আঞ্চলিক নেতারা কতটা স্বার্থপর বর্তমান বন্যাই তার উদাহরণ।পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পক্ষ সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) এবং চুক্তির বিরোধী পক্ষ প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)সহ অন্যান্য আঞ্চলিক দলের নেতাকর্মীরা যে স্বার্থপর ও মানবতার বিরোধী তা কিন্তু পাহাড়ের বন্যাই তার উদাহরণ।
পাহাড়ে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনে। আঞ্চলিক দলগুলোর নেতারা বন্যায় নীরবতা পালনে পাহাড়ীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়িরা বলছে, পাহাড়ের মানুষ সংগতভাবে আশা করে, জাতির অধিকারে কাজ করা দলগুলো থেকে তারা তাৎক্ষণিক সহযোগিতা পাবে। তাই বন্যায় বিপন্ন মানুষ তাকিয়ে ছিল তাদের দিকে। খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও নিত্য প্রয়েজনীয় জিনিসের সংকট সময় তাদের আশা ছিল তা পূরণ করবে আঞ্চলিক দল। কিন্তু নেতাদের ভূমিকা পাহাড়ীদের হতাশ করেছে। তারা যে শাসন-শোষণ করে বিষয়টি ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে।
কেন আঞ্চলিক নেতাদের স্বার্থপরতাকে দায়ী করছে পাহাড়িরা? জানা যায়, গত ২০ আগস্টে থেকে পর্যটন শহর খাগড়াছড়ির সমতল ও নিচু এলাকাগুলো টানা কয়েকদিন পানির নিচে ছিল। প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ভেসে গেছে খেতখামার ও মাছের পুকুর। ডুবে ছিল বিস্তীর্ণ এলাকার বসতবাড়ি। জেলা শহরের সঙ্গে বিভিন্ন এলাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। স্থানীয়রা বলছিলেন, গত ২২ বছরের মধ্যে এমন ভয়াবহ বন্যা দেখেননি তারা। জেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়। জেলার ৯টি উপজেলায় পানিবন্দী হয়েছিল কয়েক হাজার পরিবার। প্রবল বর্ষণের পাশাপাশি শহরে হঠাৎ পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকে পড়ে। এতে শহরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছিল পাহাড়ধস। মহালছড়ির লেমুছড়ি, মাইসছড়ি ও ২৪ মাইল এলাকায় পানি বেড়ে খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি সড়কে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছিল। সাজেকে বন্যা ও পাহাড় ধসের ঘটনায় পর্যটকসহ স্থানীয়রা আটকা পড়ে। বাঘাইছড়ি ও দীঘিনালার মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। বেশিভাগ মানুষের অভিযোগ তাদের সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসেনি।
জানা যায়, পানি নেমে যাওয়ার ১৩ দিনেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি খাগড়াছড়ি জেলার ক্ষতিগ্রস্তরা। তারা এখন কি করবেন তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীন। জেলায় প্রায় ১ লক্ষাধিক পরিবার কমবেশি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেকেরই কাঁচা ও আধাপাকা ঘর বানের পানিতে ভেসে যায়। অতিস্রোতে রাস্তা ও সেতুর ক্ষতি হয়েছে। তারা যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে অনুযায়ী সাহায্য মেলেনি।
এছাড়াও বন্যার কারণে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় কৃষি খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) খাগড়াছড়ি জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক ও ডিএই রাঙ্গামাটির উপপরিচালক বলেন, দুই জেলার কয়েকটি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে ৫ হাজার ২০৪ হেক্টর কৃষি জমি তলিয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে ২৪ হাজার ৭৩৫ টন ফসল। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১ কোটি ১১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। বন্যায় এ দুই জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ২৩ হাজারের বেশি।
নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার পর পাহাড়ি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় শিবিরে ছুটে আসেন। বিশুদ্ধ খাবার পানি ও ত্রাণের সংকট ছিল চোখে পড়ার মত।
সংবাদকর্মীরা বলছিলেন, খাগড়াছড়ির ৯টি উপজেলা ও রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, লংগদু ও কাপ্তাই নদীর তীরে বসবাসরত মানুষ একপ্রকার মানবিক সংকটে পতিত হন।
পাহাড়ের বেশিরভাগ মানুষ কৃষি নির্ভর। তাদের জমির ফসল নষ্ট হওয়ার কারণে তারা বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হই। আঞ্চলিক দলগুলো সারাবছর তাদের থেকে গণচাঁদা ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করলেও তাদের সংকটে পতিত সময়ে সাহায্যে এগিয়ে আসছেনা।
চেঙ্গী, মাইনি ও ফেনী নদীর পানি প্রবল বর্ষণে জেলার চেঙ্গী নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এতে ভয়াবহ বন্যায় মানুষ পতিত হয়৷ এই বন্যায় এখানকার পাহাড়ি মানুষগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার। তাদের উদ্ধার করে আশ্রয় শিবিরে নেওয়া এবং খাবার সরবরাহে আঞ্চলিক দলগুলোর এমন নীরব ভূমিকা দলের নেতাদের উপর চরম ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছে। পিয়াল চাকমা নামে দীঘিনালার বাসিন্দা বলছেন, “আঞ্চলিক দলগুলো তাদের সঙ্গে বেইমানি করেছে। সারাবছর তাদের শাসন-শোষণ করেছে, অধিকার দাবির অন্তরালের নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য আদায় করেছে কিন্তু তাদের ভোগান্তির সময় সহযোগিতা করেনি। এতে প্রমাণিত হয় দলগুলো নিজেদের স্বার্থে পাহাড়ীদের সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। সম্প্রীতি ভয়াবহ বন্যা আঞ্চলিক দলগুলোর প্রতারণা উন্মোচিত হয়েছে।”
উপরোক্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এই বন্যার ভয়াবহতা ২০০২ সালের বন্যা কে ছাড়িয়ে গেছে। এই মানবিক সংকট মূহুর্তে পাহাড়ি আঞ্চলিক দলের নেতারা পাহাড়িদের খোঁজখবর নেননি। এই স্বার্থপরতা প্রমাণ করেছে পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠন গুলোর নেতাদের মানবিক মূল্যবোধ তলানিতে।
অথচ এই আঞ্চলিক দলের নেতারা সংকটে মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত হতে পারতেন কিন্তু তারা অর্থ ও স্বার্থের কাছে জাতির দুর্দিনে এগিয়ে না এসে নিজেদেরকে স্বার্থপর হিসেবে খাতায় নাম লিখিয়েছেন।
আমরা পাহাড়ে আঞ্চলিক দলগুলোকে পাহাড়ীদের অধিকার বিষয়ক নানা দাবিদাওয়া রাস্ট্রের কাছে উত্থাপনের আন্দোলন দেখি। অথচ যে পাহাড়িদের জন্য এই আন্দোলন সেই পাহাড়িরা কয়দিন আগেও জীবনমৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল তখন তাদের বাঁচাতে ত্রাণের ছিটাফোঁটা নিয়েও এগিয়ে আসেনি পাহাড়ি আঞ্চলিক দলগুলোর নেতারা!
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাঘাইছড়ি সাজেকের এক কার্বারী বলেন, সংগঠনগুলো পাহাড়ীদের অধিকারের কথা বলে সৃষ্টি হলেও তারা নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থ নিয়েই আছে। ভয়াবহ বন্যাই পাহাড়ি নেতাদের নীরবতা ভূমিকা থেকে অনেক কিছুই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু পাহাড়িরা অস্ত্র ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। তাই পাহাড়িরা এসব নিয়ে প্রকাশ-গোপনে কথা বলেন না।