চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে সাজেক এসেছিলাম ফ্যামিলি ট্যুরে। সাথে স্বামী আর আমার মেয়ে মৌমিতা। আমরা প্রবাসে থাকি। গত মার্চ মাসে দেশে আসি৷ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে আপাতত বিমানের ফিরতি টিকিট বাতিল৷ তাই স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে এবার লং ট্যুরে বের হলাম। আশা ছিল সাজেক ঘুরা শেষ হলে রাঙামাটি ঝুলন্ত সেতু দেখে কক্সবাজার হয়েই চাপাইতে ফিরে আসব। তাই একটু লম্বা সময় নিয়ে সাজেকের উদ্দেশ্যে বের হলাম৷ সাজেকে এসে শুনতে পেলাম “খাগড়াছড়ি একজন বাঙালি লোককে পাহাড়িরা হত্যা করেছে। এজন্য নাকি বাঙালিরা মিছিল করে। এতে নাকি পাহাড়িরা বাঙালিদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও বাঙালিদের উপর হামলা করে৷ আর এই নিয়ে পাহাড়ি বাঙালিদের মধ্যে জাতিগত দাঙ্গা সৃষ্টি হয়। পাহাড়ের উপজাতি সংগঠনগুলো এই জাতিগত দাঙ্গার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধনদাতা। তারা বাঙালি কেন্দ্রিক এলাকায় সরাসরি দাঙ্গায় অংশ না নিলেও পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকায় বাঙালিদের উপর হামলা ও ঘরবাড়ি লুটপাট করছে।” এই অভিযোগ গুলো পাহাড়ে এসে প্রথম শুনলাম তাই কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। কারণ পাহাড়িদের কখনো আমার সন্ত্রাসী টাইপের মনে হয়নি। তারা অত্যান্ত শান্তিপ্রিয় পাহাড়ের সহজসরল মনে হয়েছে৷ তাই আমি পাহাড়িদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ গুলো মিথ্যা ও উদ্দেশ্য প্রণোদীত বলে মনে করি। আমি পাহাড়িদের জীবনযাপন ও কালচার সবসময় পছন্দ করি। বেশ করে চাকমা পিননহাদি (চাকমা নারীর কাপড়) আমি পছন্দ করি। একবার ঢাকায় পার্বত্য মেলা থেকে পিননহাদি কিনেছি। তাই এবার সাজেক ভ্রমণে পিননহাদি পড়ে এসেছি। আমাদের বাংলাদেশের পাহাড় ভূমি এত সুন্দর ও অপরূপ তা কিন্তু আপনি স্বচোখে না দেখলে কখনো বিশ্বাস করতে পারবেন না। আমি চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি আসার পথে রাস্তার দুই ধারের পাহাড় গুলো অবলোকন করি। আমার কেন জানি ইচ্ছে করে পাহাড়ে হারিয়ে যেতে৷ তাই সাজেক ঘুরাঘুরি আমার পরিবারের জন্য স্পেশাল কিছু৷ আসার সময় চানাচুর, শুকনো খাবার নিয়ে এসেছি। শুনেছি পাহাড়ে নাকি উঠতে উঠতে পেটের ভাত হজম হয়ে যায় তাই রহস্য করে এই শুকনো খাবার নিয়ে আসলাম। যাক আসি মূল প্রসঙ্গে। সারাদিন ঘুরাঘুরি করেছি বড়ই ক্লান্ত শরীর৷ আমার স্বামীও সেম। আমার মেয়ে সাজেকের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি দেখে অনেক খুশি। হোটেলে এসে বাধ সাধলো ইলেকট্রিসিটি। ভাবলাম পাহাড়ি এলাকা হয়তো ইলেকট্রিসিটি সমস্যা করে। একটু পরেই হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বিধিবাম, সে ইলেকট্রিসিটি আর এলোনা। রাতের দিকে হোটেল থেকে জানালো পানি শেষের দিকে তাই বেশি খরচ না করতে। রাতে দুই ঘন্টার জন্য জেনারেটর চলবে। মোবাইলে ক্যামেরার ব্যাটারি এর মধ্যে চার্জ করে নিতে হবে। অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম সবাই। এদিকে চারিদিকে গুঞ্জন চলছে উপজাতীয়রা নাকি বাঙ্গালীদের ধরে ধরে হত্যা করছে, আশেপাশের জায়গায় ব্যাপক গোলাগুলি চলছে। আতঙ্কে সবার চোখ মুখ নীল হয়ে এল। পরদিন সকাল থেকে খাবারেরও সংকট তৈরি হলো। খাবারের মেনুতে শুধু সবজি আর ভাত, রাতে শুধু ডাল। এক্সট্রা টাকা দিতে চাইলাম তারপরও নাকি ম্যানেজ করা সম্ভব না। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন রকম খবর আসতে থাকলো। উপজাতীয়রা নাকি রাস্তায় বেরিকেট দিয়ে রেখেছে ব্রিজগুলো তুলে ফেলেছে। রাস্তায় রাস্তায় অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর ঠিক থাকতে পারলাম না। শুধু সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছি যেন এই যাত্রায় আমাদেরকে নিরাপদ রাখে। পরদিন সকালে আমার স্বামী আরো কয়েকজন পর্যটকদের সাথে সেনাবাহিনীদের সাথে দেখা করে এলো। জানালো সেনাবাহিনী আশ্বাস দিয়েছে যে আমাদের কোন ভয় নেই। তারা চেষ্টা করছে উপজাতীয়দের সাথে সমন্বয় করে সবাইকে বিকেলের মধ্যে খাগড়াছড়ি ফেরত পাঠানোর। এছাড়া তারা পানি ও খাবারের ব্যবস্থাও করে দিবে। সেনাবাহিনীকে যে কি পরিমান আপন মনে হচ্ছিল বলে বোঝাতে পারবো না। আমার খালাতো ভাই সেনাবাহিনীতে চাকরি করে। ওর সাথে প্রায়ই তর্ক করতাম যে দেশের সেনাবাহিনী কি করে? আজ হারে হারে উপলব্ধি করলাম যে যুদ্ধ বা বিপদের সময় সেনাবাহিনী কতটা প্রয়োজন। মেয়েকে শুধু বলতাম ভয় পেয়ো না মা সেনাবাহিনীর আঙ্কেলরা আছেন, কোন ভয় নেই আমাদের। সেদিন বিকেলেও আমরা ফিরতে পারলাম না। হোটেলে কয়েকজন উপজাতীয় কর্মচারী ছিল, তাদের সাথে কথা বলতাম, সমস্যাটা কিসের। দেখতাম তারাও ভয় কিছু বলতে চাইত না। তবে এটুকু বুঝতাম তারাও বাঙ্গালীদের ঠিক পছন্দ করে না। আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস না করলে কাছেও আসে না। একজন বলল উপজাতীয় দল গুলোর মধ্যে গন্ডগোল নাকি এখানে সাধারণ বিষয়। যাহোক আল্লাহর অশেষ রহমতে, অবশেষে পরদিন সকালে সেনাবাহিনী সবাইকে উদ্ধার করে খাগড়াছড়িতে নিয়ে আসলো। বিশ্বাস করেন এমন স্বস্তি জীবনে আর কখনো পাইনি। গবেষকেরা বলেন, ভ্রমণের মতো রোমাঞ্চে ভরা আর কী হতে পারে? কিন্তু এবারের ভ্রমণে আমার কাছে মনে হয়েছে এই ভ্রমণের চেয়ে ঘরবন্দি জীবনই শ্রেয়। এই পর্যটন খ্যাত সাজেক যে সন্ত্রাসীদের আবাস ভূমি তা আমরা আগে জানতাম না। সেনাবাহিনী প্রটেকশন দেয় বলে কেউ হয়তো বুঝতেও পারেনা এবং শেয়ারও করে না। যাহোক আমরা স্বামী- স্ত্রী শুধু মেয়েটির জন্য আপসোস করছি। ও হয়তো আর কখনো বাংলাদেশেই আসতে চাইবে না। নিজের ওপর এবং নিজের দেশের ওপরই এখন লজ্জা হচ্ছে। তাকে কেন পাহাড়ে নিয়ে আসলাম।
এই পর্যটক জিম্মি ঘটনায় পর্যটকরা এতটাই আতঙ্কিত হয়েছে যে পাহাড়ের উপজাতি মানুষ ও সন্ত্রাসবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছে। এর মাধ্যমে এ অঞ্চল পর্যটক শূন্য হবে। একই সাথে আমি একজন পর্যটক হিসেবে সাজেক ভ্যালি বর্জন করলাম। যেখানে জীবনের নিরাপত্তা নেই সেখানে ভ্রমণ নামক রোমাঞ্চ অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বৈকি।