পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয়দের প্রথাগত ভূমি অধিকার ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি।

0

সোহেল রিগ্যান, পার্বত্য চট্টগ্রাম: পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তিতে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। এ অঞ্চলের ভিন্ন ভাষাভাষী উপজাতি জনগোষ্ঠীর প্রথাগত ভূমি অধিকার ও ভূমি ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি রয়েছে। প্রথাগত ভূমি অধিকারের উপর দাঁড়িয়ে আছে উপজাতি জনগোষ্ঠী। এছাড়াও বিভিন্ন জাতির সমাজ ব্যবস্থার নিজস্ব প্রথা-পদ্ধতি ও রীতিনীতি বিদ্যমান।  যদিও এসব প্রথা, পদ্ধতি ও রীতিনীতি দেশের ৬১ জেলা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

ছবি: সংগৃহীত ফসল কাটছে উপজাতি নারী-পুরুষ

পার্বত্য চট্টগ্রাম সবসময় প্রাকৃতিক সম্পদ, বনজ সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, এবং বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীরসহ ভৌগোলিক কারণে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড। এ অঞ্চল নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সবসময় ছিল। সবকিছু মিলিয়ে এ অঞ্চল নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র চলমান। কিন্তু তারপর এ অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর জীবনমান থেমে নেই৷ তাদের নিজেস্ব প্রথা, রীতিনীতি, অধিকার ও সংস্কৃতি ঐতিহ্য নিয়ে তারা এখনো টিকে আছে। যা দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করে এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে।

বৃটিশ শাসন আমল আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানার সূত্রপাত ঘটে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকারকে প্রধানত: দু’ভাগে ভাগ করা যায়।

যথা- ১. প্রথাগত অধিকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি (Hill Tracts Mannual)

২. ১৯৯৭ ২ -রা ডিসেম্বর চুক্তির আলোকে ভূমি অধিকার

প্রথাগত অধিকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি: পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের প্রথাগত অধিকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিকে আবার দু’ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করতে পারি। যথা-

ক. চিরাচরিত প্রথা

খ. পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি (Hill Tracts Mannual) ও অন্যান্য আইন

ক. চিরাচরিত প্রথা: পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা যুগ যুগ ধরে জুমচার করে আসছে। জুমভূমি উপজাতিদের সমষ্টিগত মালিকানার উপর প্রতিষ্ঠিত। সমষ্টিগত মালিকানা হলেও এটি অত্যন্ত সুশৃংখলভাবে পরিচালিত হয়।

চিরাচরিতভাবে প্রতিষ্ঠিত এই পদ্ধতি এমন যে, এক জুমচাষী অপর জুমচাষীর জুমভূমি কখনোই দখল করে না। যে জুমচাষী কোন পাহাড়কে চাষ করবে সে জুমভূমি সেই প্রথম চাষীর জুমভূমি হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। তবে, পতিত অবস্থায় এই জুমভূমি থেকে গ্রামের নিবাসী সকলের লাকড়ি , কলা পাতা, গাছ, বাঁশ ও বনজ শাক-সবজি সংগ্রহের অধিকার রয়েছে।

তা’ছাড়া প্রথম চাষাবাদকারী ব্যক্তির অনুমতি নিয়ে গ্রামের যে কেউ উক্ত জুমভূমির উপর জুম চাষ করতে পারে। এভাবেই উপজাতিরা জুমভূমির উপর তাদের সমষ্টিগত মালিকানা নিশ্চিত করে আসছে।

খ. পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনবিধি ও অন্যান্য আইনের আলোকে: বৃটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের প্রথাগত বিষয়সমূহ শাসনবিধিতে সম্পূর্ণরূপে স্বীকৃতি প্ৰদান ননগ করলেও আংশিক স্বীকৃতি প্রদান করেছে। বৃটিশ সরকার উপজাতিদের প্রথাগত প্ৰতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে এবং কথিত রাজা ও হেডম্যান- এর ক্ষমতা পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিবিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। যদিও তা বাংলাদেশ সংবিধানের সঙ্গে পরিপন্থী, এবং দেশের প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

বৃটিশ সরকং উপজাতিদের সমষ্টিগত মালিকানা ব্যবস্থাকেও আংশিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে এবং মৌজা প্রধানের উপর মৌজার ভূমি ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা অর্পন করেছে।

,বৃটিশ সরকার ১৮৯২ সালে Rules  for Administration of the Chittagong Hill Tracts, 1892’ জারী করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ৪টি সার্কেলে ভাগ করে।

বৃহত্তর সার্কেল ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল’ সরাসরি বৃটিশ সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত আর সার্কেল চীফগণের সার্কেলভূক্ত অঞ্চল ডেপুটি কমিশনারের নেতৃত্বাধীনে সরাসরি রাজা ও হেডম্যান কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বৃটিশ আমল থেকে বর্তমান অবধি তিন সার্কেলে অন্তর্ভুক্ত জমির ক্ষেত্রে রাজা-হেডম্যান তথা ঐতিহ্যবাহী প্ৰতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে আসছে।

বৃটিশ কর্তৃক প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির মধ্য দিয়ে পার্বত্য উপজাতিদের কতগুলি অধিকার ভোগ করতো। এর অন্যতম দিকগুলো হলো-

১. বৃটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘শাসন বহির্ভুত অঞ্চল’ ছিলো। এ বিধান পার্বত্য চটগ্রাম অঞ্চলকে একটি আদিবাসী অঞ্চল হিসেবে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপণ ভূমিকা পালন করেছে।

২. বৃটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিতে অধিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের আংশিক বিষয় স্বীকৃতি প্রদান করে। বৃটিশ সরকার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতিস্বরপ চীফ সার্কেল-হেডম্যানকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির আওতাধীন করে তাঁদের উপর বেশ কিছু ক্ষমতা প্রদান করেছে, যা নিম্নরূপ:

ক. সার্কেলের আওতাধীন জমি বন্দোবস্তের ক্ষেত্রের মৌজা প্রধানের সুপারিশ ও মতামত গ্রহণের বিধান রাখা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন ও রীতি মোতাবেক মৌজা প্রধানের সুপারিশ ও মতামত ব্যতিত মৌজাধীন কোন জায়গা জমি বন্দোবস্ত হতে পারেনা। [৩৪ ধারা]।

খ. পার্বত্য চটগ্রামে জমি ও জুম খাজনা সংগ্রহ করবে প্ৰথাগত প্রতিষ্ঠান। [ধারা ৪২ ও ৪৩]

গ. পার্বত্য চট্টগ্রামে সামাজিক শৃংখলা রক্ষা ও সামাজিক বিচারি কার্যাদি সম্পাদন করবেন চিফ, হেডম্যান ও কার্বারী। পার্বত্য চট্রগ্রাম শাসনবিধির ৪০ ধারায় উল্লেখ রয়েছে- ‘মৌজা প্রধানগণ সংশ্লিষ্ট অধিবাসী কর্তৃক আনীত বিরোধীয় সকল বিষয়ের উপর বিচারপূর্বক সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন। মৌজা প্রধানগণ সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের প্রচলিত সামাজিক রীতি অনুসারে পার্বত্য ট্রাইবেলদের বিচার কার্য সম্পাদন করবেন। এ ধরণের বিচারে হেডম্যান সর্বোচ্চ ২৫ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবেন।

ঘ. ডেপুটি কমিশনার জেলার সার্বিক প্রশাসন পরিচালনা বিষয়ে সার্কেল চীফের পরামর্শ গ্রহণ করবেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিতে এই বিধান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির ৩৮ ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, ‘সার্কেল চীফগণ ডেপুটি কমিশনারের উপদেষ্টা কাউন্সিল হিসেবে পরিগণিত হবেন এবং সংশ্লিষ্ট সার্কেলের প্রশাসন সংক্রান্ত সকল বিষয়ে তথ্য ও উপদেশ দিয়ে জেলা প্রশাসককে সহায়তা করবেন।

ঙ. প্রাকৃতিক ও বনজ সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব মৌজা প্রধানের। পার্বত্য চটগ্রাম শাসনবিধির ৪১ ধারায় এ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। মৌজার সম্পদ সংরক্ষণের উদেশ্যে মৌজা প্রধান-

১. কোন নিবাসী গৃহস্থালী কাজে ব্যতিত অন্য কোন কাজে তাঁর মৌজা হতে বাঁশ, কাঠ বা অন্যান্য বনজ দ্রব্য অন্য কোন মৌজায় এবং অনিবাসী কোন ব্যক্তিকে যেই কোন কাজে, অনুরূপ কিছু অপসারণ নিষিদ্ধ করতে পারবেন।

২. মৌজাস্থ কোন এলাকা বা এলাকাসমূহে বাঁশ, কাঠ বা অন্যান্য বনজ দ্রব্য সংরক্ষণের ঐ এলাকা বা এলাকাসমূহকে জুমচাষের আওতামুক্ত করা হয়েছে মর্মে ঘোষণা প্রদান করতে পারবেন।

প্রথাগত সম্পদ-অধিকার-

(১) প্রাকৃতিক সম্পদ অধিকারভোগী আইন/প্রথা পরিচালনা কর্তৃপক্ষ।

(২) জুমভূমি উপজাতি পরিবার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধি ৫০ ধারা হেডম্যান।

(৩) জুমভূমি উপজাতি পরিবার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধি ৪১ ধারা হেডম্যান, জেলা প্রশাসক/পার্বত্য জেলা পরিষদ।

(৪) ব্যবহৃত জুমভূমি উপজাতি পরিবার সনাতনী প্রথা হেডম্যান।

(৫) বনজ দ্রব্য মৌজায় বসবাসকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধির ধারা ৪১ (এ) হেডম্যান ও কার্বারী

(৬) চারণ ভূমি মৌজায় বসবাসকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধির ৪৫ (বি) হেডম্যান ও জেলা প্রশাসক/ পার্বত্য জেলা পরিষদ

(৭) তৃণভূমি মৌজায় বসবাসকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধির ধারা ৪৫ হেডম্যান ও জেলা প্রশাসক/ পার্বত্য জেলা পরিষদ

(৮) বন্য প্রাণী উপজাতি জনগণ সনাতনী প্রথা হেডম্যান ও সার্কেল চীফ
জলজ সম্পদ মৌজায় বসবাসকারীরা সনাতনী প্রথা হেডম্যান।

(৯) বৃহৎ জলাধারসমূহ মৌজায় বসবাসকারীরা সনাতনী প্রথা হেডম্যান
ক্ষুদ্র জলাশয় মৌজায় বসবাসকারীরা সনাতনী প্রথা হেডম্যান।

(১০) প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ মৌজায় বসবাসকারীরা/সরকার জেলা প্রশাসকের তাৎক্ষণিক নির্দেশ, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন (সংশোধিত) ১৯৯৮ হেডম্যান ও জেলা প্রশাসক/ পার্বত্য জেলা পরিষদ।

উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিতে উপজাতিদের অনেকগুলো প্রথাগত অধিকার স্বীকার করে নিলেও বৃটিশ সরকারের প্রতিনিধি ডিপুটি কমিশনারের নিকট অনেক ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন।

মৌজা প্রধান নিয়োগ, ভূমি বন্দোবস্ত ও লীজ প্রদানের চূড়ান্ত ক্ষমতা ডেপুটি কমিশনারের হাতে রেখে দেওয়া হয়। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে চট্টগ্রামে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে এ ক্ষমতা পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তরের বিধান করা হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমির মালিকানার ধরণ:
১. প্রথাগত মালিকানা

২. অপ্রথাগত মালিকানা

১. প্রথাগত মালিকানা
বৃটিশ আগমনের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের জমি ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণরূপে প্রথাগত নীতি পদ্ধতির ভিত্তিতে পরিচালিত হতো। একসময় পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীরা সবাই জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। জুমভূমির উপর ব্যক্তির এক ধরণের অলিখিত মালিকানা থাকলেও এই জুমভূমির উপর গ্রামবাসীর সমষ্টিগত অধিকার ছিলো।

জুমভূমির প্রথাগত মালিকানা পদ্ধতি হলো-  যে ব্যক্তি প্রথমবার কোন পাহাড়ে জুমচাষ করবে সে পাহাড় বা জুমভূমির মালিক হবে প্রথম চাষাবাদকারী ব্যক্তি। এই জুমভূমি কেউ যদি চাষ করতে চায় তা’হলে জুমভূমির মালিকের (প্রথম চাষী) অনুমতি নিয়ে চাষাবাদ করতে হবে। মালিকানার জন্য কোন কাগজ পত্রের প্রয়োজন হয় না।

প্রথা পদ্ধতি ও মূল্যবোধ এরকমই যে, কোন জুমভূমি মালিকের অনুমতি ব্যতিত অন্য কেউ সেখানে চাষ করে না। তবে জুমভূমির তরিতরকারী, বাঁশ বা লাকড়ি সংগ্রহের ক্ষেত্রে গ্রামবাসীর সকলের অধিকার রয়েছে।

ভূমির ধরণ, মালিকানার ধরণ, ব্যবহার
(১ ) জুমভূমি সমষ্টিগত মালিকানা জুমচাষের জন্য।
(২) মৌজা রিজার্ভ সমষ্টিগত মালিকানা বন সংরক্ষণ ও গাছ বাঁশের জন্য।
(৩) গো চারণভূমি সমষ্টিগত মালিকানা গরু মহিষ চারণের জন্য।
(৪) গ্রাম সমষ্টিগত মালিকানা গৃহ নির্মাণ ও বসবাসের জন্য।
(৫) শশ্মান/কবর সমষ্টিগত মালিকানা মৃতদেহ সৎকারের জন্য।

২. অপ্রথাগত মালিকানা
সারাদেশে রাষ্ট্রীয় আইনের আলোকে যেভাবে ভূমির মালিকানা পায়, অনুরূপ আইনও পার্বত্য চটগ্রামে প্রচলিত।এই মালিকানা তিন ধরণের হয়ে থাকে। যেমন-

ক. ব্যক্তির নামে মালিকানা: সারা বাংলাদেশে ব্যক্তির নামে যেরূপ ভূমির মালিকানা রয়েছে, অনুরূপভাবে ব্যাক্তর নামে ভূমির মালিকানা পার্বত্য চট্টগ্রামেও রয়েছে। অনেকেই মনে করেন পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যক্তির নামে কোন জায়গা জমির বন্দোবস্তী নেই।

এরা মনে করেন পার্বত্য চটগ্রামের সকল ভূমি সমষ্টিগত মালিকানার অধীন। আসলে তা সঠিক নয়। পার্বত্য চটগ্রামে মাত্র কয়েক ধরণের জমিই সমষ্টিগত মালিকানাধীন। এগুলি হল- ১. জুমভূমি, ২. গো চারণভূমি ও ৩. মৌজা রিজার্ভ বা কালিত্র, ৪. গ্রামভূমি, ৫. শশ্মান ইত্যাদি।

পার্বত্য চটগ্রামে মূলত: হালচাষের জমিগুলি বন্দোবস্তীকৃত ও ব্যক্তি মালিকানাধীন। তবে পাহাড় সমতল ও বেশ কিছু উঁচু-নীচু বন্দোবস্তীকৃত ও ব্যক্তি মালিকানাধীন রয়েছে। কোন কোন ব্যক্তির নামে ২৫ একর বা ততোধিক পাহাড় জমি ৯৯ বছরের জন্য লীজও রয়েছে।

খ. বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের নামে মালিকানা: পার্বত্য চট্টগ্রামের বহু জমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে লীজ, বন্দোবস্তী আছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, এনজিওসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে লীজ ও বন্দোবস্তী রয়েছে।

গ. রাষ্ট্রীয় বা সরকারী প্রতিষ্ঠানের নামে মালিকানা: পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারী বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে জমি বন্দোবস্তী রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সরকারী অফিস যেমন জেলা প্রশাসন কাৰ্যালয়, উপজেলা প্রশাসন কাৰ্যালয়, জেলখানা, শিক্ষা অফিস, কৃষি অফিস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের নামে বন্দোবস্তী রয়েছে।

এসব প্রতিষ্ঠান সরকারী হলেও সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে জমির খাজনা প্রদান করতে হয় স্থানীয় হেডম্যানকে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ ও নিষ্পত্তি, ভূমি ব্যবস্থাপনা সমতল এলাকার ভূমি ব্যবস্থাপনা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ ও নিষ্পত্তি ও সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এই অঞ্চলের ঐতিহ্যগত বা প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অত্যধিক। পার্বত্য চটগ্রামের ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনিক ব্যবস্থা তিন স্তরবিশিষ্ট।

যথা:
১. সার্কেল প্রশাসন
২. মৌজা প্রশাসন
৩.গ্রাম প্রশাসন।
এই প্রথাগত প্রতিষ্ঠানগুলো জমি, ও বন ব্যবস্থাপনা, জুম ও জমির রাজস্ব, জেলার আইন শৃঙ্খলাসহ নানা বিষয়ে ডেপুটি কমিশনারকে পরামর্শ প্রদান, সামাজিক বিচার, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সেবামূলক কাজে ভূমিকা রাখা ইত্যাদি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে থাকে।

সার্কেল চীফ এর দায়িত্ব ও কার্যাবলী
(১) সার্কেল চীফ বা কথিত রাজা নিজ নিজ সার্কেলের প্রধান। আইনের বিধান মোতাবেক সার্কেল চীফ সংশ্লিষ্ট জেলার ভেপুটি কমিশনার, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডকেও  অন্যান্য বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করতে পারেন। সার্কেল চীফ প্রয়োজন মনে করলে পার্বত্য জেলা পরিষদের সভায় উপস্থিত থাকতে পারেন এবং মতামত পেশ করতে পারেন।

(২) সার্কেল চীফ হিসেবে তিনি ডেপুটি কমিশনারের পরে সাব-কালেক্টর বা সরকারের খাজনা আদায়কারী।

(৩) তিনি মৌজার হেডম্যান নিয়োগ ও অপসারণে ডেপুটি কমিশনারকে পরামর্শ দিয়ে থাকে।

(৪) মৌজা হেডম্যানগণ কর্তৃক খাজনা আদায় ও এলাকার শক্তি – শৃংখলা বজায় রাখাসহ অপরাধ দমনে তাঁদের প্রতি আদেশ নির্দেশ ও পরামর্শ প্রদান চীফ সার্কেলের দায়িত্ব ও ক্ষমতার আওতাধীন।

(৫) মৌজা হেডম্যান কর্তৃক আদায়কৃত খাজনা বা রাজস্ব সরকারী কোষাগারে জমা দান নিশ্চিত করা চীফের দায়িত্ব।

(৬) এলাকার জনগণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ও স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।

(৭) ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনিক ব্যবস্থার সর্বোচ্চ পদের অধিকারী হিসেবে সার্কেল চীফ স্ব স্ব সার্কেলের স্থায়ী বাসিন্দার সার্টিফিকেট প্রদানের একমাত্র আইনত: চূড়ান্ত অনুমোদনকারী।

(৮) ডেপুটি মিশনারের আদালতে বিচারাধীন মামলায় প্রথাগত আইন ও সামাজিক রীতি নীতির ব্যাখার প্রয়োজনে ডেপুটি কমিশনার সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ এর নিকট মতামত আহবান করলে তিনি তাঁর ব্যাখা ও মতামত প্রদান করে থাকেন।

(৯) সার্কেল চীফ কার্বারিদের নিয়োগ প্রদান করে থাকেন যিনি ভূমি ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক বিচার সম্পাদনে মৌজা প্রধানকে সহযোগিতা প্রদান করে থাকেন।

(১০) কমিশনারের মঞ্জুরী সাপেক্ষে সার্কেল চীফ যে মেীজার অধিবাসী সেই মৌজাকে খাস মৌজা হিসেবে নিজের হেফাজতে রাখতে পারবেন।

(১১) সার্কেল চীফ মৌজা হেডম্যানগণের রাজস্ব ও কল্যাণমূখী প্রশাসন বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।

(১২) সার্কেল চীফ হেডম্যান ও কার্বারীদের মাধ্যমে স্ব স্ব সার্কেলের বন, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে

ভূমিকা পালন করে থাকেন।

মৌজা হেডম্যানের দায়িত্ব ও কার্যাবলী
(১) হেডম্যান ভূমি রাজস্ব ও জুম খাজনা সংগ্রহ করেন।

(২) হেডম্যান ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ভূমি বন্দোবস্তী, হস্তান্তর, ক্রয়-বিক্রয়, ভূমির সীমানা নির্ধারিণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেন এবং এ সব ক্ষেত্রে মৌজা প্রধানেরমতামত ও সুপারিশ গ্রহণ বাধ্যতামূলক।

(৩) তিনি মৌজার আইন শৃংখলা ও সামাজিক শৃংখলা রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

(৪) তিনি ভূমির রেকর্ড সংরক্ষণ করেন।

(৫) হেডম্যান মৌজার স্থায়ী বাসিন্দার সার্টিফিকেট প্রদান করে থাকেন।

(৬) তিনি জুম চাষী পরিবার প্রধানের নাম, পরিবারের সদস্য সংখ্যা, খাজনা মওকুফপ্রান্ত পরিবার ইত্যাদি তথ্য সম্বলিত জুম তৌজি তৈরী করেন এবং জুম চাষ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।

(৭) তিনি ঘাস/শনখোলা ও গর্জন খোলার খাজনা এবং গো চারণভুমির ট্যাক্স আদায় করেন।

(৮) হেডম্যান মেজার বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি মৌজার বনজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট না করার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারী করতে পারেন। হেডম্যান মৌজাস্থ কোন এলাকার বনজ সম্পদ সংরক্ষণের স্বার্থে জুম বা অন্য কোন চাষ করার ক্ষেত্রে নিযেধাজ্ঞা জারী করতে পারেন।

(৯) যদি হেডম্যানের বিবেচনায় নবাগত কেউ তাঁর মৌজায় জুম চাষ করলে পরবর্তী বছর মৌজাবাসীর জুম চাষে জমির সংকট দেখা দেবে বলে মনে হয়, তাহলে তিনি তাঁর মৌজায় নবাগতদের জুম চাষ নিষিদ্ধ করে দিতে পারেন।

(১০) জুম চাষের জন্য ক্ষতিকর প্রতীয়মান হলে হেডম্যান তাঁর মৌজায় গোচারণ নিষিদ্ধ করে দিতে পারেন।

(১১) জেলা প্রশাসকের আনুষ্ঠানিক বন্দোবস্তী ব্যতিরেকে পৌর এলাকা বহির্ভূত মেীজায় মৌজা হেডম্যান তাঁর মৌজার কোনো উপজাতি বাসিন্দাকে বসতবাড়ি নির্মাণের জন্য সর্বোচ্চ ০.৩০ একর জমি ভোগ দখলে রাখার অনুমতি দিতে পারেন। তবে এসব বসতবাড়ীর দখলভুক্ত রাখার জন্য তাকে একটি রেজিষ্টার তৈরী করে রাখতে হবে।

(১২) সরকারী ভূমি বন্দোবস্ত, হস্তান্তর, ভাগ-বন্টন এবং সাবলেট প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মেীজা হেডম্যান সুপারিশ প্রদানের ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন।

(১৩) হেডমান মৌজার জনগণের স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ এলাকার সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।

কার্বারী প্রথা ও কার্বারী প্রশাসন
কার্বারী প্রশাসন পার্বত্য চট্টমের ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনের সর্বশেষ স্তর। এটি এই প্রশাসনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তর। মৌজা প্রধানের সহকারী হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ ও নিষ্পত্তি , গ্রামে বন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, গ্রামের শান্তি-শৃংখলা, সামাজিক বিরোধ নিষ্পত্তি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা, গ্রামের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অবকাঠামো ইত্যাদির উন্নয়নে কার্বারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

কার্বারীর ক্ষমতা ও কার্যাবলী বিষয়ে হিলট্রাক্টস ম্যানুয়েল বা পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে বিস্তারিত কোন কিছু লেখা নেই। তবে এটি একটি প্রথাসিদ্ধ বিষয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সমাজ জীবনে শত শত বছর ধরে এটি চলে আসছে। নিম্নে কার্বারীর ক্ষমতা ও কার্যবিলী বিষয়ে আলোকপাত করা হল-

১. কার্বারী গ্রামের সকল ধরণের মামলা (ফৌজদারী ও দেওয়ানী) নিষ্পত্তি করে থাকেন। জরিমানা আরোপের ক্ষেত্রেও কোন ধরণের সিলিং নির্ধারিত নয়। কার্বারী প্রয়োজন ও যুক্তি মাফিক দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের নিকট থেকে জরিমানা আদায় করে থাকেন।

২. কার্বারী গ্রমীন সমাজের সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষা ও সমাজের সকল প্রকার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।

৩. গ্রামীন মানুষের জীবনে এমন কোন বিষয় বা কাজ নেই যেখানে কার্বারী সংশ্লিষ্ট নন।

৪. কার্বারী গ্রামভিত্তিক সামাজিক উৎসব পালন ও পূজা পার্বনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

৫. কার্বারী মৌজা প্রধানকে রাজস্ব আদায়, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি ইত্যাদি কাজে সহায়তা করেন।

৬. কার্বারী মৌজা প্রধানকে জুম নিয়ন্ত্রণ, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে সহযোগিতা প্রদান করে থাকেন।

বৃটিশ সরকার ১৮৯২ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি “Rules for the administration of the Chittagong Hill Tracts’ সংশোধন ও সংযোজন করে ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন (Regulation of 1900) নামে একটি আইন জারী করে। এই আইনটি পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘হিলস্ট্রাক্টস ম্যানুয়েল’ বা ‘১৯০০ এ্যাক্ট’ নামে সমধিক পরিচিত। বৃটিশ প্রণীত এই আইনটি পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো জারি রয়েছে। আইনটিকে আদালত বিভিন্ন সময় মৃত্যু আইন হিসেবে রায় দেয়। পক্ষ বিপক্ষ আপিলের পর আইনটি বহাল ও স্থগিত থাকে দীর্ঘদিন। তবে শাসনবিধির ২৭টি বিষয় সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণেই তা সংশোধন নিয়ে ২০১৮ সালে সুপ্রীম কোর্টে রিভিউ করেছেন বাঙ্গালীদের পক্ষে খাগড়াছড়ি জেলার বাসিন্দা আব্দুল আজিজ আখন্দ ও আব্দুল মালেক। যা শুনানির মধ্যে পড়ে আছে।

শাসনবিধির আইন এবং পরবর্তীতে প্রণীত আইনের ভিত্তিতে ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের বিভিন্ন জাতির সমাজ ব্যবস্থার নিজস্ব প্রথা-পদ্ধতি ও রীতিনীতি বিদ্যমান।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা এদেশ থেকে চলে যাওয়ার পরেও সার্কেল চিফরা তাদের এই প্রথা চালু রেখেছিলো। সমতলের জমিদার প্রথার সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্কেল প্রথার ভিন্নতা রয়েছে। সমতলের জমিদারদের জমি কেনা বেচার অধিকার থাকলেও সার্কেল চিফদের জমির মালিকানা ছিলো না। ১৯০০ সালের আইন অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জমির মালিক সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসক। সার্কেল চিফরা হলো তাদের উপদেষ্টা ও পরামর্শক। পাকিস্তান আমলে জমিদারী অধিগ্রহণ আইন করার পর জমিদারদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্কেল প্রথা চালমান রয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে সরকারের পক্ষে ট্যাক্স আদায় করাই তাদের মূল দায়িত্ব। একই সাথে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীগুলোর প্রথাগত আইনে সামাজিক বিচার-শালিস করার দায়িত্বও তাদের। উচ্চ শিক্ষিত এবং আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এর প্রয়োজনীয়তা ফিকে হয়ে এলেও পার্বত্য তিন জেলায় এখনো টিকে আছে এই সার্কেল প্রথা।

প্রতি বছর সার্কেল চীফরা তাদের অধীনস্ত এলাকার অধিবাসীদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে। এর থেকে নামমাত্র একটা অংশ সরকারী কোষাগারে জমা দেয় আর বড় অংশই যায় তাদের ব্যক্তিগত কোষাগারে। নিজেদের কোষাগারকে আর্থিকভাবে হৃষ্টপুষ্ট করার এই বাণিজ্যের কারনেই তারা নানান ধরনের অযুহাত আর আইন দেখিয়ে এই সার্কেল প্রথা চালু রেখেছে।

১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ১৯৯৯ সালে পার্বত্য পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকার ২০০১ সালে চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন প্রণয়ন করে। আইনে বলা হয়েছিল যে আদালতের সিদ্ধান্তগুলি দেওয়ানি আদালতের রায়ের মতো হবে এবং কোথাও চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এই আইনে কমিশনকে কাজ করার জন্য একগুচ্ছ নিয়ম প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় এবং ২০১৯ সাল পর্যন্ত সরকার তা করেনি। সরকার ২০১৩ সালে এই আইন সংশোধন করে যা পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনারের ক্ষমতা হ্রাস করে এবং ২০০১ সালে চট্টগ্রাম জমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনে থাকা ছয় মাসের মধ্যে কমিশনের জন্য বিধি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা সরিয়ে দেয়। কমিশনে প্রায় ২৩,০০০ অভিযোগ নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

কমিশনের নেতৃত্বে রয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা সদস্য,  ও তিন চিফ সার্কেল সদস্য। বিপুল সংখ্যক মামলা সত্ত্বেও কমিশন নিয়মের অভাবে জমি বিরোধের বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত দেয়নি। ২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটি সার্কিট হাউসে কমিশনের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ার-উল-হকের সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন কী?

পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১ (২০০১ সনের ৫৩ নং আইন )

কমিশনের কার্যাবলী ও ক্ষমতা ৬৷ (১) কমিশনের কার্যাবলী নিম্নরূপ হইবে, যথা:-
১। (ক) পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ এবং অবৈধ বন্দোবস্ত ও বেদখল হওয়া ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা।

(খ) আবেদনে উল্লিখিত ভূমিতে আবেদনকারী, বা ক্ষেত্রমত সংশ্লিষ্ট প্রতিপক্ষের, স্বত্ব বা অন্যবিধ অধিকার পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত

২। আইন, রীতি ও পদ্ধতি, অনুযায়ী নির্ধারণ এবং প্রয়োজনবোধে দখল পুনবর্হাল;

৩। (গ) পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি বহির্ভূতভাবে জলেভাসা ভূমিসহ (Fringe Land) কোন ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান বা বেদখল করা হইয়া থাকিলে উহা বাতিলকরণ এবং বন্দোবস্তজনিত বা বেদখলজনিত কারণে কোনো বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল:

তবে শর্ত থাকে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী অধিগ্রহণকৃত ভূমি এবং বসতবাড়ীসহ জলেভাসা ভূমি, টিলা ও পাহাড় ব্যতীত কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা ও বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকার ক্ষেত্রে এই উপ-ধারা প্রযোজ্য হইবে না।

(২) উপ-ধারা (১) এ বর্ণিত কার্যাবলী পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমিত থাকিবে ।

(৩) উক্ত কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের নিমিত্ত কমিশন যে কোন সরকারী বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় তথ্য, উপাত্ত বা কাগজপত্র সরবরাহের এবং প্রয়োজনে উক্ত কর্তৃপক্ষের যে কোন কর্মকর্তাকে স্থানীয় তদন্ত, পরিদর্শন বা জরীপের ভিত্তিতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিতে পারিবে এবং উক্ত কর্তৃপক্ষ বা কর্মকর্তা উহা পালনে বাধ্য থাকিবেন ।

(৪) কমিশন বা চেয়ারম্যান বা কমিশন কর্তৃক ক্ষমতা প্রদত্ত কোন সদস্য কোন বিরোধীয় ভূমি সরেজমিনে পরিদর্শন করিতে পারিবেন ।

১। দফা (ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০১৬ (২০১৬ সনের ৪৫ নং আইন) এর ৫(ক) ধারাবলে প্রতিস্থাপিত।

২। ‘‘আইন, রীতি ও পদ্ধতি’’ শব্দগুলি ও কমা ‘‘আইন ও রীতি’’ শব্দগুলির পরিবর্তে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০১৬ (২০১৬ সনের ৪৫ নং আইন) এর ৫(খ) ধারাবলে প্রতিস্থাপিত।

৩। দফা (গ) পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০১৬ (২০১৬ সনের ৪৫ নং আইন) এর ৫ (গ) ধারাবলে প্রতিস্থাপিত।

পার্বত্য বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন ও তার আইনকে দেশের সংবিধান ও প্রচলিত ভূমি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে ৫ বাঙালি সংগঠন একত্রিত হয়ে হরতাল-অবরোধ করে। কমিশনে বাঙালি সদস্য অন্তর্ভুক্তির দাবি তোলে। কিন্তু কমিশন থেমে থেমে বারবার আইন সংশোধন ও কার্যক্রম পরিচালনার চেষ্টা চালায়। বাঙালিরা সোচ্চার থাকায় তা বেশি দূর এগুতে পারেনি।

বাঙালিদের অভিযোগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি (১৯০০ সার্কেল আইন) অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের সবধরনের ভূমির উপর উপজাতিদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত। প্রতিটি উপজাতি সদস্য বা পরিবার ৩০ শতক ভূমি হেডম্যানের অনুমতিক্রমে মালিক হবেন। পক্ষান্তরে পার্বত্য বাঙালিরা তা থেকে বঞ্চিত৷ এই কারণে পাহাড়ের বাঙালিরা পিছিয়ে আছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি (হিলটেক্স ম্যানুয়েল ১৯০০) অনুযায়ী যদি ভূমি কমিশনের বিধিমালা চূড়ান্ত করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ৮ লক্ষ বাঙালি ভূমিহারা হবে এবং এই অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পাবে। এমনটা এই আইনের প্রথা, পদ্ধতি ও রীতিনীতি এবং পরবর্তী যুক্ত আইন বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রতীয়মান হয়েছে। বাঙালিরা বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসাধারণ চায় দেশের প্রচলিত ভূমি আইনে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা হোক। দেশের ৬১টি জেলায় দেশের প্রচলিত ভূমি আইনে যেখানে বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয় সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন দেশের সাংবিধানিক আইনকে অবজ্ঞা করে প্রথাগত আইনে নিষ্পত্তি করা হবে? এটা সম্পূর্ণ সংবিধান বহির্ভূত। যদি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথাগত আইনে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ হারাবে এ অঞ্চলের উপর, এবং  এ অঞ্চলে বসবাসরত বাঙ্গালী জনগণ রোহিঙ্গাদের মত নিজদেশে পরবাসী হবে।
যদি উক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করে কমিশনের চেয়ারম্যান ভূমি মালিকানার রায় প্রদান করেন। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৭৯ সাল থেকে ৮৬ সাল পর্যন্ত সেসকল বাঙ্গালীদের হেডম্যান প্রতিবেদন ব্যতিরেকে বন্দোবস্ত প্রদান করেছে জেলা প্রশাসক (ডিসি) তা বাতিল হবে। 

ভূমি কমিশনের এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করার কোন সুযোগ নেই৷ এই আদালত যে রায় দিবে সেই রায় মেনে নিতে হবে! অথচ আমাদের দেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাই নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ আছে। এই থেকে অনুয়েম যে, পার্বত্য ভূমি কমিশনের বিধিবিধান এবং কার্যক্রম সম্পূর্ণ সংবিধানপরিপন্থী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালী ও সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করার নীলনকশা।

তাই সরকারের কাছে আবেদন, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথাগত আইনে পার্বত্য চট্টগ্রাম  ভূমি নিষ্পত্তি কমিশনের বিধিমালা চূড়ান্ত না করে দেশের প্রচলিত ভূমি আইনে করুন। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙ্গালী জনগণ উপকৃত হবে এবং নিজেদের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হবে।

তথ্য সূত্র:
(১) শক্তিপদ ত্রিপুরা
(২) হিলস্ট্রাক্টস এ্যাক্ট

আগের পোস্টসভ্যতার যুগেও পাহাড়ি নারীরা পরাধীনতার শিকলে বন্দী।
পরের পোস্টপাহাড়ি বাঙালি সংঘাতের মূলহোতা হিসেবে অভিযুক্ত ইউপিডিএফ।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন