পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির প্রেক্ষাপট এবং ভবিষ্যৎ স্থবিরতা।

0

এমকে আনোয়ার, হিল নিউজ বিডি: স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন করে দানা বাঁধে কাউন্টার ইনসাল্টেন্সি তথা আঞ্চলিক সহিংসতা।পাহাড়ে দীর্ঘ দুই দশক ধরে চলমান সংঘাত-সহিংসতা ও যুদ্ধে প্রচুর পরিমাণ প্রাণহানির ঘটে উপজাতি-বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের। বিপর্যস্ত পাহাড়ের পরিস্থিতি পরিবেশ ব্যাপক অশান্ত হয়, সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি, বারুদের গন্ধে বাতাস ভারী হয়। সারিবদ্ধ লাশ ও রক্তের হোলি খেলা এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৎকালীন এখানকার মানবতা বিপর্যয় ডেকে আনে।

খাগড়াছড়িতে যখন তথাকথিত শান্তিবাহিনীর সদস্যরা পুরাতন ভাঙা, মরিচাধরা অস্ত্র দেয়, তখন বাঙালিদের বুকফাটা আর্তনাদ পাহাড়ের আকাশ বাতাস ভারী হয়েছিলো।
পার্বত্য বাঙালি সম্প্রদায় মনে করেন, চুক্তির বেশিরভাগ ধারা মূল সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ও একতরফাভাবে উপজাতি আঞ্চলিক দলগুলো ও তাদের সমর্থন সন্ত্রাসী আর্ম গ্রুপ /গোষ্ঠীকেই প্রাধান্য দিয়ে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদিত করা হয়েছিল। উপজাতীয়দের মধ্য থেকেও খোদ সন্তুর জেএসএস এর একাংশ ইউপিডিএফ গঠন করে স্বায়ত্তশাসন দাবি রেখে সশস্ত্র আন্দোলন করছে চুক্তির বিরোধিতা করে।

বাঙালি নেতারা বলছে-
পার্বত্য বাঙ্গালীদের মৌলিক অধিকার হরণ করে একতরফাভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জেএসএস সন্তু লারমার শান্তিবাহিনীর সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন অনেকটা বিতর্কিত। এ চুক্তির লক্ষ্যবস্তু যদিও রক্তপাত বন্ধ করা, সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ করা এবং অবৈধ অস্ত্র পরিহার করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য করা হয়েছিল। সরকার আরো বলেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে দিতে সরকার এবং জনসংহতি সমিতির মধ্যকার চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। সরকারের পক্ষ হতে আরো জানানো হয় যে, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, দীর্ঘ সংঘাত বন্ধ করে শান্তি, সম্প্রীতি, ঐক্য ও সেতু বন্ধন সৃষ্টির লক্ষ্যে চুক্তি সম্পাদিত করে শেখ হাসিনা। কিন্তু পার্বত্য চুক্তি শান্তি ফিরে আসেনি। চুক্তির দীর্ঘ দুই যুগ অতিক্রম করার পরও সে পূর্বেকার ন্যায়ে পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রধারী বিদ্যমান। তারা চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, অপহরণ, গুন-গুম ও রাষ্ট্র বিরোধী তৎপরতা হরহামেশাই প্রশাসনের নাগালে করে থাকে। সরকার চুক্তির বেশিরভাগই ধারা বাস্তবায়ন করলেও তথাকথিত শান্তিবাহিনী তা অস্বীকার করে আসছে।

সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড করেছে। যার চুক্তির পরের পরিসংখ্যান-
চুক্তির পর রাস্তাঘাট হয়েছে, ৩৫৯০.৫ কিলোমিটার, হাইস্কুল ৪০৪টি, কলেজ ২৬টি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৩টি, মেডিকেল কলেজ ১টি, হাসপাতাল ১২১টি, বৌদ্ধ উপাসনালয় ৫৯০টি, খ্রিস্টান গির্জা হয়েছে ৩৩৮টি, হিন্দুর মন্দির ১৭৯টি, মসজিদ ৭২৩টি, শিল্প কলকারখানা ২৭টি, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প ৫০৩৩টি। সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-২৩টি এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক নিয়মিত সহায়তা প্রদান করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৫৮টি।
এরপর শিক্ষা-চাকরি এবং কোটা সুবিধার মাধ্যমে উপজাতীয়দের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছে।

সরকারের পক্ষ হতে শান্তিবাহিনীকে দেয়া শুধুমাত্র একটি শর্ত ছিলো ‘অবৈধ অস্ত্র পরিহার করা’। এই একটি মাত্র শর্ত অবৈধ অস্ত্র পরিহার তাও বাস্তবায়ন করেন নি জেএসএস সভাপতি সন্তু লারমা! ৪ খন্ডের পার্বত্য চুক্তির বেশিরভাগ শর্ত বা ধারা শান্তিবাহিনীর পক্ষে। তার পরেও সন্তু গংরা অবৈধ অস্ত্র পরিহার করেন নি। খোদ সন্তু লারমা নিজেই ২০১৩ সালে বেসরকারি টিভি চ্যানেল ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের সাংবাদিক শামীমা বিনতে-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অকপটে স্বীকার করে বলেন, “আমরা চুক্তির সময় সম্পূর্ণ অস্ত্র জমা দিইনি। আমাদের এখনো কয়েকশো সশস্ত্র জনবল রয়েছে!”
সন্তু লারমার এমন বক্তব্যের পরেও পার্বত্য চুক্তির মৌলিক শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে এনে সন্তু লারমা গংদের বিরুদ্ধে সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এটাই হলো সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয়।

সমতলের বুদ্ধিজীবি, প্রগতিশীল ও বুদ্ধিবৃত্তি করা মহল এবং একটি ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী বারবারই অভিযোগ করে বলে আসছেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির মূল বাঙালি ও সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ।”
প্রকৃতপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা, সংকট, সমস্যা ও বিভাজন কিংবা ষড়যন্ত্রকারীদের অপতৎপরতা পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা, বাঙালী প্রবেশকে কেন্দ্র করে হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব হতে এ ষড়যন্ত্র ছিল। ১৯৪৭-শে বৃটিশরা যখন ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে যায় তৎসময় ভারত হতে ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের অংশে পড়ে। তৎকালীন এই নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত চাকমা ও মারমা সম্প্রদায়ের কথিত রাজারা তার বিরোধীতা করে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারত ও মায়ানমারের পতাকা উত্তোলন করেন!
পূর্ব পাকিস্তানের পার্বত্য চট্টগ্রামেকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার পক্ষে ছিল উপজাতি নেতৃত্বশ্রণী। এ নিয়ে ১৯৪৭ সালে রাঙামাটিতে ভারতের পতাকা উত্তোলন করে আত্মস্বীকৃত রাজাকার চাকমা সার্কেল চীফ ত্রিদিব রায় আর বান্দরবান অংশে মায়ানমারের পতাকা উত্তোলন করে বোমাং সার্কেল! তখন কিন্তু বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়নি। যদিও সুযোগ-সুবিধা পেয়ে এবং আত্মীয় বন্ধনের ফলে পরবর্তীতে আত্মস্বীকৃত রাজাকার ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের অনুসারী হয়ে যান। ১৯৭১ সালে যুদ্ধে ত্রিদিব রায় বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান করে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন৷ তার এ ভূমিকার কারণে পাকিস্তান সরকার তাকে নিরাস করেন নি। তাকে মন্ত্রী ও কূটনীতিক পদমর্যাদা প্রদান করে। বিষয়টি সকলেরই জানা। এ নিয়ে বিশদভাবে ব্যাখা করার যৌক্তিকতাও নেই।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে যখন নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ব্যস্ত ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধুর ৭২ সংবিধানকে অস্বীকার করে নিজেদের আবির্ভাবের জানান দেয় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এমএন লারমা) অথাৎ সন্তু লারমার আপন বড় ভাই। ১৯৭২ সালে ভারতের সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে জন সংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস বা জেএসএস) এবং তার সশস্ত্র শাখা তথাকথিত শান্তিবাহিনী আত্মপ্রকাশ করে। বিষয়টি পরিষ্কার হয় ১৯৭৩ সালে। পরবর্তীতে আরো পরিষ্কার হয়, ১৯৭৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের স্থাপনা যেমন বনবিভাগের ওপর হামলা করে শান্তিবাহিনী নিজেদের জানান দেয়। অথচ তখনও পাহাড়ে বাঙালি ও সেনাবাহিনীর আগমণ ঘটেনি! কিছুসংখ্যক বাঙালি বসবাসকারী ছিল এ অঞ্চলে। আজকের ভূমি পুত্র (আদিবাসী দাবিদার) ‘উপজাতি’ যারা ভারত, বার্মার ও মঙ্গোলীয় অঞ্চল হতে বিতাড়িত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমণ করেন, তাদের আগমণের পূর্ব হতে কার্পাসমহল ও কাপ্তাই এলাকায় বসবাসরত ছিল কিছু বাঙালিদের। এর বাহিরে অধিক বাঙালি পাহাড়ে ছিল না। অথচ সমতলের বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল, জ্ঞানপাপী, বুদ্ধিবৃত্তি করা মহলটি বারবার অভিযোগ করে আসছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির মূলে বাঙালি ও সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ! শান্তিবাহিনী যখন পাহাড়ে নাশকতা, রাষ্ট্র বিরোধী তৎপরতা, রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলা করে তখন পাহাড়ে বাঙ্গালী, সেনাবাহিনীর উপস্থিতি এখনকার মত বড়ো পরিসরে ছিল না। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা, সংকট ও বিভাজন সে দেশবিভাগের প্রক্কাল থেকেই বিরাজমান। পাহাড়ে ১৯৭৯ সালে পুরো দমে বাঙালী বসতি স্থাপন শুরু হয়। তার ২ বছর আগে ১৯৭৭ সালে বান্দরবান সাঙ্গু নদীতে সেনাসদস্য কাদেরসহ ৫ জনকে অতর্কিতভাবে গুলি করে হত্যা করে। এই থেকে স্পষ্ট যে, বাঙালিরা পার্বত্য সমস্যার মূলে নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী।

আগের পোস্টপার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধারা-উপধারা সংশোধন দাবি।
পরের পোস্টসরকার চুক্তি বাস্তবায়নে অনড়; জেএসএস এর প্রতিদান লাশের স্তুপ।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন