হাতিয়ার এক ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীর নাম চরঈশ্বরের রাশেদ মেম্বার।

0
322

মোঃ সোহেল রিগ্যান বিশেষ প্রতিবেদক-নোয়াখালী জেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া। নোয়াখালী থেকে হাতিয়াতে একমাত্র যাতায়াত পথ হচ্ছে নৌপথ। দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল করা এই জনপদের মানুষদের দুর্ভোগের সীমার শেষ নেই। জানা যায় এ দ্বীপে রয়েছে প্রায় ৭ লক্ষাধিক মানুষ। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আগে এই দ্বীপের ৭ লক্ষ মানুষ ছিল পরাধীনতার শিকলে বন্দী। দরবেশ বাবার অনুমতি ছাড়া এই দ্বীপ থেকে জেলা সদরের উদ্দেশ্য কোন নৌযান— ট্রলার, স্পীড বোট ছেড়ে যাওয়া ছিল অসম্ভব। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে নিজেদের টাইম অনুযায়ী ছাড়া হত এসব। এই নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে গণধোলাই ও অপদস্ত করা হত। অনেক সাংবাদিক হামলা ও অপদস্তের শিকার হয়েছেন। এমন পরিস্থিতি ছিল হাতিয়ার নলচিরা ঘাট ও চেয়ারম্যান ঘাটে। এমন এক দানব বা কথিত বড় হুজুর নামক দরবেশ বাবা ছিল এখানকার সবকিছুর নিয়ন্ত্রক৷ তার ক্যাডার বাহিনী ঘাটসহ হাতিয়ার সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। যার কারণে এখানকার মানুষগুলো দীর্ঘ বছর যাতায়াত নিয়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হয়ে আসছেন।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই দরবেশ বাবা ও তার দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছু কিছু অন্তরালে চলে যান৷ সারাদেশের ন্যায় হাতিয়াও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু দুঃখজনক যে, দীর্ঘদিন হাতিয়াতে বড় হুজুরের মাফিয়া শাসনের ফলে এখানকার বিরোধী রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন মতাদর্শী নেতাকর্মীরা ভয়ে আতঙ্কে পালিয়ে ছিল, আবার অনেকেই আঁতাত করে ছিল! রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে এখানকার মাফিয়া নেতাদের শীর্ষ কিছু অন্তরালে গেলেও দুঃখজনক যে, তার বড় একটি অংশ এখনো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যদিও তাদের উপর ও ব্যবসা বাণিজ্যের উপর কোনপ্রকার হামলার ঘটনা ঘটেনি। তারা বিতাড়িত হওয়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। সারা দেশে আওয়ামীলীগ সমর্থিত জনপ্রতিনিধিরা পালিয়ে বেড়ালেও দরবেশ বাবা মদদপুষ্ট অনেক জনপ্রতিনিধি স্বপদে বহাল আছেন। ৫ নং চরঈশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নং ওয়ার্ডের রাশেদ মেম্বার (প্রকাশ শীর্ষ সন্ত্রাসী রাশেদ মেম্বার) এখনো স্বপদে বহাল আছে এবং এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন! বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছে স্থানীয়রা।

স্থানীয় জাহেদুল ইসলাম রত্ন বলেন, রাশেদ মেম্বার চরঈশ্বর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ৬নং ওয়ার্ডের মেম্বার। এই ক্ষমতার দাপটে সে এলাকায় দীর্ঘদিন থেকে আধিপত্য বিস্তারের অংশ হিসেবে সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী ঘটে তোলেন। তার অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন, হামলা ও মামলায় অসহ্য ছিল এখানকার জনপদের কয়েক হাজার বাসিন্দা।

খাসেরহাট এলাকার বাসিন্দা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জানান, রাশেদ মেম্বার সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে প্রকল্পের পুরো অর্থ আত্মসাৎ করতেন। টিআর কাবিখা, ভিজিটি কার্ড, বয়স্ক ভাতা, জেলেদের জন্য সহায়তাসহ সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আত্মসাৎ করতেন। জাল চেয়ারম্যান সনদ দিয়ে টাকা আদায় করতেন। তার দাপটে সম্পূর্ণ অসহায় ছিল খাসেরহাট, ভেরারোড, বদিরহমান গ্রাম, বাংলাবাজার, বাধাঁরের গোড়া ও নন্দরোড এলাকায় কয়েক হাজার বাসিন্দা।

স্থানীয় মান্যগন্য ব্যক্তিরা জানান, রাশেদ মেম্বার, এলাকায় সালিশ-বিচারের নামে মোটা অংকের টাকা জমা রেখে তা আত্মসাৎ করতেন। এমনকি কেউ তার বিচার মানতে অবাধ্য হলে তাকে তার ক্যাডার বাহিনী লাগিয়ে মারধর করতেন। তার বিচারের রায় সবসময় প্রভাবশালী মহলের দিকে। এমন অসংখ্য অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে৷ এতদিন শুধুমাত্র আওয়ামীলীগের ক্ষমতা ও দরবেশ বাবার প্রভাব খাটিয়ে টিকে ছিলেন।

স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাশেদ মেম্বার হাতিয়ার নলচিরা থেকে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে খাসেরহাট ভেরারোড সংলগ্ন এলাকায় বসিতস্থাপন করেন। পার্শ্ববর্তী ওয়ার্ড থেকে একাধিকবার নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে বিপুল ভোটে পরাজিত হন। পরবর্তীতে দরবেশ বাবার দোয়া নিয়ে ৬নং ওয়ার্ড থেকে মেম্বার নির্বাচিত হন। এই নির্বাচিত হওয়ার পর তার জীবনের ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে যায়৷ জানা যায় পরপর দু’বার মেম্বার নির্বাচিত হওয়ার পর রাশেদ মেম্বার এলাকায় বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি ও ব্যাংক ব্যালেন্সের মালিক বনে যান। মৎস্য ঘের, বাগান বাড়ি ও নান্দনিক ঘরবাড়ি এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যাল এলাকায় কিনেন জমি। যাকে বলে আলাদ্দিনের চেরাগ পাওয়া।

এই রাশেদ মেম্বার ৬নং ওয়ার্ডের মেম্বার হলেও তার পার্শ্ববর্তী ৫ নং ওয়ার্ডে হস্তক্ষেপ করতেন। বিচারের নামে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনপদের মানুষদের জীবনযাত্রার মান ব্যাহত করেন। সন্ত্রাসী রাশেদ মেম্বার নির্যাতনের শিকার হন অন্তত দুই শতাধিক মানুষ৷ তার ক্ষমতার দাপট আর অশালীন আচরণ মানুষকে হতভম্ব করে। তবে রবীন্দ্র মেম্বার হত্যার ঘটনায় মাস্টার মাইন্ড হিসেবেও পরিচিত এই রাশেদ মেম্বার। এমনটা বলেছে অনেকেই। তার এসব কর্মকাণ্ড দুঃখজনক এবং নিন্দনীয় বটে। তবে তার উত্থান যেভাবে হয়েছে সেভাবেই তার বিনাশ হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, রাশেদ মেম্বার একজন অকৃতজ্ঞ এবং বেইমান ও মুনাফেক প্রকৃতির লোক। তার পরিবারের সদস্যের মধ্যে বেশিভাগ ভালো কিন্তু সে একজন খারাপ প্রকৃতির মানুষ হিসেবে তার পরিবারের অবস্থান নষ্ট করেছে বলে মানুষদের অভিমত। অকৃতজ্ঞ কাজ এবং চুরি-ডাকাতি ও চাটুকারিতার জন্য একাধিকবার হামলার শিকার হলেও নিজেকে পরিবর্তন করতে পারেননি।

আরো জানা যায়, হাতিয়ার প্রায় এলাকায় ১৫ বছর ধরে চলছিল একনায়কতন্ত্র। দরবেশ বাবার শাসন আমলে এখানকার অযোগ্য ব্যক্তিরা মেম্বার, চেয়ারম্যান, মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বর্তমানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরেও অনেক জনপ্রতিনিধি স্বপদে বহাল আছেন দাপটের সঙ্গে৷ এখানকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা কোনঠাসা এবং আঁতাত করে চলার কারণে এখনো স্বৈরাচারের প্রভাব মুক্ত হয়নি!

একটি সূত্র বলছে, রাশেদ মেম্বার এলাকায় কিছু নেতা ও পাতিনেতার সঙ্গে সমঝোতা করে পুনরায় নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে চেষ্টা করছে৷ এজন্য লাখ লাখ টাকা নিয়ে মুখিয়ে আছেন। তবে তার উপর নজরদারি অব্যাহত আছে পর্যবেক্ষক মহল থেকে।

রাশেদ মেম্বারের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিষয়টি নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, রাশেদ মেম্বার বর্তমানে পালিয়ে বেড়াচ্ছে৷ বিগত সময়ে সে যেসকল মানুষদের উপর হামলা ও নির্যাতন চালিয়েছে তারা হয়তো মামলা দিবে। তবে এই মেম্বারের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে এর আগেও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা ছিল৷ অনেকবার জেলও খেটে ছিল৷ তার মত এমন ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী ব্যক্তি কীভাবে জনপ্রতিনিধির আসনে আসীন আছেন তা আমার বোধগম্য নয়।

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে, এমন ব্যক্তিরা জানান৷ রাশেদ মেম্বার সত্যি একজন মানবতা বিরোধী ব্যক্তি। তার নৈতিক মূল্যবোধ নেই। সরকার প্রদান করা জেলেদের চাউল পর্যন্ত আত্মসাৎ করেছেন। বিচারের নামে মানুষদের ধরে এনে নির্যাতন করেছেন৷ মাদক চোরাকারবারি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে এলাকার যুব সমাজ ধ্বংস করেছেন। যাকে যেখানে পেয়েছে সেখানে হামলা করেছে নৃশংসভাবে। সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর হামলা করেছে। যা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।

রাশেদ মেম্বার বিরুদ্ধে আনীত এসব অভিযোগ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

মুক্তমত লেখক: মানবাধিকার কর্মী, লেখক ও সাংবাদিক মোঃ সোহেল রিগ্যান 

আগের পোস্টপার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দলের কর্মকান্ডে সাধারণ মানুষের কান্না।
পরের পোস্টখাগড়াছড়ির ভয়াবহ বন্যায় নিশ্চুপ রানী ইয়েন ইয়েন।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন