পাহাড়ে জমি বেচাকেনার হেডম্যান প্রথার বিলুপ্তি চায় বাঙালিরা।

0

জিহান মোবারক, হিল নিউজ বিডি পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রতিনিধি: ১৮৯২ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪নং বিধিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩৩টি তালুককে ১.৫ থেকে ২০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে মৌজায় বিভক্ত করার ব্যবস্থা রাখা হয়। এই বিধি মোতাবেক মৌজা ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৩৭নং বিধিতে তিনজন সার্কেল চিফের ৩টি সার্কেলকে মৌজায় বিভক্ত করার পুনঃ বিধান করা হয়। সেই একই বিধিতে প্রত্যেক মৌজায় একজন করে মৌজা প্রধান (হেডম্যান) নিয়োগের বিধান রাখা হয়। তিন পার্বত্য জেলার তিনটি সার্কেলে বর্তমানে ৩৯০টি মৌজায় বিভক্ত১৪।

হেডম্যান নিয়োগ পদ্ধতি: পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪৮নং বিধিমতে সার্কেল চীফের সাথে পরামর্শ করে ডেপুটি কমিশনার মৌজা হেডম্যান নিয়োগ করবেন, যদিও পরামর্শ গ্রহণ এক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক নয়। তবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে তাঁর পরামর্শ বিবেচনার দাবী রাখে। হেডম্যান পদটি বংশানুক্রমিক নয়। তবে হেডম্যানের উপযুক্ত পুত্র হেডম্যান পদে নিয়োগ লাভের বেলায় অগ্রাধিকারের দাবী রাখেন।

হেডম্যানের ক্ষমতা ও কার্যাবলী

১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৩৮নং বিধিতে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে মৌজা হেডম্যান নিষ্ঠার সাথে তার মৌজার জন্য নির্ধারিত খাজনা আদায় করবেন এবং মৌজার বকেয়া খাজনার হিসাব রাখবেন। তিনি ডেপুটি কমিশনার, মহকুমা প্রশাসক (বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী অফিসার) এবং সার্কেল চীফ এর আদেশ মেনে চলবেন। তিনি তার মৌজায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখবেন এবং মৌজাস্থিত গ্রামসমূহের চাষাবাদে আয়তনের কোনো পরিবর্তন ঘটলে তৎসম্পর্কে ডেপুটি কমিশনারকে অবহিত করবেন। এছাড়াও খাজনা আদায়সহ যাবতীয় কাজ সম্পূর্ণ করবেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে হেডম্যান নিয়োগ, খাজনা আদায় ও তার কার্যক্রম দেশের প্রচলিত আইন মোতাবেক নয়। এখানে হেডম্যান প্রথা সংবিধান পরিপন্থী।

হেডম্যান প্রথার দোহাই দিয়ে জমি বেচাকেনার সময় ও বিভিন্ন কাজে মৌজা হেডম্যানের প্রতিবেদন ও সার্কেল চীফ সনদ প্রয়োজন। এই প্রতিবেদন পেতে পার্বত্য বাঙালিরা জায়গা জায়গাই হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। হেডম্যান উপজাতি সম্প্রদায়ের হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজ নামে বৈধ জায়গা জমি থাকার পরও হেডম্যান প্রতিবেদন পেতে নানা হয়রানির শিকার হচ্ছে। আর যারা ভূমিহীন তাদের পক্ষে হেডম্যান প্রতিবেদন পাওয়া অসম্ভব। এছাড়াও হেডম্যান প্রতিবেদন ছাড়া স্থানীয় বাসিন্দা সনদ (ডিসি সনদ) ও চীফ সার্কেল সনদ পাওয়া সম্ভব নয়। পাহাড়ের মানুষদের জমি বেচাকেনা ও চাকরি-বাকরিসহ বিভিন্ন কাজে অপ্রত্যাশিত ভাবে এসব সনদ প্রয়োজন।

স্থানীয় বাঙালিরা বলছেন, হেডম্যান মোটা অংকের টাকা ও দালাল ছাড়া প্রতিবেদন প্রদান করেন না। হেডম্যান উপজাতি সম্প্রদায়ের হওয়ার কারণে আমরা তিন পার্বত্য জেলার বাঙালিরা দীর্ঘদিন ধরে হয়রানির শিকার হয়ে আসছি।

খাগড়াছড়ি মহালছড়ির বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম জানান, “আমার দাদার নামে সম্পত্তি৷ এখনো পিতা ও আমার নামে বন্টন হয়নি। আমি জমি ক্রয় করতে গিয়ে হেডম্যান প্রতিবেদনের জন্য আটকে গেছি। অসাংবিধানিকভাবে হেডম্যান প্রতিবেদনের দোহাই দিয়ে জমি বেচাকেনা আটকে দেওয়া নাগরিক অধিকার হরনের শামিল। আমরা হয়রানিমূলক হেডম্যান প্রতিবেদনের বিলুপ্তি চাই”

রাঙামাটি জুরাছড়ির বাসিন্দা জামাল হোসেন বলেন, “আমার ছেলের চাকরির জন্য ডিসি সনদের প্রয়োজন হয়েছে৷ আমার নিজ নামে ভূমি না থাকায় আমার ছেলে হেডম্যান প্রতিবেদন পায়নি। পরে এক দালালকে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে হেডম্যান প্রতিবেদন নিতে হয়েছে। একটা গণতান্ত্রিক দেশে সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইন থাকার স্বত্বেও তথাকথিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির অজুহাত দিয়ে হেডম্যান প্রথা জিইয়ে রেখে পাহাড়ের বাঙালিদের হয়রানির সম্মুখীন করছে। এটি পার্বত্য বাঙালি হিসেবে আমাদের জন্য হয়রানির ও লজ্জার। হেডম্যান প্রথা বিলুপ্তি ছাড়া পাহাড়ের বাঙালিদের নিস্তার নেই”

বাঙালিদের অভিযোগ, হেডম্যানরা পাহাড়ে অনেক প্রভাবশালী। রাজা বাদশাহ এর মত ভাবে চলেন। তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। মৌজার বাসিন্দারা দেখা করতে পূর্বানুমতি লাগে৷ অনেক সময় দেখা যায় বাঙালিদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে। অভিযোগ আছে, হেডম্যানরা এলাকায় থাকেন না। মৌজার বাসিন্দারা খাজনা পরিশোধসহ যাবতীয় কাজে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। পাহাড়ে হেডম্যান এক হয়রানির নাম।

দীর্ঘদিন ধরে বাঙালিরা জমি বেচাকেনা, চাকরি ও বিভিন্ন কাজে হেডম্যান প্রতিবেদনের জন্য হয়রানির শিকার হচ্ছে। তা অবসানে গত ১৫ আগস্ট স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষে বান্দরবান জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য এডভোকেট আবু জাফর ও এডভোকেট মো.শাহজাহান সার্কেল চীফ কর্তৃক ইস্যুকৃত স্থায়ী বাসিন্দা সনদ এবং হেডম্যান প্রতিবেদন দাখিলের আইন বহিভুর্ত নিয়ম বাতিলের দাবী জানিয়ে ডেপুটি কমিশনার বান্দরবান বরাবর আবেদন করেছে। লিখিত আবেদনে আইনজীবীদ্ধয় জানান, তারা পার্বত্য জেলায় স্থায়ী বাসিন্দা ও বাংলাদেশের নাগরিক।পেশায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা দায়রা জজ আদালতে কর্মরত রয়েছেন।
‘দ্যা চিটাগাং হিলট্রেক্টস রেজিষ্ট্রেশন ১৯০০ এর ১৮(২)(সি)নং বিধি অনুসারে সরকারের রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্তে বিধি প্রনয়ন করার অধিকারী এবং উক্ত বিধি অনুসারে প্রণিত রুলস ফর এডমিনিস্ট্রেশন অব দ্যা সিএইচটি এর ১২ নং বিধি অনুসারে অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রয়,দান,
বন্টন,বন্ধকী দলিল,অবস্থাবর সম্পত্তির লীজ দলিল,অবমুক্তির সার্টিফিকেট,স্টেট ও সম্পত্তির তত্বাবধায়ক নিয়োগ সংক্রান্ত দলিল সমুহের নিবন্ধন বাধ্যতামুলক।একই বিধিমালায় ১৭ বিধি অনুসারে কোন দলিলে অস্থাবর সম্পত্তির সুনির্দিষ্ট বিবরণ না থাকলে,উক্ত দলিল নিবন্ধন যোগ্য হয় না।বর্ণিত বিধিমালায় সার্কেল চিফ এর সনদ কিংবা হেডম্যান প্রতিবেদন সংযুক্তির বিধান না থাকা স্বত্বেও বে-আইনী ভাবে ও অবৈধ ভাবে দলিল নিবন্ধন কার্যক্রমে ও নামজারী কার্যক্রমে সার্কেল চিফ কর্তৃক ইস্যুকৃত স্থায়ী বাসিন্দা সনদ ও হেডম্যান প্রতিবেদন সংযুক্ত করে জমা দিতে বলা হয়।’দ্যা চিটাগাং হিলট্রেক্টস রেজুলেশন ১৯০০ এর রুলস ফর দ্যা এডমিনিস্ট্রেশন অব দ্যা সিএইচটি এর ২৫ নং বিধিতে দলিল নিবন্ধনের পুর্বে দলিল সম্পাদনকারীগণ’কে সনাক্ত করার বিধান রয়েছে।যা উক্ত বিধি প্রনয়নের সময় অর্থাথ ১৯০০ সালে কঠিন দু:সাধ্য থাকলেও জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন ২০২৩ অনুয়ায়ী শতভাগ নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তির পর উক্ত পরিচয়পত্রের মাধ্যমে সনাক্তকরণ প্রক্রিয়া সহজতর হয়েছে।দ্যা চিটাগাং হিলট্রেক্টস রেজুলেশন ১৯০০ এর বিধান অনুযায়ী ১৯০০ সালে রুলস ফর দ্যা এডমিনিস্ট্রেশন অব দ্যা সিএইচটি প্রনয়নের সময় হইতে ২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অধ্যাদেশ প্রনয়নের পুর্ববতী সময় পর্যন্ত বান্দরবান পার্বত্য জেলার নাগরিকদের উক্ত জেলার বাসিন্দাদের সমর্থনে কোন দলিলপত্র ছিল না বিধায়,কাজের সুবিধার্থে বোমাং সার্কেল চিফের কাছ থেকে সনদপত্র ইস্যু করা হলেও ২০০৮ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অধ্যাদেশ মুলে নাগরিকদের আনুকুলে বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ পুর্বক ছবি সহ জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যু করার উক্ত সনদপত্র আইনগত ভাবে অকার্যকর এবং অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।উক্ত বোমাং সার্কেল চিফের স্থায়ী বাসিন্দা সনদপত্র ইস্যু সংক্রান্ত একাধিক জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।উক্ত সনদ সংগ্রহ করতে গিয়ে বান্দরবান জেলার নাগরিকদের আর্থিক এবং মানসিক হয়রানীর মুখোমুখি হতে হয়।এ রুপ পরিস্থিতিতে বোমাং সার্কেল চিফ সংক্রান্তে স্থানীয় জনগণের মধ্যে নেতিবাচক ধারনার সৃষ্টি হচ্ছে।যা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বান্দরবান পার্বত্য জেলার প্রচলিত আইন ও বিধিতে সরাসরি সাফ কবলা দলিল সম্পাদনের ক্ষেত্রে কোন বাধা-নিষেধ না থাকলেও অজ্ঞাত কারণে সাফ দলিল নিবন্ধন করা হচ্ছেনা এবং বে-আইনী ভাবে ক্রেতা-বিক্রেতাগণকে বায়নানামা দলিল সম্পাদনে বাধ্য করা হচ্ছে।এর ফলে চিকিৎসার খরচ সহ বা অন্যান্য ব্যক্তিগত প্রয়োজনে জমি বিক্রি করতে ইচ্ছুক জমি বিক্রেতাগণ অপুরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
কিছু ক্ষেত্রে অসাধু জমি বিক্রেতাগণ একাধিক ব্যক্তিকে বায়নানামা দলিল সম্পাদন করে দেওয়ায় ক্রেতাগণের মধ্যে দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিরোধের সৃষ্টি হচ্ছে।১৯০০ সালে দ্যা চিটাগাং হিলট্রেক্টস রেজুলেশন ১৯০০ এর অধীনে রুলস ফর দ্যা এডমিনিস্ট্রেশন অব দ্যা সিএইচটি-এ জমির নামজারী সুনির্দিষ্ট বিধান নাই।১৯৫০ সালের জমিদারী অধিগ্রহণ ও প্রজাতন্ত্র আইনের ১৪৩ ধারা অনুসারে বাংলাদেশে(তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানে) নামজারীর কার্যক্রম শুরু হয়।উক্ত বিধান অনুসরণ করে পার্বত্য চট্রগ্রাম তথা বান্দরবান পার্বত্য জেলায় নামজারীর কার্যক্রম চালু করা হলেও ক্রেতার স্থলে বিক্রেতাকে নামজারী কার্যক্রমে দরখাস্তকারী হিসাবে সম্পুর্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়,যা আইনসঙ্গত নয় এবং কষ্ট সাধ্যও বটে।জমি বিক্রয়ের পর বিক্রেতার স্বার্থ নি:শেষ হওয়ায় নামজারী কার্যক্রমে বিক্রেতার আগ্রহ কম থাকায় নামজারী কার্যক্রম দীর্ঘসুত্রিতায় পর্যবসিত হয়। উপরন্ত নামজারী কার্যক্রমে হেডম্যান প্রতিবেদন দাখিলের বিধান চাপিয়ে দেওয়া, যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির কোন বিধান দ্ধারা সমর্থিত নয়। এ রুপ অবস্থায় হেডম্যান প্রতিবেদনের অজুহাতে দরিদ্র ক্রেতা-বিক্রেতাগণ থেকে হেডম্যান কার্যালয়ের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ রশিদবিহীন অবৈধ অর্থ আদায় করছেন, যা চাঁদাবাজির শামিল।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে হেডম্যান প্রতিবেদনের নামে বাঙালি হয়রানি বন্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছেন। এই হয়রানি বন্ধে হেডম্যান প্রতিবেদন বিলুপ্তি দাবি দিনদিন জোরালো হচ্ছে।

 

 

আগের পোস্টবিলাইছড়ি জোন কর্তৃক মানবিক সহায়তা প্রদান।
পরের পোস্টজেএসএস বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চেতনা বিরোধী।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন