নিজস্ব প্রতিনিধি হিল নিউজ বিডি: সড়ক উন্নয়নের উপরই নির্ভর করেন এলাকার সার্বিক উন্নয়ন। আর পাহাড়ে এলাকার সার্বিক উন্নয়নে কাজে গত কয়েক দশক ধরে বাধাপ্রাপ্ত করে আসছে পাহাড়ের আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী দল। পাহাড়ে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হলে এখানকার উপজাতি জনগোষ্ঠীর মানুষদের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে পরিবেশগত সুযোগে একটি জাতি শিক্ষিত হবে, তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, কৃষি ফসল ও পাহাড়ে উৎপাদিত ফলমূল বাজারজাত করে নিজেদের ভাগ্যের চাকা সচল করতে নিয়োজিত করবে। তখন সে জাতির একটি অংশ আর সন্ত্রাসবাদ বা চাঁদাবাজিতে পা বাড়াবে না। তাই আঞ্চলিক সংগঠনগুলো পাহাড়ে সন্ত্রাসবাদ ও চাঁদাবাজি টিকিয়ে রাখতে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের পথে বরাবরই বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনো উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে ভূমি দখলের অভিযোগ তুলেছে, কখনো নিজেরা বাস্তুহারা হওয়ার অভিযোগ তুলেছে, আবার কখনো প্রকৃতি ধ্বংসের অজুহাত, কখনোই বা মোটা অংকের চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন পথেই বাঁধা সৃষ্টি করেছে। পাহাড়ে এভাবেই সময় সময়ে সড়ক উন্নয়ন, স্কুল, কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল স্থাপনের বিরোধিতা ছিল এসবের দোহাই। বাস্তবিক অর্থেই চাঁদা আদায় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে বাঁধা প্রদানের শামিল।
হ্যাঁ, এই পাহাড়ে সবই সম্ভব! মাত্র এক কিলোমিটার সড়ক কাজে ইউপিডিএফ দেড় লক্ষ টাকা আদায় করেছে বাকী আরো তিনটি আঞ্চলিক দল আছে! তাদেরকে তাদের চাঁদা দিলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার সড়ক কাজ মানসম্মত করা কী সম্ভব? পাহাড়ে এভাবেই চলছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফ প্রসিত দলের চাঁদাবাজি।
রাঙামাটি বাঘাইছড়ি উপজেলার পর্যটন খ্যাত সাজেকে একটি সড়ক কাজে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার থেকে মাত্র এক কিলোমিটার সড়ক কাজের ক্ষেত্রেই চাঁদা হিসেবে দেড় লক্ষ টাকা আদায় করেছে। এমনই একটি চাঁদার টোকেন স্থানীয় উপজাতি জনগোষ্ঠীর মানুষেরা প্রতিবাদ স্বরূপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্যাপশন দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
জনতার মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে আসুন, টোকেন নং ৪৪১৬২৫, নাম USA আমিন চম্পক, সাজেক ২৩ হইতে ২৪/১ কিলো রাস্তা, ১৫.০০০০/- টাকা লিখিত একটি চাঁদাবাজির টোকন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুলেছে। টোকেনটি ইউপিডিএফ এর বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে কথা। তবে এটি কবে কখন কার ঘটনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পাহাড়ে খোঁজ নিলে এরকম আরো কয়েক হাজার বা লাখ চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যাবে। এই চাঁদাবাজির শিকার পাহাড়ের প্রতিটি পরিবার। উপজাতি-বাঙালি কিংবা সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবি কেউ চাঁদার আওতার বাহিরে নয়। সবাই ভুক্তভোগী৷ পার্বত্য নতজানু নীতি আর অবৈধ অস্ত্রের ভয়ে তা কেউ প্রকাশ্যে বলতে চায়না। চাঁদা দেয়া বা নেওয়া যেকোনো একটি বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে পাহাড়ে দিনদুপুর মানুষ হত্যা, অপহরণ নিত্যদিনের ঘটনা। আর এসবের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই নিজেকে শেষ করে দেয়া।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাজেকের এক বাসিন্দা জানান, একজন ঠিকাদার যখন একটি টেন্ডার লাভ করেন, তখন তাকে সংশ্লিষ্ট টেন্ডার আহ্বান করা প্রতিষ্ঠানকে অর্থ দিয়ে ম্যানেজ করতে হয়, এরপর আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ, বিভিন্ন মহল, কাজ পরিদর্শন করা ব্যক্তি এবং ৪/৫ টি আঞ্চলিক দলকে চাঁদা দিতে হয়। অনেক সময় দেখা যায় ঠিকাদার সরাসরি কাজ করেন না। ১০ পারসেন্ট হিসাব করে বিক্রি করে দেন। কাজটি শেষ পর্যন্ত তৃতীয় পক্ষ পর্যন্ত গড়ায়। তখন আর কাজের গুনগত মান থাকে না। তা হয় অনেক নিম্নমানের। বেশিভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নামমাত্র কাজ করা হয়। যা দিয়ে পাহাড়ের উন্নয়ন সাধিত করা সম্ভব নয়।
বান্দরবান রোয়াংছড়ি পাইচিমং মারমা নামে এক বাসিন্দা জানান, পাহাড়ে চাঁদাবাজি এখন ওপেন সিক্রেট। চাঁদাবাজ বা চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক এতটাই জালের মত বিস্তার করেছে এখানে সবকিছুই চাঁদার আওতায়। চাঁদাবাজদের ফাঁকি দিয়ে এখানে কিছুই করা সম্ভব নয়। চাঁদাবাজির আওতায় ছাগল, গরু, হাঁসমুরগি, ফলমূল ও কাঠ, বাঁশ, বাগান সৃজন, জমি-ক্রয় বিক্রি, গৃহনির্মাণ, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং যানবাহন ইত্যাদি।
খাগড়াছড়ি দীঘিনালার বাসিন্দা নিশান চাকমা জানান, পাহাড়ে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য এখন অনেক বেশি। চাঁদা ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করা অসম্ভব। এই চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তার, খুন-খারাবিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনা সংঘটিত হয়। পার্বত্য চুক্তির পরও প্রায় এক হাজার হত্যাকাণ্ড ও দুই হাজার অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এখানে অনেক ঘটনা অপ্রকাশিত।
পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের পথে এভাবে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের অন্তত আধা ডজন আঞ্চলিক দল। যারা উপজাতি জাতিসত্তা মানুষদের অধিকারের কথা বলে নিয়মিত চাঁদা সংগ্রহ করে নিজের ভাগ্যের চাকা সচল করলেও পক্ষান্তরে দিনশেষে ভাগ্য পরিবর্তন হচ্ছে না জনগোষ্ঠীগুলোর। তারা শুধু চাঁদা দিয়েই যাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৬টি উপজেলায় সরেজমিনে ঘুরে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ভয়ঙ্কর চাঁদাবাজির তথ্য। এখানেই সবকিছু চলে চাঁদাবাজি কে ঘিরে। উপজাতি সংগঠন সহানুভূতি অর্জন করে মূলত উপজাতিদের অধিকারের দোহাই দিয়ে। সহজসরল উপজাতিদের সন্ত্রাসীরা মুখরোচক গল্পকাহিনী করে সমর্থন আদায় করে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভেঙে আলাদা জুমল্যাণ্ড নামক রাস্ট্র গঠন করার স্বপ্ন দেখিয়ে বছরের পর বছর ধরে শাসন-শোষণ করে আসছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল উপজাতি জাতিসত্তার মানুষদের বুঝতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে তাদের সব অধিকার ২৬ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য তিন জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডসহ চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছে জেএসএস সন্তু, ইউপিডিএফ প্রসতি তথা সর্বক্ষেত্রেই আধিপত্য বিস্তারকারী চাকমা নেতাদের কারণেই। বস্তুতঃ এখন অধিকার প্রশ্নে যা হচ্ছে তা চাঁদাবাজি।