পার্বত্য জেলা পরিষদে সাম্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উন্নয়ন ঘটানোর এখনি সময়।

0

পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের একটি বিশেষ অঞ্চল, যেখানে বাঙালি ও উপজাতি জনগোষ্ঠীর সহাবস্থান বহু পুরোনো। এই অঞ্চলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সকল জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সাংবিধানিক অধিকার এবং সামাজিক সম্প্রীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অতীতের মতো বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পরিষদগুলো একপেশে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপজাতি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার উন্নয়নে সীমাবদ্ধ।

একপেশে উন্নয়ন: বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে অতিরিক্ত বরাদ্দ, জেলা পরিষদগুলো প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাজেট উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করে। কিন্তু এই উন্নয়নের সিংহভাগই উপজাতি জনগোষ্ঠীর বৌদ্ধ বিহার এবং সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় অবকাঠামোর উন্নয়নে ব্যয় হয়। উদাহরণস্বরূপ, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান জেলার বিভিন্ন উপজেলায় দেখা যায়, নতুন নতুন বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ, পুরোনো বিহার সংস্কার এবং সেগুলোতে সংযোগকারী রাস্তা বা ড্রেন নির্মাণই অধিকাংশ বরাদ্দের আওতায় আসে।
অন্যদিকে, এই অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালি সম্প্রদায় ও অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত। মসজিদ, মন্দির কিংবা গির্জার মতো ধর্মীয় স্থাপনাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়ে গেছে।

ধর্মীয় বৈচিত্র্যের প্রতি উপেক্ষা: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে আঘাত। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত সৌন্দর্য তার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে। এখানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি মুসলিম, হিন্দু এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাও বসবাস করেন। কিন্তু উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে যখন একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাত দেখা যায়, তখন তা অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়।
বৌদ্ধ বিহারগুলো যেখানে অত্যন্ত আধুনিক ও উন্নতমানের, সেখানে মসজিদ, মন্দির বা গির্জার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় অবহেলিত। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর এই অসম উন্নয়ন স্থানীয় জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশকে নষ্ট করছে।

অতীতের ধারা অব্যাহত থাকলে সম্ভাব্য বিপদ
যদি জেলা পরিষদ অতীতের মতো শুধুমাত্র উপজাতি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে একচেটিয়া বরাদ্দ অব্যাহত রাখে, তবে তা দীর্ঘমেয়াদে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে এর মাধ্যমে:

বাঙালিদের মধ্যে বঞ্চনার অনুভূতি: উন্নয়ন প্রকল্পে বারবার উপেক্ষিত হওয়ায় বাঙালি জনগোষ্ঠী নিজেদের পরিত্যক্ত মনে করছে।

সাম্প্রদায়িক বিভাজন: উন্নয়নের বৈষম্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে আরও দূরত্ব সৃষ্টি করছে।

ধর্মীয় উত্তেজনা: একপেশে উন্নয়ন ধর্মীয় উত্তেজনা বাড়াতে পারে, যা সামগ্রিকভাবে দেশের স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলবে।

ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন
পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পরিষদগুলোকে অবশ্যই তাদের উন্নয়ন বরাদ্দের ক্ষেত্রে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ন্যায্য নীতি অনুসরণ করতে হবে। নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে:

জনসংখ্যার ভিত্তিতে উন্নয়ন বরাদ্দ: যে কোনো প্রকল্প পরিকল্পনা ও বরাদ্দের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার অনুপাত এবং তাদের চাহিদা বিবেচনায় রাখতে হবে।

সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন: বৌদ্ধ বিহার ছাড়াও মসজিদ, মন্দির, গির্জা এবং অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে।

সবার মতামত গ্রহণ: উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়নের আগে পাহাড়ি ও বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের মতামত সংগ্রহ করা উচিত।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: জেলা পরিষদে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে সমাধান
১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও ১৯৮৯ সালের জেলা পরিষদ আইনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে সুষম উন্নয়ন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবিক প্রয়োগে তার বিচ্যুতি লক্ষ করা যাচ্ছে।চুক্তির মুলনীতিগুলো অনুসরণ করে যদি উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, তবে সাম্প্রদায়িক বিভেদ কমে আসবে এবং শান্তি বজায় থাকবে।

উপসংহার
পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা তার বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। এই বৈচিত্র্য বজায় রাখতে জেলা পরিষদগুলোর উন্নয়ন কার্যক্রমে সাম্য এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত করা জরুরি। শুধুমাত্র একটি সম্প্রদায়ের জন্য উন্নয়ন বরাদ্দ করা মানে অন্য সম্প্রদায়কে বঞ্চিত করা। জেলা পরিষদগুলোর উচিত অতীতের ভুল শুধরে নিয়ে সকল সম্প্রদায়ের জন্য ন্যায্য উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা। এটি শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য নয়, বরং গোটা দেশের জন্য শান্তি ও অগ্রগতির পথ সুগম করবে।

লেখক: অপূর্ব সাচিং, পার্বত্য চট্টগ্রাম। ১৬/১১/২০২৪

আগের পোস্টস্বচ্ছ ও নিরপেক্ষতার জন্য উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে হস্তান্তর করা জরুরী।
পরের পোস্টরুমা সেনা জোন কর্তৃক স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন