মুক্ত মত
সৈয়দ হাকসাঃ
মগ আরাকান তথা বার্মার অধিবাসী। জাতিতত্ববিদেরা এদের ইন্দো-চীন নিবাসী বলে মনে করেন। এরা সাধারণত সাতভাগে বিভক্ত। এ গুলো হলো, ১) মারমগরি, ২) ভূঁইয়া মগ,৩), বড়ুয়া মগ, ৪) রাজবংশী মগ, ৫) মারমা মগ, ৬) রোয়াং মগ, ৭) ভ্যুমিয়া মগ ইত্যাদি।
বাংলায় অতীতে বিভিন্ন দেশের জলদস্যুরা আসতো চুরি ডাকাতি বা সম্পদ লুট করতে। একটি ভয়ানক দস্যু আসতো মগ রাজার দেশ বার্মা থেকে। এরা ছিল মূলত পর্তুগীজ নৌ-দস্যুদের রাজাকার বাহিনী। আরাকান-রাজের সৈন্যদলের মধ্যে অনেক মগ ও অবৈতনিক পর্তুগিজ সৈন্য ছিল। এরা বছরে বারোমাস লুণ্ঠন, অপহরণ ও অত্যাচার চালানোই ছিল তাদের মূল কাজ। তারা ছিল চৌকস-চতুর, লুটতরাজ চালানোর সাখে সাথে অতি ক্ষিপ্রতার সাথে পালিয়ে যেত।
শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৪ খৃষ্টাব্দে বাংলার সুবেদার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সাথে সাথে প্রশাসনিক উন্নতির পর তিনি এ পুর্তগীজ-মগ দস্যুদের দমনে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। “মগ ধাওনি” নামে পরিচিত এ অভিযানে পর্তুগীজ-মগ বাহিনী প্রায় ১,২২৩টি কামান ফেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু তারা অতিগোপনে পাহাড়ের পাদদেশে ঝোপের আড়ালে বসত গড়তে থাকে। যখন ইংরেজদের হাতে দিল্লীর পতন হয়, প্রশাসনিক নজরদারীর দুর্বলতায় তারা দলে দলে বসত গড়তে থাকে পুরো পাহাড়ী অঞ্চলে, এতে তারা যে প্রতিকূলতার শিকার হয় তাহলো-বনের হিংস্র প্রাণীকুলের বাঘ-ভাল্লুক-বন্যহাতি ইত্যাদির আক্রমণ। কিন্তু তারা সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করে পাহাড়ে বংশবৃদ্ধি ও অনুপ্রবেশ সমানতালে বজায় রাখে। এদিকে বৃটিশরা সমতল অঞ্চলেই তাদের প্রশাসনিক কর্মপরিধি বিস্তৃত ছিল যা ফসল কেন্দ্রিক ও কর আদায়ে ছিল তাদের বিশেষ মনোযোগ। চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চলে হিংস্র জন্তু-জানোয়ারে ভরপুর ছিল যে কারণে এ বনাঞ্চলে বসত বা সভ্যতা গড়ে উঠা সহজ ছিলনা তদুপরি আধুনিক সভ্যতার সাথে বা সমতল অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন ছিল দুর্ভেদ্য ও কঠিন। এখানের পরিস্থিতি ও পরিবেশ বিবেচনায় প্রায় ৬/৭ শত বছর আগে এখানে মানুষ বসবাসের যোগ্য ছিল না। এবং বর্তমানে যে সমস্ত বু্দ্ধিজীবী দাবী করে আদিবাসী, ওদের স্বরূপ উন্মোচিত হলো “চাকমা বডি অব ত্রিপুরা “ দাবী প্রেক্ষিতে।
Chittagong Hill Tracts of Bangladesh integral part of India:ঃ Chakma bodies of Tripura
২০১৬ সালে লিখিত নতুন ইতিহাসঃ ভারতীয় ষড়যন্ত্রের নতুন বীজ।
রেফারেন্স সমূহ –
(প্রকাশিত: শনিবার ১৩ আগস্ট ২০১১, দৈনিক সংগ্রাম )
” ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে আজকের বাংলাদেশে ১২০৪ সাল থেকে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বিপর্যয় পর্যন্ত মুসলিম শাসন চালু ছিলো। ১৩৪০ সালে বাংলার সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ সোনারগাঁ থেকে চট্ট্রগ্রামে অভিযান পরিচালনা করেন। ফলে তাঁর সময়ে চট্টগ্রাম অঞ্চল সর্বপ্রথম মুসলিম শাসনাধীনে আসে। সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ মেঘনার তীরবর্তী শহর ও নদীবন্দর চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি রাজপথ নির্মাণ করেছিলেন। এরপর দীর্ঘকাল চট্টগ্রাম অঞ্চল মুসলিম শাসনাধীনে থাকে। রাজমালার বর্ণনায় জানা যায় যে, ত্রিপুরার রাজা ধনমানিক্য ১৫১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দ চট্রগ্রামের কিয়দংশ দখল করেন। বাংলার তদানীন্তন শাসক হোসেন শাহী বংশের পরাক্রমশালী সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ দ্রুত সেনাবাহিনী প্রেরণ করে পুনরায় সমগ্র চট্টগ্রামের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। হোসেন শাহী আমলে আরাকান রাজ সেংখরি (১৪৩৪-১৪৫৯) চট্টগ্রামের রামু অঞ্চল দখল করেন। এ দখলকারীর বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরিত হয়। জো অাঁ দে বারোস -এর Da Asia এবং সমসাময়িক পর্তুগীজ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, আরাকানের রাজা বাংলার সুলতানদের সামন্ত ছিলেন। চট্টগ্রাম অধিকারের যুদ্ধে পরাজয়বরণ করার ফলেই আরাকান রাজ সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের সামন্তে পরিণত হয়েছিলেন বলে পন্ডিতগণ মনে করেন। হোসেন শাহ পরাগল খাঁন ও খোদা বখশ খাঁনকে চট্টগ্রামকে দু’ভাগে ভাগ করে শাসনকর্তা নিযুক্ত করছিলেন। খোদা বখশ খাঁনের শাসনাধীন ছিলো দক্ষিণ চট্টগ্রাম। বাংলাদেশের মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার পর বাংলার মুঘল সুবেদারগণ চট্টগ্রাম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাঁদের প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা করতেন এবং কোন কোন উৎপন্ন দ্রব্য ও পশুর (যেমন : হাতি, তুলা) উপর করারোপ করতেন। মুঘলদের পর ঔপনিবেশিক বৃটিশরা তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। ১৭৬০ খৃস্টব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নবাব মীর কাসেমের নিকট থেকে চট্টগ্রামের দায়িত্ব গ্রহণ করে তার একশ’ বছর পরে ভারতের বৃটিশ শাসকরা তাদের ‘বিভক্ত করে শাসন করার’ কৌশল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের জন্ম দেয়। ১৮৬০ খৃস্টাব্দে বৃটিশ বেনিয়া গোষ্ঠী তৎকালীন ২২তম প্রশাসনিক অ্যাক্ট বলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলাকে বিভক্ত করে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ নামে একটি আলাদা জেলা গঠন করা হয়। ১৯০০ সালের ম্যানুয়েলের সার্কেলে বিভক্ত করে প্রশাসনিক ও রাজস্ব সংক্রান্ত কর্মকান্ড পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়। ১৮৯০ সালের বৃটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি প্রভাব খর্ব করার লক্ষ্যে এবং ঐ এলাকার স্থায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে চিটাগাং হিলট্রাক্টস্ রেগুলেশন ১৯০০ ( Chittagong Hill Tracts Regulation 1900) চালু করেন। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী জেলা প্রশাসক সেখানকার সবধরনের অভিগমন বা জনস্থানান্তর বন্ধ বা প্রতিরোধ করতে পারতেন। ঐ আইন প্রণয়নের দ্বারা বৃটিশ বেনিয়া সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের বহিরাগত যাযাবর উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে একটি স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাসে বাধ্য করানোর প্রয়াস চালায়।
১৯৩৫ সালে বৃটিশ প্রণীত ভারত শাসন আইনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘সম্পূর্ণ বা পৃথক অঞ্চলে’ কর্মটফ ঋসণফলঢণঢ ইরণট হিসেবে চিহ্নিত করে। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে সংলগ্ন বাংলাভাষী মুসলিম অধ্যুষিত সমতল অঞ্চলের আর্থ-রাজনৈতিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বৃটিশ বেনিয়া উপনিবেশিকদের এই কৌশলের কারণ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি প্রভাব ও বসতি স্থাপন প্রক্রিয়া বন্ধ করা। প্রায় জনশূন্য এবং সম্পদসমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর বার্মা, আরাকান, চীন ও উত্তর-পূর্ব ভারতের দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আগত বসতি স্থাপনকারী উপজাতিদের যতটুকুই দাবি ছিল অঞ্চলটির কাছের সংলগ্ন চট্টগ্রামের সমতথলবাসী বাঙালি জনগোষ্ঠীর ঐ অঞ্চলটির উপর অধিকার বা দাবি কোন যুক্তিতেই কম ছিল না। কিন্তু স্বার্থান্বেষী বেনিয়া ইংরেজরা ন্যায়পরায়ণতার যুক্তিকে লঙ্ঘন করে ষড়যন্ত্রের বীজ বপণ করে। ১৯৫৬ সালে পৃথক অঞ্চলের বিধানের সমাপ্তি ঘটে।
ঐ বছর ম্যানুয়েলের ৫১ অনুচ্ছেদ রহিত করে পাকিস্তানের সর্বত্র সকল নাগরিকের অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করা হয় ঢাকা হাইকোর্টের এক রায়ে। তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি বসতি গড়ে উঠতে থাকে। ১৯৮০ সাল পযৃন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম একটিমাত্র বৃহত্তর জেলা ছিল। ১৯৮৩ সালে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এই তিনটি প্রশাসনিক পার্বত্য জেলায় বিভক্ত করা হয়। ১৯৮৯ সালে সংসদে তিনটি জেলার জন্য তিনটি স্থানীয় সরকার পরিষদ বিল পাস করা হয়। এই বিলে স্থানীয় পরিষদের কাঠামোও নির্ধারণ করা হয়। এতে একজন চেয়ারম্যান (উপজাতীয়দের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন), ২০ জন উপজাতীয় সদস্য ১০ জন অউপজাতীয় সদস্য রাখা হয়।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণকালের সবচেয়ে বিতর্কিত পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়। তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তার কার্যালয়ে বাংলা ভাষায় লিখিত কম্পিউটারে মুদ্রিত ১৫ পৃষ্ঠার এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন সরকার দলের চিফ হুইপ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির আহবায়ক এবং শান্তি বাহিনীর পক্ষে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। এই চুক্তি সংবিধান বিরোধী, দেশবিরোধী, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিরোধী, গণতন্ত্র-মৌলিক অধিকার-সমতা সমসুযোগবিরোধী বলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলিমরা এর বিরোধিতা তখন থেকেই করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আরো ১২টি উপজাতিকে বাদ দিয়ে সন্ত্রাসী চাকমা শান্তিবাহিনীর সাথেই চুক্তি করেছে। কেবল চাকমাদের সাথে চুক্তি অন্যদের অধিকার ও সুযোগ ‘হরণ মাত্র। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত মুসলিম বাঙালিদের সম্পদ লুটপাট, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালানো, তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, তাদের নারীদের ধর্ষণ, তাদের শিশুদের বীভৎসভাবে হত্যা করা, তাদেরকে আহত-নিহত করা, তাদের জমি কেড়ে নেয়া, তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখা, তাদেরকে ঐ অঞ্চল থেকে বহিষ্কার করা ইত্যাদি কুকর্ম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পরও শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীদের দ্বারা আজো অব্যাহত আছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে গত ৩৮ বছর ধরে যে সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনী দেশ রক্ষা করলো, বিদ্রোহ থামালো, স্বাধীনতা বাঁচালো, জীবন দিয়ে, ঘাম ও রক্ত দিয়ে সে বাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়ে বর্তমান সরকার স্থানীয় বাঙালি মুসলিমদের জীবন ও সম্পদকে ১৯৯৭-এর শান্তিচুক্তি-পূর্ববর্তী সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধহীন আক্রমণের মুখে ঠেলে দিয়েছে।৫ ১৯৭১ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে৬ সরকার সে ষড়যন্ত্রের ‘পাতানো ফাঁদে’ এদেশের এক সম্পদশালী এক-দশমাংশ এলাকাকে ঠেলে দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের লোকালয় থেকে সেনাক্যাম্প সরিয়ে নেয়ার ফলে সেখানে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তারা বাঙালিদের কাছ থেকে যথেচ্ছ চাঁদা আদায় করছে। কৃষিপণ্য বিক্রিতে, ছাগল বিক্রিতে, কাঠ বিক্রিতে শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিতে হচ্ছে। আগেও দিতে হতো। এখন তা বেপরোয়া রূপধারণ করেছে। শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে ভূমি। দখলে নিয়ে নিচ্ছে বাঙালিদের ইজারা নেয়া জমি, রাবার বাগান ও আম বাগান প্রভৃতি। চাকমা ভিন্ন অন্য উপজাতিরাও চাকমা সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নির্মম নির্যাতনের শিকার। চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী হামলা থেকে তারাও রেহাই পাচ্ছে না। এই মুহূর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা এটাই। অন্য কথায় ভারতের প্রশিক্ষিত মাত্র কয়েক হাজার সশস্ত্র সন্ত্রাসীর কাছে জিম্মি ওখানকার সব বাসিন্দা।
১. ডা. হাসানুজ্জামান চৌধুরী, পার্বত্য চট্টগ্রাম : ভূ-রাজনীতি ও বিপন্ন সার্বভৌমত্ব, ১ জানুয়ারি, ১৯৯৭, পৃ.-৫
২. জাফর আহমদ নূর, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্বমোড়লদের হেডলাইটের আলো পড়েছে (প্রবন্ধ) পৃ.-১।
৩. পার্বত্য চট্টগ্রামের পার্বত্য খাগড়াছড়ি, পার্বত্য রাঙ্গামাটি পার্বত্য বান্দরবন ১৯৮৮ সালে তিনটি জেলার মর্যাদায় বিভক্ত হয়। দ্রষ্টব্য : জাতীয় সংসদের এ্যাক্ট, বাংলাদেশ গেজেট, ২ মার্চ, ১৯৮৯।
৪. রাঙ্গামাটিতে বসবাসকারী উপজাতির সংখ্যা ১১টি (চাকমা, মারমা, তংচ্যাংগা, ত্রিপুরা, পাংখো, লুসাই, বোম, খিয়াং, মুরং, চাক, খুমি)। খাগড়াছড়ি জেলায় বসবাসকারী উপজাতির সংখ্যা ৩টি (চাকমা, মারা, ত্রিপুরা)। বান্দরবন জেলায় বসবাসকারী উপজাতির সংখ্যা ১২টি (মারমা, মুরং, ত্রিপুরা, তংচ্যাগো, বোম, চাকমা, খুমী, খিয়াং, চাক, উসাই, লুসাই, পাংখো)।
৫. জাফর আহমদ নূর, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্বমোড়লদের হেডলাইটের আলো পড়েছে (প্রবন্ধ) পৃ.-১।
৬. ধর্মযাজক ফাদার টীম ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে খৃস্টানীকরণ ( Christianization ) প্রোগ্রাম শুরু করেন। পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া তিনি এখানে বিগত ৩৭ বছর যাবত অবস্থান করে ছোট বড় সকল উপজাতি সদস্যদের খৃস্টান ধর্মে দীক্ষিত করে পার্শ্ববর্তী মিজোরাম (৯০% খৃস্টান ও ইহুদী), ত্রিপুরা (৩০% খৃস্টান), মনিপুর (৪০% খৃস্টান), আসাম (৪৫% খৃস্টান), মেঘালয় (৮০% খৃস্টান)), অরুনাচল (৭০% খৃস্টান), রাজ্যের খৃস্টান ও ইহুদীদের সাথে ধর্মীয় বন্ধন গড়ার কাজটি লোকচক্ষুর অন্তরালে সাফল্যের সাথে করতে সক্ষম হয়েছেন। এ ধর্মযাজক বিশাল কর্মকান্ড পরিচালনা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ডেমোগ্রাফিক ডিনামিকস পরিবর্তনের পাশাপাশি সকল উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে অত্যাধুনিক বিশাল খৃস্টান ডরমিটরী, গীর্জা, মিশনারী স্কুল, বাইকেল কেন্দ্র, পাঠাগার, সার্ভিস সেন্টার, ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট ও শক্তিশালী স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। ”
দ্বিতীয়: রেফারেন্স এন্ড
================
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি আদিবাসীদের সঠিক পরিচিতি নিয়ে নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠীদের নিয়ে। ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রানুযায়ী তারা বাংলাদেশের আদিবাসী না হওয়া সত্ত্বেও নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে দাবী করছে । অপরদিকে আদিবাসীদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না মর্মে জাতিসংঘের সাথে পশ্চিমারা সম্প্রতি খুব হৈ চৈ শুরু করেছে। মজার বিষয় হচ্ছে, জাতিসংঘের যেসব সদস্য দেশে আদিবাসী রয়েছে, তাদের এ ব্যাপারে কোন আগ্রহ নেই । অন্যদিকে, জাতিসংঘ পশ্চিমাদের বিশেষ কূট-কৌশল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাদামী এবং কালো চামড়ার দেশগুলোর ওপর নৈতিকতার দোহাই দিয়ে আ�তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক প্রণীত কনভেনশন ১৬৯ চাপিয়ে দিতে চাইছে। এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে এই সনদে স্বাক্ষর করার চাপ দিচ্ছেন। তাই ইতিহাসসম্মত বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ অনুসারে বাংলাদেশে আদিবাসী অভিধাযোগ্য কোন জনগোষ্ঠী আছে কিনা, এখনই পর্যালোচনা দরকার। বাংলাদেশে বর্তমানে যেসব জনগোষ্ঠী উপজাতীয় হিসেবে বিবেচিত, সেগুলো হলো : চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, মগ, কুকি, লুসাই, সেন্দুজ, পাংখো, বনযোগী, খুমি, গারো, হাজং, মণিপুরী, পাঙ্গন, খাসিয়া, সাঁওতাল, ওরাও, রাজবংশী প্রভৃতি ২৯টি জনগোষ্ঠী। এসব জনগোষ্ঠীতে ধর্মীয় দিক থেকে বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টান এমনকি ইসলাম ধর্মের অনুসারীও রয়েছে (মৌলভীবাজার জেলার ক�লগঞ্জ থানার প্রায় ৩০ হাজার মুনিপুরী/ পাঙ্গন উপজাতি মুসলীম ধর্মাবলম্ভী)। তারা রাষ্ট্রের সাধারণ মানবমণ্ডলী তথা নাগরিকমণ্ডলীর অবিচ্ছেদ্য অংশ, যাদের কল্যাণে ও উন্নয়নে রাষ্ট্রের বিধিবদ্ধ দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে অন্যান্য নাগরিকের মতোই। এখানে এ মুহূর্তে যে বিষয়টা গুরুত্ববহ সেটা হলো, নৃ-বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞানের স্বীকৃত সংজ্ঞা অনুসারে উপরে বর্ণিত জনগোষ্ঠীগুলোকে ভূমিজ সন্তান বলা যায় কিনা? এসব উপজাতিদের নিজস্ব যে লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়, তাতে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে যে, তাদের পূর্বপুরুষেরা অদূর অতীতে বাংলাদেশের সীমানার বাইরে অপরাপর রাজ্য কিম্বা অঞ্চল থেকে রাজনৈতিক কারণে এবং বিশেষ করে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশ অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করে । তারা সবাই কোন না কোন ধর্মানুসারী ছিল, সভ্য জীবনযাপন করত, রাজ্যশাসন করত, প্রতিপক্ষের সাথে যুদ্ধ করত এবং যুদ্ধে হেরে বাংলাদেশের কোন না কোন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা উল্লেখযোগ্য। স্বীকৃত সব নৃ-তত্ত্ববিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে এরা কোনভাবেই কোন সংজ্ঞায় �আদিবাসী� হিসেবে অভিহিত হতে পারে না।
আদিবাসী বলতে কী বোঝায়
ইংরেজী Indigenous শব্দটির বাংলা হচ্ছে আদিবাসী। A person or living thing that has existed in a country or continent since the earliest time known to people� অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে কোন এলাকার বিশেষ জনগোণ্ঠী যদি ঐ এলাকায় বসবাস করে তাহলে তাদেরকে ঐ এলাকার আদিবাসী হিসেবে গণ্য করা হয়। Indigenous শব্দটির অর্থ হচ্ছে Nation born originating or produced naturally in a country, not imported অর্থাৎ আদিবাসী হতে হলে অভিবাসী হলে হবে না, বরং সত্যিকারভাবে একটি দেশে প্রাচীনকাল থেকে উৎপত্তি হতে হবে। এ ব্যাপারে আমেরিকার প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ লুইজ মর্গান আদিবাসীকে সজ্ঞায়িত করেছেন এইভাবে, The Aboriginals are the groups of human race who have been residing in a place from time immemorial – They are the Sons of the soil আদিবাসী হতে হলে একটি বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য থাকতে হবে যা হলো �ভূমিপুত্র� বা � Sons of the soil� . জাতিসংঘ থেকে UNPFII (United Nation Permanent Forum for Indigenous Issues) এর মাধ্যমে কারা আদিবাসী হবে তার একটি মানদণ্ড ঠিক করা হয়েছে। জাতিসংঘ কমিশনের স্পেশাল র্যাপোটিয়ার হোসে মার্টিনেজ কোবে যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তাতে বলা হয়েছে, �কোন ভূখণ্ডের আদিবাসী সম্প্রদায়, জাতিগোষ্ঠী বা জাতি বলতে তাদের বোঝায়, যাদের ঐ ভূখণ্ডে প্রাক-আগ্রাসন এবং প্রাক-উপনিবেশকাল থেকে বিকশিত সামাজিক ধারাসহ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে, যারা নিজেদেরকে ঐ ভূখণ্ডে বা ভূখণ্ডের কিয়দাংশে বিদ্যমান অন্যান্য সামাজিক জনগোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র মনে করে। সেই সাথে তারা নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও আইন ব্যবস্থার ভিত্তিতে পূর্বপুরুষের ভূখণ্ড ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ভবিষ্যৎ বংশধরদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য দৃঢ়পতিজ্ঞ�। জাতিসংঘের সংজ্ঞায় মূলত তিনটি বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে, যা হলো : ১. যারা কোন উপনিবেশ স্থাপনের আগে থেকেই ওই ভূখণ্ডে বাস করছিল, ২. যারা ভূখণ্ডের নিজস্ব জাতিসত্ত্বার সংস্কৃতি ধরে রেখেছে এবং তা ভবিষ্যৎ বংশধরদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, ৩. যারা নিজেদের সতন্ত্র মনে করে। এই সজ্ঞাসমূহের আওতায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষকগণ সত্যিকার অর্থে কারা আদিবাসী তার উদাহরণ দিতে যেয়ে বলেছেন যে, খর্বাকৃতি, স্ফীত চ্যাপ্টা নাক, কুঁকড়ানো কেশবিশিষ্ট কৃষ্ণবর্ণের �বুমেরাংম্যান�রা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী বা যথার্থ অ্যাবোরিজিন্যালস। তারা ওখানকার ভূমিপুত্র বটে। ঠিক একইভাবে মাউরি নামের সংখ্যালঘু পশ্চাৎপদ প্রকৃতিপুজারি নিউজিল্যাণ্ডের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী সেখানকার আদিবাসী। কিন্তু পার্বত্যচট্টগ্রামের উপজাতিরা এসব সজ্ঞার অন্তভূত নয়। তারা বার্মা থেকে বিতাড়িত হয়ে চট্টগ্রাম তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের অরণ্যে আশ্রয় নিয়েছে ১৭শ খ্রিস্টাব্দ ও ১৮শ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ের দিকে।
উপরোক্ত সূত্রের আলোকে অবশ্যই বলা যায়, একমাত্র বাঙালিরাই এই এলাকার আদিবাসী, যারা ব্রিটিশ কলোনী স্থাপনের আগে তো বটেই, সেই প্রাচীনকাল থেকে বংশ পরম্পরায় ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা, স্বতন্ত্র, সামাজিকতা , রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভাষাগত স্বতন্ত্রবোধ বজায় রেখেছে। সে হিসেবে বাঙালিরাই এখানকার একমাত্র �ভূমিপুত্র�। এখানে আরেকটা কথা উল্লেখ্য যে, ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশরা সেটেলমেন্ট কলোনাইজেশন না করায় এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দা বাঙ্গালীদের কখনই মূল ভূখণ্ড থেকে উৎখাত করার পরিকল্পনাতো দূরের কথা, এমনকি বাঙালিদের ভাষা, কৃষ্টি, কালচার এর উপরও কোন প্রভাব বিস্তার করেনি। সুতরাং এই বিবেচনায়ও বাঙ্গালীরাই এই এলাকার প্রাচীনতম ও একমাত্র আদিবাসী। এক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে বাংলাদেশের সমতলে কিংবা পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর পরিচয় তাহলে কি হবে ? আদিবাসীর সংজ্ঞা ও ইতিহাস পর্যালোচনা করে এটাই বোঝা যায় যে, সমতলে কিংবা পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিগুলো বহিরাগত এবং তারা অভিবাসী জনগোষ্ঠী, কোন ভাবেই আদিবাসী নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে জনবসতির সূত্রপাত এবং যে কারণে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো আদিবাসী নয়
পার্বত্য চট্টগ্রাম চট্টগ্রামেরই অংশ। প্রশাসনিক কারণে ইংরেজ শাসানমলে চট্টগ্রামের পূর্বের অরণ্য এলাকাটি পৃথক করে এর নামকরণ করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম। পৃথক হবার পূর্বে থেকে সমগ্র চট্টগ্রাম জুড়েই চট্টগামীরা বসবাস করে আসছে। এমনকি মোগল শাসনামলে সীমান্ত পাহারায় রাঙ্গামাটিতেও একটি সামরিক দূর্গ ছিল। এই দূর্গকে কেন্দ্র করে আশে-পাশে বিপুল সংখ্যক চট্টগ্রামী বসবাস করতো। সে বিষয়ে মোগল শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তে স্পষ্টই জানা যায়। চট্টগ্রামীরা বনজসম্পদ আহরণে অরণ্যে যাতায়াত করতো এবং কর্ণফূলি নদীর তীরবর্তী কোন কোন এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যও গড়ে তুলেছিলো। এমনই সময় অর্থাৎ ১৬শ খ্রিস্টাব্দের দিকে উত্তরাংশে অর্থাৎ আজকের খাগড়াছড়ি এলাকায় কিছুসংখ্যক ত্রিপুরা পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে এসে গহীন অরণ্যে জুম চাষাবাদ শুরু করে। এছাড়া আসামের মিজোরামের অরণ্য থেকে কুকি নামক এক উলঙ্গ জাতিও মাঝে মধ্যে বিচরণ করত চট্টগ্রামের এই অরণ্য পথে। তারা কিছুদিন এদিক সেদিক ঘুরে-ফিরে আবার চলে যেত মিজোরামে।
১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আরাকান থেকে বিতাড়িত একদল চাকমা সর্বপ্রথম নাফ নদী পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের রামু থানার অদূরে নদী তীরে অবস্থান নেয়। তারা সেখানে সল্প সময় অবস্থানের পর গভীর অরণ্যে (আলীকদম উপজেলা) চলে যায়। চাকমারা কেন রামু থেকে আলীকদম এবং আলীকদম থেকে রাঙ্গামাটির দিকে এলো তার একটা ঐতিহাসিক ও ধারাবাহিক তাৎপর্য্য রয়েছে। তা হল- ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবেদার শাহ সুজা আপনভাই সম্রাট আওরঙ্গজেবের সাথে বক্সার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে চট্টগ্রামের প্রাচীন বন্দর শহর দেয়াঙ-এ (বর্তমানে আনোয়ারা উপজেলা) আশ্রয় নেয়। এক পর্যায়ে তিনি তাঁর অনুগত ১৮ জন সেনাপতির নেতৃতে সেনাবাহিনীকে রামুতে রেখে শুধু তাঁর নিকটাত্মীয়দের নিয়ে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে আরাকানের রাজধানীতে যান। উল্লেখ্য যে, প্রায় একই সময়ে আরাকান থেকে বিতাড়িত চাকমাদের প্রথম দলটি রামুর নদী তীরে (চাকমারকুল) অবস্থান নিয়েছিল। সে সময়ে মোগল সৈনিকদের সাথে চাকমা শরনার্থীদের যোগাযোগ ঘটে। এদিকে আরাকানের রাজধানীতে আশ্রয়ের কিছু সময়ের মধ্যে আরাকানের তৎকালীন তরুণ রাজা সুবেদার শাহ সুজার এক কন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। সুজা তাতে ক্ষুদ্ধ হয়ে আরাকানের রাজার সাথে বাকবিতণ্ডা ও ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন এবং এক পর্যায়ে আরাকানের রাজার হাতে সপরিবারের নিহত হন । এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রামুতে অবস্থানরত মোগল যোদ্ধাদের সাথে আরাকানী সৈনিকদের খন্ড খন্ড যুদ্ধ বেঁধে যায় এবং মোগলযোদ্ধারা রামু ত্যাগ করে পূর্বে গভীর অরণ্যে গিয়ে পুনরায় দূর্গ স্থাপন করে। মোগল যোদ্ধারা ইসলামের অন্যতম খলিফা হযরত আলী (রাঃ)-এর অনুসারী শিয়া সম্প্রদায়ের হওয়ায় তারা হযরত আলীর নামানুসারে ঐ এলাকার নামকরণ করেন �আলীকদম� (বর্তমানে আলীকদম উপজেলা)। মোগলযোদ্ধাদের পিছু পিছু চাকমারকুলের চাকমারাও চলে যায় আলীকদমে। মূলত এখানেই নারী বিহিন মোগল যোদ্ধাদের সাথে চাকমাদের এমন এক সমাজ গড়ে ওঠে যাতে বহু মোগলযোদ্ধা চাকমা রমণী বিয়ে করে সংসার জীবনও শুরু করে।
এদিকে সহোদর শাহ সুজা হত্যাকাণ্ডে ক্ষুদ্ধ হয়ে দিল্লীর সম্রাট আওরঙ্গজেব প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সেনাপতি শায়েন্তা খাঁকে বাংলার সুবেদার নিযুক্ত করে বাংলায় প্রেরণ করেন। ১৬৬৬ সালের প্রথম দিকে শায়েস্তা খাঁ আপন পুত্র উমেদ খাঁকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে আরাকানের অভিযানের নির্দেশ দেন। ২৭ জানুয়ারী ১৯৬৬ তারিখে মোগলরা ব্যাপক হতাহতের মধ্যে দিয়ে চট্টগ্রাম বিজয় করে নেয়। চট্টগ্রাম বিজয়ের পর প্রধান সেনাপতি উমেদ খাঁ চট্টগ্রামের নবাব হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন এবং আলীকদমে আশ্রিত মোগলদের মাধ্যমে কার্পাসকর প্রদানের শর্তে আলী কদমে জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন। আর এ জমিদারীর প্রজা হয় বার্মা থেকে বিতাড়িত সেই জুমিয়া চাকমারা। এভাবেই চলছিল কয়েক বছর। পরবর্তীতে মোগল ও আরাকানীদের অব্যাহত খণ্ড খণ্ড যুদ্ধের কারণে চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল ঐ সময় �নো-ম্যান্সল্যান্ড� নামে অভিহিত হয়। ঐ এলাকা চট্টগ্রামের নবাবের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকলেও সেখানকার জমিদার শের জালাল খাঁ নিকটবর্তী আরাকানীদের বারংবার হামলার কারণে আরাকানীদের সাথে মিত্রতা ও তাদের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং চট্টগ্রামের তৎকালীন নবাব মীর হাদীকে কর না দিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এতে চট্টগ্রামের নবাব ক্ষুব্ধ হয়ে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে জমিদার জালাল খাঁ�র প্রাসাদ ও যাবতীয় স্থাপনা ধ্বংস করে দেন। সেই সাথে জুমিয়া চাকমাদের উপরও হামলা চালিয়ে তাদের সবকিছু ধ্বংস করে দেন। ফলে অনন্যোপায় জালাল খাঁ আরাকানের অভ্যন্তরে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানেও তিনি আরাকানীদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে প্রাণত্যাগ করেন। জুমিয়া চাকমারাও প্রাণ রক্ষার্থে নানাস্থানে আশ্রয় নেয়।
সে সময় চট্টগ্রামের দেয়াঙে (আনোয়ারায় থানা) বসবাসরত জালাল খাঁ�র সহযোদ্ধা সেনাপতি শেরমস্ত খাঁ�র ছিল বিশাল প্রতিপত্তি যিনি ক্রমান্ময়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণে চকরিয়া-রামু পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূমির জমিদারী লাভ করেছিলেন। আলীকদম ট্রাজেডির ১৩ বছর পর ঐ শেরমস্ত খাঁই মোগল নবাব জুলকদর খানের কাছ থেকে রাঙ্গুনিয়ার কোদালা এলাকা বন্দোবস্তি এবং পার্বত্য অঞ্চলের জুমকর আদায়ের তহশিলদারী লাভ করেন । সেখানে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত আলীকদম থেকে সহযোদ্ধা মোগল সৈনিক ও তাদের পরিবার পরিজন এবং জুমিয়া চাকমা প্রজাদেরকে নিয়ে এসে বসবাসের সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। উদ্বাস্তু এসব চাকমারা শেরমস্ত খাঁর খামার আবাদে নিয়োজিত হয়। উল্লেখ্য যে, সপ্তদশ শতাব্দীতে শেরমস্ত খাঁর অনুসারী হয়ে কোদালা, পদুয়ায় আগত চাকমারা অনেকে মোগলদের ধর্ম গ্রহণ করে।
১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নবাব মীর কাসিম ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর নিকট চট্টগ্রামের শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর ইংরেজ প্রশাসকগণ রাঙ্গুনিয়ার কোদালা-পদুয়া থেকে অনতিদূরে সাংগু নদী এবং সীতাকুণ্ডের নিজামপুর রোড পর্যন্ত পাহাড়ী অঞ্চল নিয়ে পদুয়া-কোদালার জমিদারির সীমানা নির্দেশ করে দিয়েছিলেন যার দায়িত্বে ছিলেন শেরমস্ত খাঁর উত্তরসরী শের জব্বার খাঁ । তিনি মোগল শাসামলের নিয়মেই ইংরেজদের কর প্রদান করতে থাকেন এবং ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এই কর প্রদান করেছিলেন। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে বার্মার রাজা বোধপায়া ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে নাফ নদীর তীরবর্তী আরাকানরাজ্য আক্রমণ করে দখল করে নেয়। বর্মী সৈন্যদের নৃশংস গণহত্যা ও নির্যাতনের ফলে প্রাণ রক্ষার্থে হাজার হাজার মারমা, চাকমা ও অন্যন্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী নাফ নদী পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার আশ্রয় গ্রহণ করলে তৎকালিন ব্রিটিশ সরকার এসব শরনার্থীদের কর প্রদানের শর্তে পাহাড়ী এলাকায় জুম চাষের সুযোগ করে দেয়। আরাকান থেকে দ্বিতীয় দফায় আগত এ জনগোষ্ঠী চট্টগ্রামের অরণ্যে প্রবেশ করে চলে আসে পদুয়া-কোদালায় এবং পূর্বে আগত গোষ্টিগদ চাকমাদের সাথে সহজেই মিশে যায়। ফলে এসব জুমিয়া চাকমা ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। প্রজার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইংরেজ কতৃপক্ষ জমিদারে উপর করও বাড়িয়ে দেয়। তৎকালীন জমিদার জানবক্স খাঁ কর বৃদ্ধির প্রতিবাদ করেন এবং কর প্রদান বন্ধ করে দেয়। তাতে সরকার তার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালালে তিনি কলিকাতায় গিয়ে ব্রিটিশ কতৃপক্ষের কাছে আত�সমর্পন করতে বাধ্য হন এবং পুনরায় জমিদারি পরিচালায় চুক্তিবদ্ধ হন। পুনরায় যাতে বিদ্রোহ না হয় সে জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে উত্তর রাঙ্গুনিয়ার সমতল ভূমিতে জমিদারি কাচারি প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করে, তারই জমিদারবাড়ির নামানুসারে ঐ এলাকার নামকরণ হয়ে যায় রাজানগর।
রাজানগরে মোগল বংশজাত সর্বশেষ জমিদার বা চাকমাদের রাজা ছিলেন ধরমবক্স খাঁ। তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন চাকমা রমণী কালিন্দীর সাথে এবং মাত্র ২০ বছর বয়সে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর জমিদারীর উত্তরাধিকার নিয়ে তারই স্বগোত্রীয় মীর্জা হোসেন খাঁর সাথে রানী কালিন্দীর দ্বিমত দেখা দেয়। একদিকে মীর্জা হোসেন খাঁর নেতৃত্বে মোগল বংশজাত মুসলিমরা অন্যদিকে রানী কালিন্দীর নেতৃত্বে চাকমা জুমিয়ারা। অপর দিকে বার্মা থেকে বিতাড়িত প্রায় ৪ হাজার বিদ্রোহী তঞ্চগ্যা রানী কালিন্দীর সাথে যোগ দিয়ে চাকমাদের শক্তি বৃদ্ধি করতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের হত্যা ও নির্যাতন শুরু করে। ফলে এসব বাঙালি তথা মোগল পরিবারগুলো প্রাণভয়ে সমতলের দিকে ছুটে যায় এবং পার্বত্য জমিদারী পরিচালনায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে আদালত ধরমবক্স খাঁর স্ত্রী হিসেবে রানী কালিন্দীর পক্ষে রায় ঘোষণা করে। সেই সাথে রানী কালিন্দীর খড়গতলে শত বছরের মোগল জমিদারী মুসলিম পরিবারের হাতছাড়া হয়ে যায়। রানী কালিন্দী তাঁর জমিদারীকালে মোগল ঐতিহ্য দেওয়ান পদবি বাতিল করে তদস্থলে তালুকদার নামক একটি নতুন পদ চালু করেন। তাঁর উত্তরসরী হরিশচন্দ্র পূনরায় মোগলদের সাথে মামলায় জড়িয়ে পড়লে আদালত মোগলদের পক্ষে রায় দেয় (উল্লেখ্য যে, বেশ কটি মোগল পরিবার আজও রাঙ্গুনিয়ায় বসবাস করে আসছে)। এতে হরিশচন্দ্র ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং নতুনভাবে বসবাস স্থাপন করেছিলেন রাঙ্গামাটিতে। এভাবেই ১৭শ-১৮শ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক চাকমা, মারমা এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী গুলো পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসিত হয়ে যায়।
পূর্ববর্তী আলোচনায় নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট যে, পাহাড়ের বর্তমান ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো হল অভিবাসী। সুতরাং তারা চট্টগ্রাম তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের �ভূমিপুত্র� না হওয়ায় আদিবাসী হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
বহিরাগত হওয়ার কারণে ইংরেজ সরকার তাদেরকে নিজ শাসনাধীন মনে করতেন না। চট্টগ্রামের কমিশনার মি. হলহেড ১৮২৯ সালে মন্তব্য করেন যে, � ঞযব যরষষ ঃৎরনবং ধৎব হড়ঃ ইৎরঃরংয ংঁনলবপঃং নঁঃ সবৎবষু ঃৎরনঁঃধৎরবং ধহফ ঃযধঃ বি ৎবপড়মহরুবফ হড় ৎরমযঃ ড়হ ড়ঁৎ ঢ়ধৎঃ ঃড় রহঃবৎভবৎব রিঃয ঃযবরৎ রহঃবৎহধষ ধৎৎধহমবসবহঃ�. ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েলে ব্রিটিশরা এ অঞ্চলকে নন-রেগুলেটড এরিয়া বা অশাসিত-এলাকা হিসেবে উল্লেখ করে এবং ১৯২০ সালে এলাকাটিকে ঊীপষঁংরাব অৎবধ হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকার এলাকাটিকে