বাংলাদেশের উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষদের একটি অংশ বিগত বছরগুলোতে নিজেদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে বিচ্ছিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে সীমিত থাকলেও সম্প্রতিকালে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। যার ফলশ্রুতিতে দেশের অনেক কিছু সংস্কারের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, সংবিধান সংস্কার করা হবে৷ সংবিধানে বর্ণিত সম্প্রদায়দের মানুষদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি রয়েছে। এরপরও নিম্ন বিবৃত মহলের প্রলোভনে সম্প্রদায়গুলোর মানুষদের একটি অংশ আদিবাসী শব্দটি সাংবিধানিক স্বীকৃতির পক্ষে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি তারা দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও তথাকথিত গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে শব্দটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নানা তৎপরতা ও কূটনীতিক দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে।
বাংলাদেশ প্রায় ৫০টি উপজাতি জনগোষ্ঠীর বসবাস। এসব উপজাতি প্রায় দুশো থেকে তিনশো বছর ধরে এ ভূখন্ডে বসবাস করে। তাদেরকে সবসময় উপজাতি হিসেবে সম্বোধন করে এসেছে বৃটিশ ও পাকিস্তান আমল থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত।
উপজাতি নিয়ে কাজ করা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নৃবিজ্ঞানীরা বলছেন, উপজাতি জনগোষ্ঠীর রয়েছে নিজেস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, কুষ্টি কালচার, পরিচয় ও জাতিগত স্বীকৃতি। উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষদের রাস্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পরিচয় ব্রিটিশ আমল থেকে নির্ধারিত। ব্রিটিশ ট্রাইবাল (উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী) হিসেবে স্বীকৃত। এরা এতবছর ধরে নিজেদের পাহাড়ি বা উপজাতি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। হঠাৎ কেন এক পক্ষ আদিবাসী দাবির পক্ষে সোচ্চার আরেক পক্ষ এই দাবির বিপক্ষে যথাযথ যুক্তি উত্থাপন করলেন? জানা যায়, ২০০৭ সালের জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ে অনেক সুবিধা সংবলিত ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। এরপর থেকেই উপজাতি সম্প্রদায়ের একটি অংশ আদিবাসী দাবি স্বীকৃতির পক্ষে সোচ্চার হয় এবং আরেকটি পক্ষ চিরচেনা পাহাড়ি ও উপজাতি পরিচয়ের শব্দ মুছে আদিবাসী শব্দ গ্রহণ করতে কোনভাবেই ইচ্ছুক নয়। আদিবাসী হতে হলে অবশ্যই ভূমিপুত্র হতে হবে জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী। তারা মনে করেন পাহাড়ি- উপজাতি বা স্ব পরিচয়ের সঙ্গে তাদের অস্তিত্ব জড়িত। তারা এই ভূখণ্ডে আগমণের ইতিহাস প্রসঙ্গে কোন আপোষ করবেন না। কোন জাতি যদি বিশেষ সুবিধা ভোগের জন্য তার আগমণ ইতিহাস বা বুৎপত্তি হারিয়ে ফেলেন সে জাতির ভবিষ্য অন্ধকার। তারা যুগে যুগে পরিচয় নিয়ে অবহেলার শিকার হবেন। তাই উপজাতিদের মধ্যে নব্য আদিবাসী পরিচয় স্বীকৃতি দাবি নিয়ে নানা মতভেদ তৈরি হয়েছে৷ আদিবাসী হিসেবে সুবিধা গ্রহণ বাংলাদেশের উপজাতি জনগোষ্ঠীর আগমণ ইতিহাস এবং বুৎপত্তি মুছে দিবে। মূলত এই কারনে পাহাড় ও সমতলে কথিত আদিবাসী প্রশ্নে উপজাতিরাই দ্বিধা বিভক্ত। দিনদিন বাড়ছে উপজাতি মানুষদের মধ্যে এই নিয়ে নানা জনের নানা মত।
কেন এই দ্বিধা বিভক্ত?
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী উপজাতীয়দের মধ্যে অন্যতম চাকমা জনগোষ্ঠী। রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে এদের সংখ্যা বেশি। তবে বান্দরবানেও কিছু সংখ্যক চাকমাদের উপস্থিতি রয়েছে। চাকমা জনগোষ্ঠীর কিছু অংশ বর্তমান ভারতের উত্তর-পূর্বাংশে তথা ত্রিপুরা, অরুণাচল ও মিজোরাম রাজ্যে বসবাস করছে। চাকমারা বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী উপজাতীয় জনগোষ্ঠী। চাকমারা মঙ্গোলীয় জাতির একটি শাখা। বর্তমান মিয়ানমারের আরাকানে বসবাসকারী ডাইংনেট জাতিগোষ্ঠীকে চাকমাদের একটি শাখা হিসেবে গণ্য করা হয়। চাকমারা ৪৬টি গোজা ও বিভিন্ন গুত্তি বা গোষ্ঠীতে বিভক্ত। চাকমারা নিজেদের কী কী নামে পরিচয় দেন? ১. চাকমা জাতি, ২. জুম্ম জাতি, ৩. পাহাড়ি, ৪. উপজাতি, সর্বশেষ ৫. আদিবাসী! অতিরিক্ত নাম পরিচয় যেখানে সেখানেই তো জাতির পরিচয় নিয়ে বিভক্তি থাকাটাই অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এত এতো নাম পরিচয় থাকার পরেও চাকমাদের কিছু অংশ পাহাড়ি বা চাকমা উপজাতি পরিচয়ে সন্তুষ্ট।
মারমা হল বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজাতি জনগোষ্ঠী। তিন পার্বত্য জেলায় তাদের বসবাস দেখা গেলেও মূল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের বসবাস বান্দরবানে। ‘মারমা’ শব্দটি পালি শব্দ মারম্মা থেকে এসেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমারা আরাকান থেকে এসেছে বিধায় তাদের ‘ম্রাইমা’ নাম থেকে নিজেদের ‘মারমা’ নামে ভূষিত করে। তবে আরো জানা যায়, বর্মী ভাষায়, মারমারা মারামা নামে পরিচিত। মারমারা পূর্বে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মগ বা মাঘ নামে পরিচিত ছিল কারণ চট্টগ্রামে আগ্রাসনের সময় ডাচ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের তৎকালীন কিছু রাখাইন সম্প্রদায় সেই জলদস্যুদের সাথে হাত মেলানোর জন্য বাঙালিরা তাদের মগ/মাঘ বলে অভিহিত করত। এই মারমারা পাহাড়ে নিজেদের ১. মগ, ২. মারমা, ৩. পাহাড়ি, ৪. আদিবাসী হিসেবেও দাবি করে!
পার্বত্য চট্টগ্রামের তৃতীয় বৃহৎ জাতি হচ্ছে ত্রিপুরা বা তিপ্রা। বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করে। তিন পার্বত্য জেলা ছাড়াও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী সমতল এলাকার কুমিল্লা, সিলেট, বৃহত্তর চট্টগামের বিভিন্ন উপজেলা, রাজবাড়ি, চাঁদপুর, ফরিদপুর ইত্যাদি অঞ্চলেও বর্তমানে বসবাস করে। ত্রিপুরীরা নিজেদের চন্দ্রবংশোদ্ভুত ক্ষত্রিয় কুলজাত বলে দাবি করেন। নৃতাত্ত্বিক বিচারে ত্রিপুরা জাতি মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভুত। ত্রিপুরা নিজেদের:
ত্রিপুরা
তিপ্রা
দেববর্মা (Debbarma)
ত্রিপুরা (Tripura)
জামাতিয়া (Jamatia)
রিয়াং বা ব্রু (Reang/Riang/Bru)
নোয়াতিয়া (Noatia)
কোলোই (Kalai/Koloi)
মুরাসিং (Murasing)
রূপিনী (Rupini)
উসই/উচই (Usoi/Uchoi) হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন! ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশগত নাম পরিচয় বাদ দিয়ে আদিবাসী পরিচয় তাদের জন্য অস্বস্তি।
কুকি জনগোষ্ঠী। কুকি কোন একক নৃগোষ্ঠী নয়। প্রায় ৫০ টি জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে কুকি-চিন-মিজো জাতি গঠিত। এদের অধিকাংশ জাতিগোষ্ঠী মিয়ানমারের চিন রাজ্যে বসবাস করে। এদের বড় একটি নৃগোষ্ঠী ভারতের মিজোরাম রাজ্যে মিজো জাতি যারা বাংলাদেশে লুসাই নামে পরিচিত। এছাড়া বাংলাদেশে বসবাসরত পাংখোয়া, খুমি, চাক, খিয়াং ও মুরুং এই জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। অথাৎ এই জাতির পরিচয়ে অনেক নাম পাওয়া যায়।
সাঁওতাল হলো দক্ষিণ এশিয়ার একটি অস্ট্রোএশিয়াটিক ভাষী জাতিগোষ্ঠী।
তারা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগ ও রংপুর বিভাগের বৃহত্তম জাতিগত সংখ্যালঘু।
উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নথির অভাবের কারণে, সাঁওতালদের আদি জন্মভূমি নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। তবে ভাষাবিদ পল সিডওয়েলের মতে , অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাভাষীরা সম্ভবত প্রায় ৪,০০০-৩,৫০০ বছর আগে ইন্দোচীন থেকে ওড়িশার উপকূলে এসেছিলেন।অস্ট্রোএশিয়াটিক ভাষাভাষীরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্থানীয় ভারতীয় জনসংখ্যার সাথে ব্যাপকভাবে মিশে যায়।
সাঁওতাল সম্ভবত একটি বহিরাগত শব্দ থেকে উদ্ভূত। শব্দটি পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর অঞ্চলের পূর্ববর্তী সিলদায় সাওন্টের বাসিন্দাদের বোঝায়। সংস্কৃত শব্দ সামন্ত বা বা বাংলা সাঁওত মানে সমতল ভূমি। অথাৎ তারা এই বাংলায় আগমনকারী কিন্তু আদিবাসী নয়।
গারো হল একটি তিব্বত-বর্মী জাতিগোষ্ঠী। বাংলাদেশে বসবাসকারী অনেক নৃগোষ্ঠীর একটি গারো। এদের বসবাস টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, গাজীপুরে। তবে ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া; নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা; শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী এবং টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় গারোদের সংখ্যা বেশি। জাতিগত পরিচয়ের ক্ষেত্রে অনেক গারোই নিজেদেরকে মান্দি বলে পরিচয় দেন। এখন আদিবাসী পরিচয় গারোদের মধ্যে নতুন করে দ্বিধা বিভক্ত সৃষ্টি করেছে।
হাজং জনগোষ্ঠী আসামের একটি ছোট উপজাতি। যাদের বেশিরভাগই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম ও মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ রাজ্যে বাস করে। তবে
বাংলাদেশে এদের অল্প কিছুর বাস রয়েছে। নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা উপজেলা ও দুর্গাপুর উপজেলায় এবং শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলা ও ঝিনাইগাতী উপজেলায়, ময়মনসিংহ জেলার উত্তর অঞ্চলে, ধোবাউড়া উপজেলা ও হালুয়াঘাট উপজেলায়, সিলেট জেলার এদের বসবাস।
সামগ্রিক বিচারে স্ব-স্ব একাধিক পরিচয়ের বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর মানুষজনদের বাংলাদেশ সরকার সংবিধানের ২৩ (ক) অনুচ্ছেদে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা উপজাতি জাতিসত্তা হিসেবে স্বীকৃতি ও অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন বলেই সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করে। সম্প্রদায়গুলোকে ব্রিটিশ আমল থেকে উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ট্রাইবাল ইংরেজি শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ উপজাতি। আন্তর্জাতিক মিশনারী ও এনজিও তথা ষড়যন্ত্রকারী মহল সামগ্রিক পরিচয়ের উপজাতি জনগোষ্ঠীর স্ব-স্ব পরিচয় মুছে দিতে আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের অপতৎপরতা চালিয়ে আসছে। তাদের এই অপতৎপরতা পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর ষড়যন্ত্র।
উপর্যুক্ত আলোচনায় উপজাতিদের এই দেশের আগমণের ইতিহাস এবং এরা যে এদেশের ভূমিপুত্র নয় তা কিন্তু স্পষ্ট হয়েছে। তারা আদিবাসী হওয়ার পূর্বশর্ত পূরণ করেনা।
এই প্রেক্ষাগৃহে উপজাতিগুলো কথিত আদিবাসী প্রশ্নে দ্বিধা বিভক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। বর্তমানে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ ১৩টি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মেজরিটি পারসেন্ট স্ব-স্ব পরিচয় বা জাতিগত উপজাতি পরিচয় বাদ দিয়ে আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির পক্ষে নেই। তাদের মধ্যেই একটি অংশ উপজাতি হইতে নিজেদের আদিবাসী দাবির পক্ষে সোচ্চার হলেও উপজাতিদের আদিবাসী দাবির যৌক্তিক ব্যাখা দিতে পারেনি। উপজাতিরা স্ব-স্ব পরিচয়, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই, পাংখোয়া, মুরং, খিয়াং, বম, খুমি ও চাক ইত্যাদির পাশাপাশি পাহাড়ি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
বিদ্যাময় চাকমা নামে পাহাড়ের এক উপজাতি জানান, বাংলাদেশের আগমনের অতীত ইতিহাস, জাতির উৎপত্তি ও দীর্ঘদিনের জাতিগত পরিচয় এবং ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিদর্শন মুছে আদিবাসী হওয়াটাকে তারা জাতিগত গৌরবময় মর্যাদা মনে করেন না। তারা তাদের স্ব পরিচয় নিয়ে থাকতে চান।
সুতরাং আদিবাসী প্রশ্নে উপজাতিরা যেমন দ্বিধা বিভক্ত তেমনি দাবিটা কোনভাবেই তাদের কাছে যথার্থ বলে মনে হয়নি।
লেখক: হান্নান সরকার, মানবাধিকার কর্মী, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।