে রুজিরোজগারের ব্যাবস্থায় ব্যাস্ত।

৩)সন্ত্রাসীদের নির্মূলে অতি কৌশল অবলম্বন করতে গিয়ে সরকারের শৈথিল্য মনোভাব দেখানো।

৪)উপজাতিরা তাদের পূর্বসূরীদের (জুম্মল্যান্ড রাষ্ট্র গঠন)ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বাংলাদেশ অন্তরে লালন করতে না পারা।

আগের পোস্টছাত্র আন্দোলনের সুযোগ নিচ্ছে ইউপিডিএফ সহ অন্যান্য আঞ্চলিক দল।
পরের পোস্টআঞ্চলিক দলগুলোর আদর্শগত পার্থক্য কী?

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন