পার্বত্যাঞ্চল এখনো কেন অশান্ত: মোস্তফা কামাল।

0

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর একের পর এক ইস্যু ঘুরছে স্পর্শকাতর পার্বত্য চট্টগ্রামেও। সেখানকার বাঙালি ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে উসকে দেওয়া হচ্ছে অবিশ্বাস ও অনাস্থায়। প্রথমে মোটরসাইকেল চুরির ঘটনাকে পুঁজি করে বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পাহাড়ি নারীদের সংগঠিত করে চড়াও করা হয় দায়িত্বরত সেনা ও বিজিবি সদস্যদের ওপর।

কুশীলবরা আশা করেছিল, পাহাড়ি নারীদের লাঠির আঘাতে উত্তেজিত হয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অ্যাকশনে যাবেন। তখন এটি হয়ে যাবে আন্তর্জাতিক ইস্যু। নিরাপত্তা বাহিনী সেই ফাঁদে পা দেয়নি। সর্বোচ্চ ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে।

পরিকল্পনা মার খাওয়ার পরও দমছে না পাহাড়ি এলাকায় অশান্তি সৃষ্টির আয়োজকরা। একটু দম নিয়ে সাজায় আরেক আয়োজন। এই চক্র ও ভারতের মদদে মাঝেমধ্যেই গাঝাড়া দিয়ে ওঠে কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির সশস্ত্র শাখা কেএনএফের সন্ত্রাসীরা। তাদের দমাতে মাঠে কাজ করছে সেনাবাহিনী।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের জন্য বরাবরই একটি স্পর্শকাতর অঞ্চল। স্বাধীনতার পর থেকে আলাদা ভূমির দাবিসহ নানা ছুতায় সেখানে সশস্ত্র তৎপরতা চালিয়ে দেশের সার্বভৌমত্বকেই ঝুঁকিতে ফেলা হয়। শান্তিবাহিনী নামের এই সশস্ত্র গোষ্ঠীকে রোখা হয়ে যায় সেনাবাহিনীর বাড়তি ও নিয়মিত দায়িত্ব। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পাহাড়ের সশস্ত্র বিপথগামীরা অস্ত্র সমর্পণ করে সামাজিক জীবনে ফিরে আসে। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়িতে জনসংহতি সমিতির প্রায় দুই হাজার সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করে।

সরকার তাদের পুনর্বাসন করাসহ পুলিশ ও আনসারে ৬৮৫ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। কিন্তু চুক্তি সইয়ের এক বছরের মধ্যেই চুক্তির বিরোধিতা করে গঠন করা হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। চুক্তির পক্ষের জনসংহতি সমিতি বা জেএসএসের সঙ্গে ইউপিডিএফের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের শুরু তখন থেকেই। ব্যক্তিস্বার্থ ও ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে এই দুই দলের নেতাকর্মীদের অন্তর্দ্বন্দ্বের জেরে ২০১০ সালে জেএসএস ভেঙে গঠিত হয় জেএসএস-লারমা। এর পর থেকে শুরু হয় ত্রিমুখী সংঘর্ষ ও প্রাণহানি।
পার্বত্যাঞ্চল এখনো কেন অশান্ত২০১৭ সালে ইউপিডিএফ ভেঙে জন্ম নেয় ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে আরেকটি দল। এক পর্যায়ে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দল জেএসএস-লারমার সঙ্গে জোট বেঁধে মূল ইউপিডিএফ ও জেএসএস উভয় দলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র তৎপরতায় নামে। এতে পাহাড়ে সংঘাত পায় নতুন মাত্রা। এবার ইউপিডিএফ মূল দল ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলকে সহায়তার জন্য জেএসএস-লারমাকে দোষারোপ করে। ফলে ২০১৭ সাল থেকে সংঘাত হয়ে যায় চতুর্মুখী। এই আঞ্চলিক দলগুলোর বিরোধ মূলত কোনো নৈতিক বা আদর্শিক কারণে নয়। স্বার্থের দ্বন্দ্ব, চাঁদা আদায়, ভাগ-বাটোয়ারাই সংঘাত-হানাহানির মূল কারণ। সেই সঙ্গে বাইরের উসকানি।

নানা ঘটনায় প্রমাণ এসব বিভক্তির পেছনেও রয়েছে বাইরের সম্পৃক্ততা। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে নষ্ট করতে নিজের ভূমিতে আশ্রয়-প্রশ্রয়, অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘শান্তিবাহিনী’ সৃষ্টিকারী ভারতের পরশেই ইউপিডিএফের জন্ম। ইউপিডিএফ তৈরি করেই তারা বসে থাকেনি। পাহাড়ে শান্তি ফিরুক, পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যটনের অপার সম্ভাবনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাক, ভারত তা হতে দিতে চায় না। এ অঞ্চলের মানুষের উন্নত জীবনযাপন মণিপুর, নাগাল্যান্ড কিংবা মিজোরামের মতো পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলোর দীর্ঘকালের সশস্ত্র সংগ্রামকে আরো উৎসাহিত করবে বলে ভারতের ভয়। সেনা উপস্থিতির কারণে ওই অঞ্চলে শান্তির বাতাবরণও ভারতের অসহ্য।

অশান্তি ও বিরোধ বাধানোর ক্ষেত্রে বাঙালি ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরাজমান অবিশ্বাস ও আস্থার ঘাটতিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে নতুন করে। শেখ হাসিনার পলায়নের পর দেশের বিভিন্ন সেক্টরে গণ্ডগোল পাকিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টার অংশ হিসেবে পাহাড়কেও টার্গেট করা হয়েছে। তৈরি করা হচ্ছে ষড়যন্ত্রের নতুন চোরাগলি। পাহাড়ি জনপদে শান্তিকে অবাস্তব-অধরা করে রাখার এই চেষ্টা চট করে থেমে যাবে, তা ভাবার অবস্থা নেই। তার ওপর আঞ্চলিক দলগুলোকে নতুন করে উসকানো হচ্ছে। সন্তু লারমা গ্রুপ শান্তিচুক্তির পর রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিলেও পাহাড়ে শান্তি রক্ষার বদলে পর্দার আড়াল থেকে অশান্তি সৃষ্টিতে তৎপর। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকার তৎপর হলেও দেশের কিছু ব্যক্তি এবং কিছু বিদেশি এনজিও অর্থ খরচ করে অশান্তির আগুন জিইয়ে রাখছে। সুযোগ পেলে ছড়িয়েও দিচ্ছে, যা দেশের ৬১ জেলার সঙ্গে পাহাড়ি তিন জেলাকে আলাদা করে দিয়েছে। সাংগঠনিকভাবে এই তালিকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি-জেএসএস, জেএসএস সংস্কার ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক, মগ লিবারেশন পার্টি, কেএনএফসহ ছয়-সাতটি নামের ভেতরে-বাইরে রয়েছে আরো নানা মহল। এখানে প্রতিবেশী ভারত বড় প্রাসঙ্গিক।

পরিস্থিতির অনিবার্যতায় ভারতকে এখন দিশা পাল্টাতে হচ্ছে, সামনেও হবে। তা কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব দিকেই। বাংলাদেশ বিষয়ে ভারত সরকারের মনোজাগতিক দিক একদম পরিষ্কার। নানা তিক্ত কথার সমান্তরালে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বলবৎ থাকছে। কারণ জগতে অনেক কিছুতে রদবদল হলেও প্রতিবেশী বদলানো যায় না। মেনে নিতে হয় উভয়কেই। এই নিয়ম বা রীতিতে বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় উত্তেজনা-প্রাণহানিতে সন্দেহের তীর ভারতের দিকেই যায়। আবার ভারতে ‘সেভেন সিস্টার্স’ বা সাত বোনের সংসারে বাংলাদেশের টোকাটুকি নিয়েও কথা আছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক দুই দিন আগে ভারতীয় চ্যানেল এনডিটিভিকে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আপনি যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলেন, তাহলে সেই অস্থিরতার আঁচ কিন্তু বাংলাদেশের বাইরেও মায়ানমার, সেভেন সিস্টার্স, পশ্চিমবঙ্গ—সর্বত্রই অগ্ন্যুৎপাতের মতো ছড়িয়ে পড়বে।’ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের কয়েক দিনে বিভিন্ন ভারতীয় সংবাদপত্র বা চ্যানেলকে দেওয়া একাধিক সাক্ষাৎকারেও তিনি মোটামুটি একই ধরনের সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন, আর প্রতিবারই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বোঝাতে ব্যবহার করেছিলেন এই ‘সেভেন সিস্টার্স’ শব্দবন্ধটি।

ভারতের সেভেন সিস্টার্সের নৈসর্গিক শোভা, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। পাশাপাশি বছরের পর বছর ধরে এই অঞ্চলটি যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনে বিক্ষুব্ধ থেকেছে, সেটি আরেক বাস্তবতা। সেখানে বাংলাদেশকে টেনে আনাও আরেক বাস্তবতা। কয়েক দিন আগে বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যার পর কোনো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে শত শত ছাত্রকে স্লোগান দিতে শোনা গিয়েছিল, ‘বন্যায় যদি মানুষ মরে, সেভেন সিস্টার্স থাকবে না রে!’ সেই দৃশ্যের ভিডিও প্রবল বেগে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতেও। সেভেন সিস্টার্সের ভারতের সঙ্গে যুক্ত থাকা না থাকার প্রশ্নে বাংলাদেশের যে একটা সম্পর্কের রচনা আছে অনেক দিন ধরে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ স্থলসীমান্ত, তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই এই সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে! আরো নির্দিষ্ট করে বললে, সাতটির মধ্যে চার বোন—আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের সঙ্গে। সেভেন সিস্টার্সভুক্ত এই রাজ্যগুলোর বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী সময়ে সময়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। আবার ওই নেতাদের বাংলাদেশ সরকার ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে, সেই দৃষ্টান্তও আছে। হাসিনা সরকার একের পর এক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে গোপনে বা প্রকাশ্যে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে।

সেভেন সিস্টার্সের সবচেয়ে বড় রাজ্য আসামের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা একাধিকবার প্রকাশ্যেই বলেছেন, বাংলাদেশ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী উলফার নেতাদের ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে বলেই আসাম আজ এত ‘শান্তিপূর্ণ’, রাজ্যের লোক ‘রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে’! ফলে ভারতের এই অঞ্চলটির ওপর প্রতিবেশী বাংলাদেশের যে একটা ‘স্ট্র্যাটেজিক লিভারেজ’ বা কৌশলগত সুবিধা আদায়ের পরিসর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে ঘটনা ও পরিস্থিতির অনিবার্যতায় পুরনো সেসব কথা এখন আসছে আবার নতুন করে।

লেখক : সাংবাদিক, ডেপুটি হেড
অব নিউজ, বাংলাভিশন

আগের পোস্টপার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও জেএসএস এখনো সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে তৎপর!
পরের পোস্টপার্বত্য চুক্তির সংবিধানবিরোধী ধারা-উপধারা সংশোধন প্রয়োজন।’

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন