হান্নান সরকার, হিল নিউজ বিডি: পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) বা জেএসএস পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন। এটির রাজনৈতিক নিবন্ধন নেই। কিন্তু রাজনৈতিক কার্যক্রমের অন্তরালে সশস্ত্র কার্যক্রম পরিচালনা করে। পার্বত্য বিচ্ছিন্নতাবাদ আন্দোলনের রূপকার এই সংগঠন। এর সশস্ত্র শাখা পাহাড়ে সংঘাত, সহিংসতা তৈরি করেছে। এই প্রেক্ষাপট থেকে পাহাড়ের মানুষের কাছে সংগঠন ও তার প্রতিষ্ঠাতা মূর্তিমান আতঙ্ক।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশ সংবিধান প্রণেতার কাছে অসাংবিধানিক দাবিদাওয়া পেশ করেন। দাবিদাওয়া সমূহ একটি স্বাধীন সার্বভৌমত্ব, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে মেনে নেয়া কোনভাবেই সম্ভব ছিল না৷ সংগঠনটির এই ধৃষ্টতা প্রদর্শনের পেছনে ছিল গোপনে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জেএসএস প্রতিষ্ঠা। জেএসএস প্রতিষ্ঠা করেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তাকারী প্রতিবেশী দেশ অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের মধ্য হইতে উগ্র নেতৃত্বকে অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং কূটনীতিক সহযোগিতা প্রদান করার মাধ্যমে এ অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদ তৈরি করে। যে বিচ্ছিন্নতাবাদ পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির দাবানল সৃষ্টি করেছে।
প্রচলিত প্রবাদ আছে, গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালা। ৭১ সালে যুদ্ধে সহযোগিতাকারী বন্ধুপ্রতিম দেশ দেশের একটি পর্বত এলাকায় অশান্তির বীজবপন করে দিয়েছে।
প্রশ্ন আসতে পারে কে জেএসএস প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা? মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা কে সংক্ষেপে এম.এন লারমা বলা হয়। মঞ্জু বলেও তার একটি নাম আছে। তার পরিচিতিটা হল: ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন এম.এন লারমা। ১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১১টি উপজাতি জনগোষ্ঠীর স্বঘোষিত প্রতিনিধি হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেখ-এর কাছে মোট ৪ দফা দাবি পেশ করেন আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের লক্ষ্যে। বাংলাদেশের খসড়া সংবিধানের বিরোধিতা করেছিলেন, যা বাঙালি সংস্কৃতিকে তথাকথিত আধিক্য দিয়েছিল এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী অবাঙালি ক্ষু-নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি সম্প্রদায়কে স্বীকৃতি দেয়নি বলে জেএসএস দাবি করেন। জেএসএস এর দাবী তৎকালীন শেখ মুজিবুর রহমান দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এজন্যে ঐ বছরের ৩১-শে অক্টোবর এম.এন লারমা সংসদ ত্যাগ করেন সংবিধানে পাহাড়িদের বাঙালি বলার প্রতিবাদে। যদিও বঙ্গবন্ধু উপজাতীয়দের বাঙ্গালী বলেছে বলে কোথাও এধরণের অফিশিয়াল ডকুমেন্ট পাওয়া যায়নি এবং বাঙ্গালী বলার কারণে সংসদ ত্যাগ করার বিষয়টিও সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত নয়। প্রকৃত সত্য হলো সংসদ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে সুবিধা আদায়সহ এ অঞ্চলে অশান্তির বীজবপন করা। কথিত আছে লারমা উপজাতীয়দের অধিকারের জন্য লড়াই করছেন। কিন্তু চাকমা ব্যতিত অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অভিযোগ, এটাকে তারা সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছেন। চাকমাদের কিছু অংশ এম.এন লারমা কে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতীয়তাবাদের অবিসংবাদিত নেতা বা পিতা দাবি করলেও এই দাবির সৃষ্টি একমত নয়, মারমা, ত্রিপুরা, লুসাই, চাক, বম, খেয়াং, পাংখোয়া ও মুরংরা।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে খবর রাখে এমন ব্যক্তিদের দাবি- লারমা মূলত উপজাতিদের অধিকারের লড়াই চালিয়ে যান প্রতিবেশী দেশের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ইন্দনে এবং অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহযোগিতায়।
১৯৭৩ সালে নির্বাচনে লারমা আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের সংসদ প্রতিনিধি হিসেবে কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দেন ইংল্যান্ডে। ১৯৭৫ সালে বাকশালেও যোগদান করেছিলেন।
১৯৭৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধি ও কর্মীদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এর সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলে পরের দিনই আত্মগোপনে চলে যান এবং গড়ে তোলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেএসএস এর সামরিক শাখা তথাকথিত শান্তিবাহিনী। একই সাথে গড়ে তুলেছিলেন, মহিলা সমিতি, জুমিয়া সমিতি, যুব সমিতি ও গিরিসুর শিল্পী গোষ্ঠী। স্থানীয় অধিবাসীদের তথ্য মতে ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি গঠিত হয় শান্তিবাহিনী।
এম.এন লারমা মার্ক্সীয় আদর্শ ধারণ করেছিলেন তার আন্দোলনের জন্য। পরে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান দেশের অখণ্ডতার স্বার্থ বিবেচনায় ও পার্বত্য চট্টগ্রামের লাগাম টেনে ধরার অংশ হিসেবে সমতল থেকে নতুন বাঙালিদের খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পুনর্বাসিত করলে লারমার প্রতিষ্ঠিত জেএসএস এর সন্ত্রাসী তৎপরতা তীব্র হয়ে উঠে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে তাদের সংঘর্ষ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে।
স্থানীয় অধিবাসী নিয়ন চাকমা থেকে জানা গেছে- স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে লারমা ছিল এক মূর্তিমান আতঙ্ক। একসময় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার দলে সৃষ্টি হয় আন্তঃকোন্দল। চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগি এবং নেতৃত্বে ভাগাভাগি নিয়ে তাদের মধ্যে বিশাল বিরোধ তৈরি হয়। পক্ষ-বিপক্ষ দু’টি গ্রুপ সৃষ্টি হয়। ২টি গ্রুপ এম.এন রায় গ্রুপ ও প্রীতি গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়। ১৯৭৭ সালে এবং ১৯৮২ সালেও এম.এন লারমা জনসংহতি সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন।
কথিত আছে ১৯৮৩ সালের ১০ই নভেম্বর খাগড়াছড়ি পানছড়িতে এম.এন লারমা প্রীতি গ্রুপের দলের আক্রমণে ৮ জনসহ নিহত হন।
এম.এন লারমার মৃত্যুর পর নেতৃত্বে আসে তারই আপন ছোটভাই মানবজাতির রক্তপিপাসু এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালীদের উপর দফায় দফায় গণহত্যার নেতৃত্বদাতা কুখ্যাত খুনি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। ১৯৯৭ সালে সরকার ও জেএসএস সন্তু লারমার মধ্যকার সম্পাদিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। এর আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এর চেয়ারম্যান হন সন্তু লারমা। যা প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার।
এম.এন লারমার পারিবারিক পরিচয়:
তার বাবার নাম চিত্তকিশোর চাকমা, মাতার নাম ছিল সুভাষিণী দেওয়ান। তার সহধর্মিনীর নাম পঙ্কজিনী চাকমা, ছেলে জয়েস লারমা, মেয়ে পারমিতা লারমা। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা, ভাই শুভেন্দু প্রভাষ লারমা এবং উক্ত জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা সন্তু।
জেএসএস প্রতিষ্ঠা হওয়ার পূর্বে এম.এন লারমার কর্মজীবন:
কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬৬ সালে দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম রেলওয়ে কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বার এসোসিয়েশনে আইনজীবী কাজ শুরু করেন। তার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে জানা যায়- ১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মাওরাম (মহাপুরম) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, যা এখন কাপ্তাই বাঁধের কারণে কাপ্তাই হ্রদের তলে ডুবে রয়েছে।
তার জন্ম-মৃত্যু সম্পর্কে জানা যায়-
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (মঞ্জু)
১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ মহাপ্রুম গ্রাম, ইউনিয়ন: বুড়িঘাট, উপজেলা: নানিয়ারচর, জেলা: রাঙ্গামাটিতে জন্ম। অনেকের ধারণা প্রতিবেশী দেশে তার জন্ম হয়। যদিও এই ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই।
যেভাবে মূর্তিমান আতঙ্ক নিভে গেলো: ১০ নভেম্বর ১৯৮৩ (বয়স ৪৪) খেদারা ছড়ার থুম, উপজেলা: পানছড়ি, জেলা: খাগড়াছড়িতে আন্তকোন্দলে নিহত হন৷ লারমা মৃত্যুর পর জেএসএস সন্তু গ্রুপ একটিবারও লারমা হত্যার বিচার দাবি করেনি এবং ইউপিডিএফও লারমা হত্যা বিচার দাবি করেনি! ক্ষমতার লোভে এই হত্যার সাথে সন্তু জড়িত থাকার কথিত অভিযোগ আছে। অথচ এরাই পার্বত্য চট্টগ্রামে পান থেকে চুন খসলে বাঙালি ও সেনাবাহিনীর চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে। বেশিভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এম.এন লারমার চেতনা বিক্রি করে চলতে।
বিশ্লেষকদের দাবি:
এম.এন লারমা (মঞ্জু) যদি সেদিন প্রতিবেশী দেশের ইন্ধনে বাংলাদেশের অভ্যন্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেএসএস কিংবা তার সশস্ত্র শাখা তথাকথিত শান্তিবাহিনীর আত্মপ্রকাশ না করতেন, অত্রাঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ, হানাহানি ও জাতিগত ভেদাভেদ এবং ৩৮ হাজার নিরস্ত্র বাঙালিসহ হাজারো পাহাড়ি হত্যাকাণ্ডের শিকার হতেন না। লারমার মৃত্যুর পর তার ছোটভাই সন্তু লারমা সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করার অপপ্রয়াসে বেছে বেছেই বাঙালি আবাল-বৃদ্ধা-বনিতা এবং জেএসএস বিরোধীদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ড গুলো ছিলো ইতিহাসের নির্মম, জঘন্যতম ও বর্বরোচিত গণহত্যা।
বাঙালি জনগোষ্ঠীর অভিযোগ:
সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস, পাহাড়ে পূর্নবাসিত বাঙালি মা-বোনদের ইজ্জত হরণ করেছে৷ বাঙ্গালী যুবকদের গুলিবর্ষণের পর হাত-পা কেটে টুকরো টুকরো করেছে। বাঙালি শিশুদের গলা টিপে ও আছাড় মেরে হত্যা করেছে। বৃদ্ধ বাঙালিদের গলায় কাপড় পেঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে৷ বাঙ্গালীদের ঘরবাড়ি ও গৃহপালিত পশু পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করেছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে গণহত্যা পরিচালনা করেছে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস এর মলয় চাকমা ও রাজেশ চাকমাসহ অসংখ্য মানবাকৃতির দানব। ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যার অন্যতম হল পার্বত্য বাঙালি গণহত্যা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিদের উপর গণহত্যা পরিচালনা করার বেশকিছু কারণ ছিল। তার মধ্যে অপ্রকাশিত কিছু কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে যেসব তথ্য-উপাত্ত মিলেছে তার বিশ্লেষণ করে যা জানা যায় তার মধ্যে অন্যতম হলো-
১. পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড হইতে বিচ্ছিন্ন করে জুম্মল্যান্ড নামক রাষ্ট্র গঠন করা।
২. পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা।
৩. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রতিবেশী দেশের বীজ বপন করা এবং এর মাধ্যমে এদেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা।
৪. বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর যদি অদূরভবিষ্যতে প্রতিবেশী দেশের জন্য যেনো গলার কাঁটা না হয়, সেই লক্ষ্যেই এদেশে প্রতিবেশী দেশ একটি শক্তিশালী এজেন্ট তৈরি করেছে। এরজন্য দাবার গুটি হিসেবে এদেশের উপজাতি জনগোষ্ঠীর একটি উগ্রবাদী সমর্থক গোষ্ঠীকে বাছাই করেছে। যারা এম.এন লারমা গং।
৫. এম.এন লারমা, সন্তু লারমা তথা উপজাতি নেতৃত্বশ্রেণীর ধারণা ছিল, মুসলিম দেশ বাংলাদেশের সাথে উপজাতীয়রা থাকার ফলে একটা সময় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জাতিগত পরিচয় মুছে যাবে এবং তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়ে দেশান্তরিত হবে। তাদের এই ধারণা তৈরি হওয়ার অমূল্যক প্রধান কারণ ছিল- চাকমারা কোনকালেই পৃথিবীর কোনোদেশে স্থায়ী বসতিস্থাপন করেই দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারেনি একমাত্র তাদের স্বভাব সুলভ আচরণে কারণেই। উল্লেখ যে, চাকমাদের অতীত ইতিহাস জঘন্য। চাকমা নেতৃত্ব ভেবেছিল হয়তো মুসলিম দেশ অদূরভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রামে আগ্রাসন চালাবে। এর মাধ্যমে অত্রাঞ্চলে তাদের নেতৃত্ব ধ্বংস হবে, তাদের বিশ্বাসঘাতকতা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও চাঁদাবাজির গোমর ফাঁস হবে। অঘোষিত শাসনভার ও রাজপ্রথা চলে যাবে। তাই নিজেদের তাবেদারি টিকিয়ে রাখার জন্য দেশের সর্ব বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙালির প্রতি জুলুম, নির্যাতন ও অন্যায়- অবিচার তাদের বিবেকে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি।
৬. পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠীর প্রবীণ ব্যক্তি ও সচেতন সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাঙালি মুসলমানদের প্রতি গণহত্যা পরিচালনা করতে লারমা ও তার ভাই সন্তুকে উদ্বুদ্ধ করেছে উগ্র চিন্তাধারা এবং অন্য জাতি ধর্মের প্রতি তাদের ঘৃণা ও আক্রোশ। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল বৌদ্ধ ধর্ম এবং ত্রিপুরা হিন্দু ধর্ম। অন্যান্য ধর্মের লোক ছিল অতি নগণ্য। অত্রাঞ্চলের জাতিরা সম্পূর্ণভাবেই মুসলিম ধর্ম ও বাঙালি জাতি থেকে আলাদা। লারমা গংদের ধারণা ছিল এই মুসলিমরা যদি পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমণ করে তাহলে এখানে সরকারের আধিপত্য বৃদ্ধি পাবে। এরই মাধ্যমে তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা, দেশদ্রোহিতা মূলক কর্মকান্ড, চাঁদাবাজি, রাজপ্রথা বিলুপ্ত ও পরিবার কেন্দ্রীক নেতৃত্বের অবসান হবে। তাই তারা ভারতের ইন্ধনে অস্ত্রহাতে নিয়ে সশস্ত্র শাখা প্রতিষ্ঠা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিদের উপর নৃশংস গণহত্যা পরিচালনা করতে সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ হয়েছিল।
১৯৮২ সাল থেকে ৯৭ সালের পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত দফায় দফায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও সংকট নিরসনে সরকার ও জেএসএস মধ্যকার বৈঠক ও আলোচনা হয়। কিন্তু এত আলোচনা বৈঠক হওয়ার পরও তার আলোর রূপ দেখা যায়নি। তড়িঘড়ি করে ১৯৯৭ সালের ২- রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও জেএসএস সন্তু সঙ্গে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ নামক একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির মধ্যে ৭২টি ধারা রয়েছে; ধারাগুলো প্রায় উপজাতীয়দের অধিকার বিষয়ক; এই ধারাগুলো বাংলাদেশ সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক; পার্বত্য চুক্তিকে এ অঞ্চলের বাঙালিরা কালো চুক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল; এই চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি জনগোষ্ঠীর অধিকার খর্ব করা হয়েছে এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।তারপরও সরকার যেহেতু চুক্তি করেছে সেহেতু এই চুক্তিকে অনিচ্ছার সত্বেও বাঙালিরা মেনে নিতে বাধ্য হয়। অতি দুঃখের বিষয় এই চুক্তি শান্তির সুবাতাস এবং সুফল বয়ে আনেনি। চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৭০টি ধারা জেএসএস সন্তুর পক্ষে মাত্র ২টি ধারায় সরকার জেএসএসকে বেধে দিয়েছে সম্পূর্ণ অবৈধ অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য। পরিতাপের বিষয় জেএসএস সন্তু পূর্বের ন্যায় অস্ত্রবাজি, মানুষ হত্যা, খুন-গুম এবং চাঁদাবাজি করার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত করেছে। চুক্তি বিরোধী কর্মকাণ্ডের ফলে পার্বত্য চুক্তি বৈধতা হারিয়েছে। বিস্ময়কর হচ্ছে, সরকার চুক্তি লঙ্ঘনে অভিযুক্ত করেনি জেএসএস এর বিরুদ্ধে। জেএসস তার নিজস্ব গতিতে ছিল। চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জেএসএস ভেঙে দল-উপদল সৃষ্টি হয়।
দলগুলো হল:
১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর তৎকালীন সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস এর ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি প্রসিত বিকাশ খিসার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন দাবি রেখেই ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই ইউপিডিএফ পার্বত্য চুক্তি তথা জেএসএস বিরোধী।
জেএসএস সংস্কার এম.এন লারমা। যারা জেএসএস মূল নেতা সন্তু লারমার স্বেচ্ছাচারিতার বিরোধিতা করে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক বর্মা, যারা ইউপিডিএফ প্রসিত মূলের দুর্নীতি, অন্যায় ও বিভিন্ন অপকর্মের প্রতিবাদ করার কারণে দলচ্যুত হন। পরবর্তীতে তারা ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক গঠন করেন।
মগ লিবারেশন পার্টি সংক্ষেপে এমএলপি যারা, চাকমা নেতৃত্বের আধিপত্য ও জেএসএস এর বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ নাথান) কুকি জাতির কথিত অধিকারের কর্ণধার হিসেবে এবং চাকমা তথা জেএসএস এর আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ জেএসএস, ইউপিডিএফ ও অন্যান্য আঞ্চলিক সংগঠনের যাঁতাকলে পিষ্ট। জেএসএস ও ইউপিডিএফ থেকে উপরোক্ত দল-উপদল সৃষ্টি হয়েছে। এসব সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো সকলে নামে আলাদা আলাদা হলেও নীতিগতভাবে তারা অভিন্ন।
এখানে উল্লেখ যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি পূর্নবাসিত করার পূর্বে ১৯৭৫ সালে খিরাম বন কার্যালয়ে জেএসএস এর সশস্ত্র শাখা হামলা করে ৫ জন বনকর্মীকে হত্যা করে এবং ১৯৭৭ সালে বান্দরবান সাঙ্গু নদীতে টহলরত সেনাসদস্য কাদের গংদের উপর অর্তকিতভাবে গুলি করে ৩ জনকে হত্যা করে। এই থেকে স্পষ্ট যে পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু বাঙালি পূর্ণবাসন কেন্দ্র করে এই হামলা ও সশস্ত্র যুদ্ধ নয়। তাদের হামলা ও সশস্ত্র যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিলো, প্রতিবেশী দেশের ইন্ধন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশ মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাষ্ট্র গঠন। প্রতিবেশী দেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছে তা নিঃসন্দেহে অবিস্মরণীয় এবং তারজন্যেই তাদের এই অবদান আমরা স্বাধীনতার দীর্ঘ বছর পরও স্বীকার করে আসছি। কিন্তু অপ্রিয় হলেও অন্তরালে থাকা প্রকৃত বাস্তব সত্যটি দেশ ও জাতির কাছে একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে উন্মোচন করা সময়ের শ্রেষ্ঠ দাবি। প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশেকে যুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করলেও স্বাধীনতার যুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশের মানুষগুলোর ক্ষতবিক্ষত দেহ শুকানোর আগেই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মাধ্যমে ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশ সংবিধান প্রণেতার কাছে অসাংবিধানিক দাবিদাওয়া পেশ করেন এবং তা মেনে না নেওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসবাদ তৈরি করেন। যার পরিণতি ভোগ করছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মানুষ। কুখ্যাত এম.এন লারমা পাহাড়ের মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় একজন অমানবিক মানুষ হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকবে।