জুলাই-আগস্ট বিপ্লব পরবর্তী ইউপিডিএফ এর ১০০ কোটি টাকা চাঁদাবাজি।

স্থানীয় অধিবাসীরা বলছেন, নীরবে চলছে চাঁদাবাজি।

0

অনন্ত অসীম ও বিজয় দাশ, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ প্রতিনিধি, হিল নিউজ বিডি: ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট সংক্ষেপে ইউপিডিএফ, (United People’s Democratic Front), পাহাড়ের একটি আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন। এটি ১৯৯৭ সালের ২-রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর চুক্তির বিরোধিতা করে স্বায়ত্তশাসন দাবি রেখে সংগঠনটি ঢাকায় এক কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাবাদর্শ গণতন্ত্র, সমতা। রাজনৈতিক অবস্থান, বামপন্থী আর, আনুষ্ঠানিক রঙ, লাল। এটির রাজনৈতিক শাখা সরাসরি কার্যক্রম করার স্পষ্ট গঠনতন্ত্র থাকলেও ইউপিডিএফ মূলত সশস্ত্র কার্যক্রম দিয়ে টিকে আছে।

সংগঠনটির কনফারেন্স শেষে পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয় যেটির আহ্বায়ক হন প্রসিত বিকাশ খিসা আর সদস্য সচিব হন রবিশঙ্কর চাকমা।

সংগঠনটি পাহাড়ে অস্ত্রের ভয়ভীতি দেখিয়ে অপহরণ, খুন-গুম আর চাঁদাবাজি করার মাধ্যমে এ অঞ্চলের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করে আসছে। গত দুই দশকে সংগঠনটির কার্যক্রম পাহাড়ের মানুষ অতিষ্ঠ৷ এখানকার জনজীবনে পড়েছে তার প্রভাব।

সাম্প্রতিক জুলাই-আগস্ট বিপ্লব পরবর্তী সময়ে ইউপিডিএফ পাহাড়ের কয়েক হাজার আওয়ামীলীগ নেতাকর্মী ও নিরীহ মানুষদের থেকে মোটা অংকের চাঁদাবাজি করার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় অধিবাসীরা বলছেন, নীরবে চলছে চাঁদাবাজি। চলছে ইউপিডিএফ অস্ত্রধারী চাঁদাবাজদের গোপন দৌড়ঝাঁপ। নানা কৌশলে নীরব চাঁদাবাজির বিষয়টি পাহাড়ি জনসাধারণে ক্ষোভ তৈরি করেছে। কিছুতেই থামছে না এই চাঁদাবাজি। ছোটখাটো ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিগত ক্ষমতাসীন দলের নেতা-পাতি নেতা, জনপ্রতিনিধি, কারও যেন নিস্তার নেই পাহাড়ের ভয়ঙ্কর চাঁদাবাজদের হাত থেকে ফসকে যাওয়ার। বড়-ছোট ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষ আতঙ্ক নিয়ে রাতে ঘুমাতে যান, পরদিন সকালে না-জানি কার কাছে ফোন আসে চাঁদার দাবিতে। পাহাড়ের গ্রামে গ্রামে চলছে ইউপিডিএফের সশস্ত্র টহল। এতে বেড়েছে জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক।

ছাত্রজনতার গণ-আন্দোলনের মুখে শুধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর বাম রাজনৈতিক দল ও বিএনপি বড়ো সমর্থক দাবি করা ইউপিডিএফ পাহাড়ে আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের বাড়ি ছাড়া ও হত্যার হুমকি দিয়ে বিপুল পরিমাণ চাঁদা আদায় করেছেন। এই চাঁদাবাজির টাকায় নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করেছেন। এবং রাস্ট্রের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ইউপিডিএফ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন-গুম, অপতৎপরতা ও গণবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছে। অস্ত্রের জোর আর ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে পুরো পাহাড়কে চাঁদাবাজির আখড়ার পরিণত করেছে।

খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলার গ্রাম থেকে ইউপিডিএফ এর বিরুদ্ধে হুমকি-ধামকি ও মারধর, অত্যাচার ও অপহরণ পূর্বক চাঁদাবাজির মারাত্মক অভিযোগ আসছে।

অভিযোগের প্রেক্ষিতে এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইউপিডিএফ ৫-ই আগস্টের পর থেকে আওয়ামীলীগ ও নিরীহ পাহাড়ি সম্প্রদায়ের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা মানুষদের অপহরণ শুরু করে। অপহরণ করে সর্ব নিম্ন ২ লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও ব্যক্তি থেকে চাঁদার পরিমাণ বৃদ্ধি করার খবর পাওয়া গেছে।

জানা গেছে উপজাতি আওয়ামীলীগের সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দ ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, সদস্য ও জনপ্রতিনিধিদের তবল করে এবং মোবাইলে যোগাযোগ করে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করে।

একাধিক তথ্য মতে জানা গেছে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতা করেছে, এমন ব্যক্তি, সোর্সরা চাঁদা দিতে বাধ্য হয়েছেন৷

বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করে আর রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান থেকে ৯৮ লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় করে। পরিষদের সদস্য থেকে ২০ লাখ টাকা থেকে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন।

উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান থেকে ২০ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। মেম্বারদের থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করে।

আওয়ামীলীগের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীদের থেকে ৫০ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন। সহযোগী অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ৫ লাখ টাকা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন।

ইউপিডিএফকে বিভিন্ন সময় সহযোগিতা না করার কারণে বা ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে নিরীহ মানুষদের থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়।

চাঁদা প্রদানকারী পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ বলেছেন, ইউপিডিএফ গত ৫ আগস্টের পর থেকে তাদেরকে খুঁজতে থাকে৷ কাউকে অপহরণ করে, কাউকে ডেকে নিয়ে আবার কিছু ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্যের তুলে নিয়ে এই চাঁদা আদায় করেন। যারা ধরাছোঁয়ার বাহিরে ছিল তাদেরকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে চাঁদা আদায় করেন।

ইউপিডিএফ ৫ আগস্টের পর আওয়ামীলীগ নেতা ও নিরীহ মানুষদের নির্যাতন করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পায়ে ও গলায় শিকল লাগিয়ে নির্যাতন করার অভিযোগ ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে গুরুতর।

চাঁদা প্রদানকারী বেশিভাগই বলছেন, যারা একসঙ্গে দাবিকৃত মোটা অংকের চাঁদা পরিশোধ করতে পারেনি তাদের থেকে চাঁদা বিভিন্ন কিস্তিতে আদায় করে আসছেন।

যেসব আওয়ামীলীগ নেতা-পাতি নেতা বা জনপ্রতিনিধি চাঁদা পরিশোধ করেছেন, তারা এখনো রয়েছে আতঙ্কে। ইউপিডিএফকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা, দেশবিরোধী সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশ নেওয়াসহ সংগঠনকে সময়ে সময়েই চাঁদা পরিশোধ করতে দেওয়া হয়েছে অনেক কঠিন শর্ত। এবং যে কোন সময় ডাক দিলে যেন হাজির হন এমন শর্ত রয়েছে।

বিশেজ্ঞরা ধারণা করছেন, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বা কর্মসূচীতে জনসমর্থন দেখাতেই ইউপিডিএফ আওয়ামীলীগের নেতা-পাতি নেতাদের দূর্বলতার সুযোগে ব্যবহার করতে পারেন।

স্থানীয়রা বলছেন, বিভিন্ন ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও ব্যক্তিদের থেকে চাঁদার পরিমাণ বৃদ্ধি করে গত ২ মাস ধরে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করার অভিযোগ উঠেছে। খাগড়াছড়ির শালবাগানের বাসিন্দা আমির হোসেন জানান, ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রণ এলাকায় বাঙালিদের যাতায়াত সীমিত করেছে। বাঙালি ব্যবসায়ী, জাহেদ হোসেন বলেন, ইউপিডিএফ বাঙালিদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করাসহ বাঙালি ব্যবসায়িদের পাহাড়ে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না এবং সরকারি উন্নয়নমূলক কাজে বাধাপ্রাপ্ত করছে। রাঙামাটি নানিয়ারচর বেতছড়ির বাসিন্দা আব্দুল হাকিম জানান, পূর্বে ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় চাঁদার পরিমাণ ছিল, ৫ থেকে ১০ পারসেন্ট। যা এখন বৃদ্ধি করে ২০ পারসেন্ট করেছে। ফলে থমকে আছে পাহাড়ের উন্নয়নমূলক কাজ।

খাগড়াছড়ি জেলার ৮ টি উপজেলা এবং রাঙামাটি জেলার ৪টি উপজেলাসহ মোট ১২টি উপজেলা থেকে ইউপিডিএফ আনুমানিক ১০০ কোটি সমপরিমাণ চাঁদা আদায় করেছে বলে ধারণা করছে বিশ্লেষকরা। স্থানীয় পাহাড়ি জনসাধারণও তাই মনে করছেন।

চাঁদা প্রদানকারী আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীরা নিরাপত্তাজনিত কারণে সূত্রের মাধ্যমে নাম পরিচয় গোপন রাখতে হিল নিউজ বিডি কে বিশেষ অনুরোধ জানান। তাই তাদের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে নাম পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে৷

জানা গেছে, গত ১৫ বছর ধরে ইউপিডিএফ আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সু্বিধা গ্রহণ করেছে। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সুযোগ গ্রহণকারী ইউপিডিএফ বৈষম্যমূলক কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরোধী ছিল৷ ছাত্রজনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর সাংগঠনিক অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি মজবুত করতে ইউপিডিএফ এই সুযোগ কাজে লাগান। পাহাড়ে রাতারাতি ইউপিডিএফ বাঘ বনে যান। প্রতিনিয়ত ইউপিডিএফ চাঁদাবাজির শিকার পাহাড়ের কয়েক লক্ষাধিক খেটে খাওয়া মানুষ।

সাম্প্রতিক সময়ে তান্ডবলীলা চালান খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলার বিভিন্ন স্থানে। তথাকথিত আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি ও পানিঘোলা করেন। অসাংবিধানিক ও অযৌক্তিক আন্দোলনের নামে পাহাড়ি বাঙালি সংঘর্ষ তৈরি করতে লিপ্ত রয়েছে। মূলত রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছেন। গণবিরোধী কার্যকলাপের কারণে পাহাড়ে চাঁদাবাজ ইউপিডিএফ এর বিরুদ্ধে তৈরি হয়েছে চাপা ক্ষোভ। চাঁদাবাজির মাধ্যমে যে অর্থনৈতিক যোগান আসে তা বন্ধ করে ইউপিডিএফের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে প্রশাসনের নিকট আহ্বান জানান স্থানীয় অধিবাসীরা। তারা বলেন, ইউপিডিএফ আওয়ামীলীগ, বিএনপি ও বাম রাজনৈতিক দলগুলোকে শুধুমাত্র ব্যবহার করেছেন নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থে। দিনশেষে সুযোগ মত ইউপিডিএফ আওয়ামীলীগকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। তাই বাঙালি বিদ্বেষী উপজাতি আওয়ামীলীগ নেতাদের এই থেকে শিক্ষা নেওয়া যেমন প্রয়োজন তেমনি ক্ষমতার মসনদে আসীন দলগুলোর বিষয়টি অনুধাবন করা উচিত বলে মনে করেন সচেতন মহল।

ইউপিডিএফ চাঁদাবাজির এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কি কাজে ব্যয় করবেন।এমন এক প্রশ্নের জবাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে দীর্ঘিদন কাজ করেন, লেখক ও গবেষক এবং মানবাধিকার কর্মী পারভেজ মারুফ বলেন, প্রধানত একটি সংগঠন টিকে থাকে তিনটি ভিত্তির উপর৷ জনশক্তি, সাংগঠনিক ভিত্তি ও অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি সংগঠন টিকে থাকার মূল ভিত্তি। এই অর্থ দিয়েই অস্ত্র ক্রয়, অস্ত্র প্রশিক্ষণ, জনবলের বেতন-ভাতা, সাংগঠনিক খরচ, কূটনীতিক, বাম রাজনৈতিক দল ও গণমাধ্যম খরচ বহন করেন এবং অবশিষ্ট টাকা প্রসিত, রবি, উজ্জ্বল স্মৃতি, সঞ্চয়, নতুন কুমারসহ শীর্ষ নেতাদের হাতে চলে যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউপিডিএফ কর্তৃক নির্যাতিত পাহাড়ি ও বাঙালিরা বলছেন, চাঁদাবাজি বন্ধ করাসহ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পাহাড়ে চিরনি অভিযান সময়ের দাবি।

আগের পোস্টমঙ্গলবার খুলছে সাজেক ও খাগড়াছড়ির পর্যটন কেন্দ্র।
পরের পোস্টআগামীকাল থেকে উন্মুক্ত হচ্ছে বান্দরবানের পর্যটক স্পট।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন