উখাইচিং মারমা বান্দরবান পার্বত্য জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার মংবাইতং পাড়ার মারমা সম্প্রদায়ের তরণী। পরিবার অসচ্ছল হওয়ার কারণে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে পড়ে এই মারমা তরণীর। পরিবারের ভরণপোষণের জন্য পাড়ি জমান সূদুর চট্টগ্রামে। দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে চাকরি করার সুবাধে অনেক বাঙালি সহপাঠীর সঙ্গে পরিচয় হয়।
আজ শনিবার(০২ নভেম্বর) সকালে বাঙালি সহপাঠীর সঙ্গে এক বিশেষ কাজে বের হন। বাঙালি সহপাঠীসহ সিএনজিতে যাওয়ার পথিমধ্যে চট্টগ্রাম বাম সিগনাল থেকে পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠনের উগ্রবাদী ছাত্র সংগঠনসহ কিছু পাহাড়ি উশৃংখল যুবক সিএনজি থামিয়ে উখাইচিং মারমাকে তার সঙ্গে থাকা বাঙালিসহ আটক করে। আটকের পর দু’জনকে হেনেস্তা করে। ধরে নিয়ে মারধর করে এবং মোটা অংকের চাঁদা দাবি করে। একটি রুমে আটকিয়ে রেখে গণধর্ষণের হুমকি প্রদর্শন করে এবং হেনেস্তা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়েই তাকে সামাজিক বয়কটের ডাক দেয় এবং তার পরিবারের সদস্যদের জরিমানা ও সমাজচ্যুত করার হুমকি প্রদর্শন করে।
পাহাড়ি সূত্রগুলো বলছে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন পাহাড়ি মেয়েকে সন্ত্রাসীরা বা যে কেউ ঘায়েল করতে বাঙালির সঙ্গে কথা, প্রেম, বিয়ে কিংবা অবৈধ সম্পর্কের অজুহাত দেখিয়ে নির্যাতন, ধর্ষণ ও গণধর্ষণ পূর্বক হত্যা করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এমনই প্রমাণ অহরহ আছে। এই তরুণীর ভাগ্যেও এমন পরিণতি হয়তো অপেক্ষামান। জানা গেছে, তরুণী তার সাহসিকতা দেখান এবং এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। তাকে বড়ো ধরণের ক্ষতিসাধন এখন পর্যন্ত করতে পারেনি ঠিক কিন্তু মধ্যযুগীয় কায়দায় মারধরের পাশাপাশি অজ্ঞাতস্থানে আটকিয়ে এবং বাঙালির সঙ্গে সম্পৃক্ত বা ধরা পড়েছে এধরণের মিথ্যা ও বানোয়াট তকমা দিয়ে তার ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছে উগ্রবাদী পাহাড়ি যুবকরা। এবং তাকে ঘিরে নোংরা মন্তব্য ও গণধর্ষণের হুমকিসহ তার স্বাভাবিক জীবনকে বিষন্ন করে তুলছে। বিষয়টি প্রশাসন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
ভিডিও লিংক: https://www.facebook.com/share/v/19USEJ889A/?mibextid=oFDknk
একাধিক সূত্র বলছে, উগ্রবাদী পাহাড়ি ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসীরা উখাইচিং মারমার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে তার স্পর্শকাতর স্থানেহাত দেন এবং তার সামাজিক নিরাপত্তা লঙ্ঘিত করেন।
পাহাড়ি নারীদের উপর এভাবেই যৌন নিপিড়ন ও মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সত্যিই উদ্বেগজনক। বিষয়টি পাহাড়িদের জন্য লজ্জাজনক ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন সচেতন মহল।
পাহাড় নিয়ে চিন্তাশীলরা বলছেন, পাহাড়ি পুরুষরা অকর্মা, মাতাল, নেশাগ্রস্ত ও মদ-গাঁজা খোর এবং একাধিক নারীতে আসক্ত৷ তাই পাহাড়ি নারীরা বাঙালি পুরুষদের স্বামী হিসেবে পেতে মুখিয়ে থাকে। পাহাড়ি নারীদের পছন্দের তালিকায় বাঙালি পুরুষরা। তাই অকর্মা ও মাতাল পাহাড়ি পুরুষরা পাহাড়ি মেয়েদের বাঙালি ছেলেদের সঙ্গে কথা, প্রেম কিংবা বিয়ে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে এক কঠিন শাস্তির বিধান জারি রেখেছে পাহাড়ি সমাজে।
অসীম চাকমা নামে খাগড়াছড়ি রামগড়ের এক বাসিন্দা এবং এক পাড়া কার্বারী জানান, পাহাড়ি সমাজে গণধর্ষণের শাস্তি মাত্র একটি শুকর দান। যার মূল্য বা বাজার দর (২০) হাজার টাকা ধরা হয়। শুকরের রক্ত দিয়ে ধর্ষিত মেয়েকে গোসল করিয়ে ধর্ষককে দায়মুক্তি দেওয়া হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাহাড়ি যুবকরা পাহাড়ি মেয়েদের প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করে থাকে। পাহাড়ি মেয়েদের স্বাধীনতা নেই। তারা, শিক্ষা, চাকরি ও মানসিক বিকাশে পথে পথেই বাধাপ্রাপ্ত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা নারীদের ভোগ্যপণ্য হিসেবে ব্যবহার করছে। আঞ্চলিক সন্ত্রাসী দলগুলো এজন্য পাহাড়ি নারীদের সবসময় শিক্ষা ও চাকরি এবং আধুনিকতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এটি আমাদের নারীদের সবকিছু থেকে পিছিয়ে রাখছে। এটা দ্বারা আমাদের ধ্বংস অনিবার্য।
বিশিষ্ট আইনবিদ, কবির হোসেন ভূঁইয়া বলেন, একজন নারী অন্যায় করলে তার পিতা বা সমাজ শাস্তি দেওয়ার রেওয়াজ আছে, এবং দেশের প্রচলিত আইন আছে তার শাস্তি প্রদানে। কিন্তু পাহাড়ি আঞ্চলিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো এসব মানছেন না। তারা পাহাড়ি সমাজ ব্যবস্থাকেও নিয়ন্ত্রণ করে। যার কারণেই তথাকথিত পাহাড়ি ছাত্র সংগঠন ও পাহাড়ি যুব সমাজ নিষ্ঠুর প্রথার মাধ্যমে নারীটিকে ধরে নিয়ে মারধর, নিলাম ও জরিমানা করে। এমনকি গণধর্ষণ পূর্বক হত্যা করে। গত এক দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে।
পাহাড়ি সমাজে নারীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ ও বৈষম্যমূলক প্রথার বিষয়ে জানতে মানবাধিকার কর্মী রুহুল আমিন তুহিনের কাছে প্রশ্ন রাখলে তিনি বলেন, একাকী একজন কিশোরী, মেয়ে বা নারীকে নির্জনস্থানে নিয়ে মারধর ও গণধর্ষণ করা পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি নিত্যনৈমৈত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাহাড়ি সমাজের কিছু বুদ্ধিজীবি পাহাড়ে পান থেকে চুন খসলে বাঙালি ও সেনাবাহিনীর চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করেন। এবং তাদের সাথে মিলে আমাদের দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, তথাকথিত বিশিষ্টজন ও গণমাধ্যম সরগরম করেন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী নির্যাতন বা নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে তাদের ভূমিকা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা অনেক ঘটনায় দেখেছি, পাহাড়ি নারীদের বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাকে সমাজের চোখে কালি মেখে দেয়া হয়৷ তার পুরো পরিবারকে সমাজচ্যুত করা হয়। একজন নারী ও তার পরিবার একটি কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করে থাকে। বেশিরভাগ সময় দেখা যায় পাহাড়ি মেয়েদের উপর চালানো স্টিমরোলার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে অন্যান্য পাহাড়ি মেয়েদের বাঙালিদের সঙ্গে মেলামেশা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। যা একজন নারীর ভবিষ্যতে জীবন অন্ধকারে ধাবিত করে।
বিনয় চাকমা নামে পাহাড়ের এক শিক্ষক বলেন, পাহাড়ের এই ভয়াবহ নারী নির্যাতন এদেশের তথাকথিত গণমাধ্যমে উঠে আসেনা। আমাদের দেশের তথাকথিত মানবাধিকার, সুশীল সমাজ ও নারীবাদীরা এই নিয়ে বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করেনা। প্রতিদিনই পাহাড়ে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার সঠিক তদন্ত ও জড়িতদের শাস্তি হয়না। যার কারণে এ অপরাধ দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রনি তালুকদার নামে একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তরুণীকে ঘিরে মন্তব্য করে লেখেন, উখাইচিং মারমাকে এখন পর্যন্ত তার অভিভাবকের হাতে তুলে দেয়া হয়নি। উগ্র যুবকরা মারধর ও নির্যাতনের পর আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদলের হাতে তুলে দিবে। এমনই তথ্য জানা গেছে। তরুণীর ভাগ্যে কী আছে সেটা একমাত্র সৃষ্টি কর্তায় ভালো জানেন। একজন নারীকে প্রকাশ্যে এইভাবে মারধর, হেনেস্তা করা সভ্য সমাজের কাজ হতে পারেনা।
একজন মেয়ের কী স্বাধীনতা থাকতে পারেনা? বাঙালি সহপাঠী থাকতে পারেনা? কে কার সঙ্গে কথা বলবে বা সম্পর্ক করবে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার বা স্বাধীনতা। এইটা বাংলাদেশ এখানে সবার অধিকার এবং স্বাধীনতা আছে। বাঙালি কী কারো বন্ধু বা সহপাঠী হতে পারেনা? এজন্য একজন তরুণীকে নির্যাতন-নিপীড়ন, হেনস্তা এবং সামাজিক অপদস্ত হতে হবে? এটা কোথাকার আইন বা নিয়ম?
ইউটিউব লিংক:
পাহাড়ে এভাবেই নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি ও নারীর প্রতি সহিংসতা ও তার অধিকার লঙ্ঘিত করলে অচিরেই পাহাড়ের নারীরা সভ্যতার থেকে দূরে সরে যাবে৷ যার ক্ষতি ভোগ করতে হবে সবাইকে। একটি কথা মনে রাখতে হবে নারী হচ্ছে প্রজন্ম বৃদ্ধির হাতিয়ার৷ যে কারো মা, কারো বোন বা স্ত্রী। তাই নারীর প্রতি সকল অন্যায় অবিচার রুখে দাঁড়াতে হবে৷
লেখক: হান্নান সরকার, বিশিষ্ট লেখক, ব্লগার ও গবেষক এবং মানবাধিকার কর্মী।