পাহাড়ের শান্তি কোন পথে: হান্নান সরকার মানবাধিকার কর্মী।

চুক্তিতে উপজাতি জনগোষ্ঠীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও পক্ষান্তরে পার্বত্য বাঙালি জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত

0

বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের আয়তনের এক-দশমাংশ। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি অপার সম্ভাবনাময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ৪ যুগের বেশি সময় ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদের কবলে। ১৯৭২ সালে সদস্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রকাশ এম.এন লারমার নেতৃত্ব শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র শাখা গঠন করে দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। এম.এন লারমা ২৪ এপ্রিল ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান প্রণেতাদের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ মোট চার দফা দাবি পেশ করেন। দাবিগুলো ছিল—(ক) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন এবং নিজস্ব আইন পরিষদ গঠন (খ) সংবিধানে ১৯০০ সালের রেগুলেশনের অনুরূপ সংবিধির অন্তর্ভুক্তি (গ) উপজাতীয় রাজাদের দপ্তর সংরক্ষণ (ঘ) ১৯০০ সালের রেগুলেশন সংশোধনের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিধিনিষেধ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বসতি স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ। যা স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ও অযৌক্তিক ছিল।

দাবিগুলো সংবিধান ও গণতন্ত্রবিরোধী হওয়ার কারণে সে সময় দাবিগুলো প্রত্যাখ্যান করে শাসকগোষ্ঠী। শুরু হয় কথিত শান্তিবাহিনীর বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ ঠেকাতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাসন আমলে পাহাড়ে সমতল থেকে বাঙালি পুর্নবাসন করে। এরপর শান্তিবাহিনী পাহাড়ে বাঙালি গণহত্যায় মেতে উঠে। রাস্ট্রীয় বাহিনী বনাম শান্তিবাহিনী যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাহাড়ি বাঙালি ও রাস্ট্রীয় বাহিনী ও শান্তিবাহিনী উভয়ে।

পরবর্তীতে সরকার পিসিজেএসএস বা জেএসএস-এর দাবিদাওয়া মেনে নিয়ে ১৯৯৭ সালের ২-রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম নামক একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তিতে উপজাতি জনগোষ্ঠীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও পক্ষান্তরে পার্বত্য বাঙালি জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়। যা বর্তমানে পার্বত্য সমস্যাকে প্রকট করেছে। জেএসএসের দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার পর জেএসএসের একাংশ বিদ্রোহ করে গঠন করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) প্রসিত। যারা স্বায়ত্তশাসন দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্তরালে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। জেএসএসও সশস্ত্র কার্যক্রম বন্ধ করেনি। পার্বত্য চুক্তির মৌলিক শর্ত লঙ্ঘন করে অবৈধ অস্ত্র নিয়ে পূর্বেকার ন্যায় বিদ্যমান থাকে। এরপর পাহাড়ের সমস্যা দীর্ঘ রূপধারণ করে। বর্তমানে পাহাড়ে ৬টি বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন রয়েছে। এই সংগঠনগুলো পাহাড়কে অশান্ত করতে নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে।

উপজাতি সাইবার গ্রুপের প্রচারণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশকে মূল ভূখণ্ড থেকে পৃথক করতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো ভারী অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ গ্রহণসহ প্রতিদেশী দেশগুলোতে আশ্রয় শিবির গড়ে তোলে। পৃথক রাস্ট্রের খসড়া মানচিত্র, মুদ্রা, প্রশাসনিক দায়িত্ব বন্টনের রূপরেখা তৈরি করেন। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা নিয়ে সংকট তৈরি হয়। এই গভীর ষড়যন্ত্র দীর্ঘদিনের।

পার্বত্যবাসী বলছেন, বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র  সংগঠনগুলো চাঁদাবাজি ও আধিপত্য প্রশ্নে অনৈক্য হলেও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে একই নীতি অবলম্বন করে। যা পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসবাদের সমস্যাকে দিনদিন নিয়ন্ত্রণের বাহিরে নিয়ে যাচ্ছে৷ ১৯৯৭ সালের রাজনৈতিক সমঝোতা চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের সমস্যা, সংকট, জাতিগত সংঘাত হ্রাস পেয়েছে ঠিক। বাস্তববিক অর্থেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতি প্রশমিত করতে পারেনি চুক্তি।

আজকে পাহাড়ে ৬টি আঞ্চলিক দল বা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আলাদা আলাদা দাবিদাওয়া নিয়ে রাস্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করছে৷ যা অযৌক্তিক ও অপ্রত্যাশিত বলে তাদের বর্তমান দাবিদাওয়ার যৌক্তিকতা বিচার-বিশ্লেষণ করে অনুমেয়। ৯৭ সালের চুক্তির মাধ্যমে তাদের বর্তমান দাবিদাওয়া অনেকটাই মিটে গেছে৷ কিন্তু বর্তমানে তথাকথিত দাবিদাওয়ার নামে পাহাড়ে জাতির অধিকার বিষয়ে যে আন্দোলন করছে তার অন্তরালে চাঁদাবাজি ও ক্ষমতার ভাগাভাগি।

স্থানীয় অধিবাসীরা বলছেন, পাহাড়ের স্থায়ী শান্তি স্থাপনে বাধা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো। এই সশস্ত্র সংগঠনগুলোর শাখা প্রশাখা এতটাই নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করেছে তা নির্মূল বর্তমানে কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকার ১টি সংগঠনের সঙ্গে চুক্তি করেছে৷ এখানে আরো ৫টি সংগঠনের আলাদা আলাদা দাবি। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে পূর্বের চুক্তিতে বর্তমান দাবিগুলোর অনেক শর্ত চুক্তিতে রয়েছে৷ তারপরও একই দাবিতে সংগঠনগুলো আন্দোলন করছে৷ এই থেকে অনুয়েম তাদের দাবিদাওয়া উদ্দেশ্য প্রণোদীত। তথাকথিত আন্দোলনের নামে পাহাড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে চাঁদাবাজি ও ক্ষমতার ভাগাভাগি করে আসছে। এর মাধ্যমে পাহাড়ের স্থায়ী শান্তি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে৷ যেহেতু পূর্বের চুক্তি পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে পারেনি সেহেতু নতুন কোন চুক্তি পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে পারবে বলে মনে হয়না। এই পথে বা রাজনৈতিক পথে পাহাড়ের শান্তি ফিরানো কোনভাবেই সম্ভব নয়। এর উদ্দেশ্য হল- পাহাড়ের সংগঠনগুলোর আন্দোলন জাতির অধিকার বিষয়ের চেয়ে বাংলাদেশ থেকে পৃথক হওয়া ও চাঁদাবাজি ও ক্ষমতা ভাগাভাগি গুরুত্ব নির্ভর। তাই তারা যতই অধিকারের কথাই বলুক তারা বাস্তবিক অর্থেই পার্বত্য সমস্যা নিরসনের পক্ষে নয়। পার্বত্য সমস্যা জিইয়ে রাখতে তারা ইস্যু ভিত্তিক কার্যক্রম করে।

বাঙালি ভিত্তিক সংগঠনের সাবেক এক নেতা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্তৃক বাঙালি নির্যাতিত বা হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে এসব ঘটনা দামাচাপা দিতে উপজাতিরা নিজেদেরকে ভুক্তভোগী হিসেবে প্রচার করে। আজকে পাহাড়ের সবকিছুর নিয়ন্ত্রক বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠনগুলো। তারা পাহাড়ে জাতিগত, ধর্মীয় ভেদাভেদ তৈরি করে পার্বত্য পরিবেশ অশান্ত করে। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করে। পাহাড়ের উপজাতিরা শিক্ষা, চাকরি, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে। পক্ষান্তরে পাহাড়ের বাঙালি সংগঠনগুলো কোন্দল, অনৈক্য ও বিভাজনের ফলে নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ছে পার্বত্য বাঙালিরা। নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে বাঙালিদের দাবিদাওয়া উপেক্ষিত৷

পার্বত্য চট্টগ্রামের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি রমিজ উদ্দিন জানান, আজকে পাহাড়ের সংগঠনগুলোর হাতে রয়েছে ভারী সব অস্ত্র। যা দিয়ে তারা বাংলাদেশ নামক রাস্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। আমরা পার্বত্য চুক্তির পরেও পাহাড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি ও মৃত্যুর মিছিল দেখে আসছি। পাহাড়ে চলে বাঙালি ও রাস্ট্র বিরোধী তৎপরতা। এসব বন্ধে রাস্ট্রীয় পদক্ষেপ স্পষ্ট নয়। উপরন্তু চুক্তি ব্যতীত এযাবৎ পার্বত্য নিয়ে রাস্ট্রের কোন যুগোপযোগী পদক্ষেপ দেখা যায়নি৷ যার ফলে পাহাড়ের শান্তি স্থাপনে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। রাজনৈতিক পথে না হেটে শান্তি স্থাপনে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার প্রয়োজন। পাহাড় থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে চিরনি অভিযান পার্বত্য চট্টগ্রামের আপাময় জনতার দাবি। ত্রিদেশীয় সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার প্রয়োজনে সীমান্তের যেসব এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নেই বা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নেই সেখানে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে সীমান্ত দিয়ে সন্ত্রাসীদের যাতায়াত ও অবৈধ অস্ত্র পারাপার বন্ধ করতে হবে৷ এর মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে। এর কোনটির ব্যাঘাত ঘটলে পাহাড়ের শান্তি অধরা রয়ে যাবে।

লেখক: হান্নান সরকার, বিশিষ্ট লেখক ও মানবাধিকার কর্মী।
১৮/১০/২০২৪
রাঙামাটি।

 

আগের পোস্টপার্বত্য চট্টগ্রামে সকল গণহত্যার দায়ে সন্তুুলারমাকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
পরের পোস্টপার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতিদের বিচার বহির্ভূত হত্যার দায়ভার কার?

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন