না পারিলাম বাঁচতে আমি না পারিলাম পাহাড় ছাড়তে: ক্যাহ্লা সিং মারমা।

আমাদের দেশের সভ্য, প্রগতিশীল চিন্তার মানুষরা মনে করে পাহাড়ি সমাজ ব্যবস্থা খুবই সুন্দর!

0

আমি ক্যাহ্লা সিং মারমা ছদ্মনাম খাগড়াছড়ি জেলার পর্বত অরণ্য ঘেরা এলাকায় আমার জন্ম। বলতে পারেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। একজন পাহাড়ি হিসেবে সবসময় অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক-বাহক ছিলাম। যেহেতু পাহাড়ি তাই চাষাবাদ, পশুপালন, বৃক্ষরোপণ করে জীবিকা নির্বাহ করাটাই আমাদের জীবন। আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বিলাসিতা আমাকে কখনই সংজ্ঞায়িত করেনি। জীবন ছিল খুবই সাদাসিধে এবং নৈতিকতায় পূর্ণ। যেভাবে আমাদের পরিবার পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস সন্তু) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ প্রসিত) গ্রুপ দ্বারা ভয়ঙ্কর থাপার শিকার।

আমার বাবা সত্তরের দশকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ছিলেন এমনটাই বললেন বাবা। কিন্তু বাবা সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছেন এমন কোনো প্রমাণ কখনো পাওয়া যায়নি। বাবার কাছে শুনেছি সেনাবাহিনীতে চাকরির সুবাদে ছুটিতে এসে জেএসএস সন্তুর সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনী নির্মমভাবে মারধর করে। তাকে তীব্রভাবে প্রহার করে, সবাই বলেছিল বাবা হয়তো আর বাঁচবেন না। কিন্তু ১৯ মাস বাড়িতে বিছানায় কাটিয়ে সুস্থ হয়ে উঠলেন। পরে বাবা আর চাকরিতে ফিরে যাননি। বাবার হাতে লেখা কিছু চিরকুট এখনও বাড়িতে সংরক্ষিত আছে। লেখার স্বরলিপি, রেখে যাওয়া স্মৃতি স্পর্শ করলে আমার চোখে জল আসে। বাবা আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই। ২০১৫ সালে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন (আজ প্রায় ১০ বছর, বাবা স্বর্গবাসী)। আমার মিষ্টিভাষী বাবার সঙ্গে ৩০ বছর পর্যন্ত জীবন কাটিয়েছি কখনো আমাদের ৭ ভাই-বোনকে বকাঝকা করেনি। শান্তিবাহিনী নামক নরপশুরা প্রিয় বাবাকে নির্মমভাবে পিটিয়েছিল, বাবা এই আঘাতে মর্মাহত ছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। বাবা সমাজে লোকচক্ষুর আড়ালে নীরবে অঝোর ধারায় কাঁদতেন। বাবার এই কান্নায় সংসারে মা, ভাই-বোন সবাই অসুখী ছিল৷ অর্থ কষ্ট আমাদের যতটাই না পীড়িত করেছে তার চেয়ে বেশি বাবার চোখের জল আমাদের পীড়িত করেছে৷ আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় আমি স্ব-ধর্মীয় শান্তিবাহিনীকে ঘৃণা করেছি, এরাই আমার বাবাকে নারকীয়ভাবে নির্যাতন করেছিল।
তবে চুক্তির পর শান্তিবাহিনী আমাদের এলাকায় তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়। শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে জন্ম হয়েছে আরেক অশান্তি ইউপিডিএফ প্রসিত।
এই দুই সংগঠনের দাবি, উদ্দেশ্য ও আদর্শ ভিন্ন হলেও অপ্রিয় সত্য হলো, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, অপহরণ-খুন, নির্যাতন, ধর্ষণ ও জমি দখল এবং ক্ষমতা প্রভাবের ক্ষেত্রেই তারা একই গোয়ালের গরুর ন্যায়। সমাজে অন্যায় ও অবিচার প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৯৮ সাল থেকে এই এলাকায় শান্তিবাহিনী নামক অশান্তির প্রভাবের সমাপ্তি ঘটে। এলাকায় নতুন সংগঠন চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ এর আনাগোনা। এলাকাবাসী বলছেন, এই বুঝি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। আগে চাঁদা দিতাম ১ দলকে এখন চাঁদা দিতে হবে ২ দলকে! আঞ্চলিক দলগুলো কি আদৌ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করে? নাকি জাতির তথাকথিত অধিকারের নামে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে নিজেদের জন্য চাঁদা সংগ্রহে করে ? এরা তো প্রায়শ্চই মানুষ নির্যাতন ও হত্যা করে! এই কথাগুলো সাধারণ মানুষের মুখে ছিল। ইউপিডিএফ গঠনের প্রায় দেড় যুগ সময়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বাবা নামক বটগাছটি। আমাকে আমার বাবার মতো ভাগ্যবরণ করতে হবে, আমার মা তার দুঃস্বপ্ন আমাকে বলতেন। মা বলেন, আমার বাবার সাথে যে অবিচার করা হয়েছিল আমার সাথেও সেই অবিচার হবে। একদিন মা বলেন, বাবা এই পাহাড় ছাড়া আমাদের আর কোথাও পথ খোলা নেই, না হলে আমি তোমাদেরকে সাথে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতাম। মায়ের মত ভাই ও বোনেরা আমাকে নিয়ে সবসময় ভয়ে থাকতেন।

একটা কথা বলি, বাঙালি সমাজব্যবস্থার মতো পাহাড়ি সমাজেও যারা ক্ষমতাবান, অর্থের মালিক তাদেরই সমাজে প্রভাব বেশি। আমাদের অর্থের প্রাচুর্য ছিল না যার কারণে সমাজের চোখে আমরা সবসময়ই ভিন্ন ছিলাম। জীবনের নিয়ম অনুযায়ী স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান বড় দুই ভাই। চার বোনের মধ্যে তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। বাড়িতে শুধু ছোট বোন আছে তাকে লেখাপড়া করার দায়িত্ব আমার কাঁধে। কিন্তু কর্তব্যের কাছে পরাজিত হয়ে নবম শ্রেণিতে বোনের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। বোনের জীবনে আরেকটি বাধা ছিল। যাই হোক আমার বোনকে বিয়ে দিয়ে দিই । আর এদিকে আমার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসারে অভাব-অনটন চলছেই। আসলে পাহাড়ি সমাজ সবসময় শোষিতের বিরুদ্ধে থাকে, তা ভুক্তভোগী ছাড়া উপলব্ধি করা অসম্ভব। আমাদের দেশের সভ্য, প্রগতিশীল চিন্তার মানুষরা মনে করে পাহাড়ি সমাজ ব্যবস্থা খুবই সুন্দর। কিন্তু বাইরে থেকে যতটা সুন্দর, ভিতরে ততটাই কুৎসিত।

আমি একটি রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছি। একটি ছোট পদবি গ্রহণ করি। আমি কখনই টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি বা অন্যের ক্ষতি করার মানসিকতায় ছিলাম না। একজন কর্মজীবী ​​মানুষ হিসেবে আমি আমার ছুটির সময়ে দলীয় কর্মসূচিতে যেতাম। তার পরেও কেন স্বজাতি সন্ত্রাসীদের রোষানলে?

কে পাহাড়ি আর কে বাঙালি এটা আমার কাছে কখনোই বিবেচ্য নয়। এমনকি জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়ও বড় ছিল না। আমার কাছে মানুষ হিসেবে পরিচয়টাই ছিল সবার আগে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক-বাহক হিসেবে পাহাড়ি ও বাঙালির উত্থান-পতনে সব সময় এগিয়ে আসার চেষ্টা করেছি। প্রশাসন কাজে সহযোগিতা চাইলে আমি রাস্ট্র ও স্বজাতি স্বার্থ বিবেচনা করে সাধ্যমত সাহায্য করেছি। আমার পাহাড়ি বন্ধুদের চেয়ে বাঙ্গালী বন্ধু বেশি ছিল। এটাকে আমাদের পাহাড়ি সম্প্রদায়ের লোকেরা ভিন্নভাবে দেখত। আমাদের গ্রামের প্রভাবশালী পরিবার রাজনীতিতে আমার প্রবেশ এবং বাঙালিদের সঙ্গে মেলামেশাকে ভিন্নভাবে দেখেছিল। তারা সব সময় পাহাড়িদের আমার বিরুদ্ধে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমাকে সামাজিকভাবে হেয়-প্রতিপন্ন করেছে। সাম্প্রদায়িক, উগ্র মানসিকতা থেকে আমার সাথে এসব করা হয়েছে। পাহাড়ে সাম্প্রদায়িকতার বীজ কিন্তু প্রভাবশালী এবং পাহাড়ি আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী দল করেছে। তারাই পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে বিদ্বেষ, বিভেদ সৃষ্টি করেছে। এই ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি করে দিনশেষে কারা লাভবান হচ্ছে তা অনুধাবন করার সময় হয়তো এখনো আসেনি।
শত্রুপক্ষের এমন কোন প্রতিবান্ধকতা বাদ ছিলনা যা তারা আমার বিরুদ্ধে করেনি! অবশেষে ইউপিডিএফ আমার প্রতি প্রকাশ্যে শত্রুতা শুরু করে। ইউপিডিএফ তাদের বেশি অগ্রাধিকার দেয় যারা সমাজে নেতৃত্ব দেয় বা প্রভাব রাখে। পাহাড়ের পাশাপাশি সমতলেও এর ব্যতিক্রম নয় তারা এলাকার প্রভাবশালী পরিবারগুলো যা বলে তা বিশ্বাস করে। আমাকে থ্রেড বেশ কয়েক বছর ধরে দিচ্ছে। এতে স্পষ্ট যে আমি ইউপিডিএফ এর জন্য বর্তমান একটি টার্গেট।
আমাকে ক্ষতি করা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তারা আমার সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে। আমার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ হলো: (১) আমি প্রশাসনকে সহযোগিতা করি, (২) বাঙালিদের সঙ্গে মেলামেশা করি, (৩) সবসময় এলাকার বাইরে থাকি।
আমি এসব অভিযোগ ক্রস চেক করতে বললে ইউপিডিএফ হুমকির সুরে কথা বলে। আমাকে ইউপিডিএফে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। এক সময় ইউপিডিএফ আমার স্ত্রী ও কন্যাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে সবসময় চিন্তিত থাকি। মেয়েকে ধর্ষণের হুমকি দেয়। জাতির অধিকার আদায়ের গ্রুপ বা সংগঠনের নীতি কী এটাই হওয়ার কথা?
আমি তখন পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ রাখতে পাহাড় থেকে দূরে কোথাও যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু কিন্তু পরিস্থিতির কারণে আমি না পারিলাম বাঁচতে আমি না পারিলাম পাহাড় ছাড়তে! দুঃখজনক ছিল, আমার পুরো পরিবারকে ধ্বংস করতে এলাকার প্রভাবশালী পরিবারও জড়িত। ইউপিডিএফ প্রভাবশালীদের আমার পিছনে নিয়োজিত করে। অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করি। আমি কোথাও গিয়ে শান্তি পাচ্ছি না। কিছুদিন পর পর আমার বাড়ির আঙ্গিনায় ইউপিডিএফ এর সশস্ত্র টহল গমন করে। যা ভয়ভীতি দেখানোর অভিপ্রায়ে।

আমি যেখানে যাই ইউপিডিএফ ফোন করে লোকেশন জানতে চায়। কেন গিয়েছি এসব জানতে চায়! মোদ্দা কথা হচ্ছে, আমার সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে অচল অবস্থা তৈরি করে দিতে যা যা কিছুর প্রয়োজন ছিল তার সবই তারা করেছে। অনেক শর্ত জুড়ে দেয় আমার জীবনে। একবার রাজনীতি ছাড়ার জন্য চাপ দিলেও আমার আন্দোলন চলতে থাকে। ঘরবন্দী করে রাখে আমাকে। আমাকে জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করতে তাদের গণঁচাদা কালেকশন করে দিতে দ্বায়িত্ব প্রদান করে। আমি কৌশলে নিজে বাড়তি টাকা চাঁদা দিয়ে এই থেকে বারবার বাঁচার চেষ্টা করি। কিন্তু আমি প্রতিবারই ফেঁসে যাই। কারণ, আমার প্রতিপক্ষ অনেক শক্তিশালী। যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী, জাতির অধিকারের কথা বলে অসহায় পাহাড়িদের শাসন-শোষণ করে। যেখানে রাস্ট্র প্রশাসন তাদেরকে দমনে ব্যর্থ, সেখানে আমি তাদের বিরুদ্ধে কিছু করা নিতান্তই বোকামি। অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক-বাহক হতে গিয়ে ভয়ঙ্কর ভাবেই ফেঁসে গেছি। জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছি।

এখানেই শেষ নয়, ইউপিডিএফ আমাকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে দু’দিন ধরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে। ভয়ঙ্কর নির্যাতন করে৷ যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এসব ভাবলে মনে হচ্ছে প্রাণটা শরীর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে! কি সেই ভয়ঙ্কর মূহুর্ত, কি অসহ্য নির্যাতন, কি অমানবিকতা! আমার তিনটি মেয়ে আছে তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা, ভরণপোষণ করাতে প্রতিনিয়ত আমাকে যুদ্ধ করতে হয়। আমার চলাফেরা যেখানে সীমিত সেখান থেকে তাদের দাবিকৃত মুক্তিপণ দেওয়া এবং তাদের থেকে বেছে ফিরে আসা ছিল হয়তো কোন জনমে ভালো কাজের ফল। বর্তমানে ঘরবন্দী জীবন। যে কোন সময় ভয়ঙ্কর বিপদ অপেক্ষমান।

এই পাহাড় ভালো না। এই পাহাড় আজ সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য। এখানে অস্ত্রের শক্তি এবং ক্ষমতার প্রভাব প্রদর্শিত হয়। পর্বতারোহী হওয়া সত্ত্বেও আমি উপজাতি তথা ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের দ্বারা ভয়ানক আক্রমণের শিকার। আমার মতো অনেকেই আছেন, যারা অস্ত্রের ভয়ে কথা বলেন না। আমি চাই পাহাড়ের সবাই সম্মিলিতভাবে চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসের অস্ত্রের বিরুদ্ধে জেগে উঠুক। পাহাড়ের সন্ত্রাসীরা নিপাত যাক।

লেখক সম্পর্কে:
ক্যাহ্লা সিং মারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসবাদের শিকার একজন প্রতিবাদী মারমা সম্প্রদায়ভুক্ত পাহাড়ি যুবক। তিনি হিল নিউজ বিডি ডটকম-এ তার বাস্তব জীবনের ঘটনার একটি লেখা পাঠান। হিল নিউজ বিডি ডটকম তার জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর ঘটনার অভিজ্ঞতা নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে প্রকাশিত করেছে। তা সম্মানিত পাঠকমণ্ডলীর জ্ঞাতার্থে তা হুবহু উপস্থাপন করা হয়েছে।

আগের পোস্টজেলা প‌রিষদ ও আদালতে বিত‌র্কিত ব্য‌ক্তি‌দের অপসারন চায় বৈষম্য‌বিরোধী ছাত্র সংগঠন।
পরের পোস্টপাহাড়ে শান্তি ফেরানোর চ্যালেঞ্জ: ড. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন