পার্বত্য চুক্তি ছিল পাহাড়িদের জন্য অপ্রত্যাশিত এক পাওয়া। দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ঘটিয়ে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান, দেশের বিধিবিধান ও আইন যথাযথ অনুসরণ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে কয়েক দফা সংলাপের পর স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চুক্তি। কিন্তু চুক্তির ২৭ বছর পারেও কি পাহাড়ে শান্তি এসেছে কিনা সেটাই ভাববার বিষয়।
পার্বত্য চুক্তির পর থেকে আজ অবধি তিন পার্বত্য জেলায় ব্যাপক উন্নয়ন হলেও জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে চুক্তিতে দেওয়া শর্তের দুটির একটিও পালন করেনি। বরং চুক্তি ভঙ্গ করে এখন চুক্তির সুফল ভোগ করছে তারা। জেএসএস নেতা সন্তু লারমার কথা বলতে গেলে তিনি চুক্তির পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যদা ভোগ করে বিলাসবহুল গাড়িতে চলাচল করছে পাশাপাশি পাহাড়কে উত্তপ্ত করতে লালন করছে জেএসএস এর অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনীকে। তাহলে কি তাদের উদ্যেশ্য এটাই ছিল পার্বত্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার আড়ালে অস্ত্রবাজি অব্যাহত রাখা?
পার্বত্য চুক্তির ৯৮টি উপধারার মধ্যে ৮৬টি উপধারা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের কাজ সম্পন্ন করেছে সরকার। চুক্তির অবশিষ্ট ৪টি উপধারা আংশিক এবং ৮টি উপধারা বর্তমানে বাস্তবায়নের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পার্বত্য চুক্তির আংশিক ও অবাস্তবায়িত ধারাগুলো বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলায় শান্তি আনয়নের পাশাপাশি ওই এলাকায় অবকাঠামো এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধনের মাধ্যমে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক মানোন্নয়নে সরকার যথেষ্ট সচেষ্ট রয়েছে। পার্বত্য চুক্তির ফলে এই অঞ্চলগুলোতে অর্থনৈতিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার যেমন উন্নয়ন হয়েছে তেমনি শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতেও উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে পার্বত্য এলাকায়। পার্বত্য চুক্তির পরে গত ২৭ বছরে পার্বত্য এলাকায় ব্যাপক প্রসার ঘটেছে পর্যটন শিল্পের। এর ফলে স্থানীয় পাহাড়ি এবং বাঙালি উভয়েই আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে।
বাংলাদেশের যে কয়েকটি জায়গায় পর্যটকরা সবচেয়ে বেশি বেড়াতে যান তার মধ্যে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান অন্যতম। পার্বত্য চুক্তি না হলে এটি কখনোই সম্ভব হতো না। পার্বত্য চুক্তির পর সরকার দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিসহ সব ক্ষেত্রেই ব্যাপক উন্নয়ন করেছে।
কিন্তু এতকিছুর পরেও শান্তি ফেরেনি পার্বত্য অঞ্চলে। শান্তি চুক্তির ফলে সাময়িকভাবে বন্ধ হয় দীর্ঘদিন ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাত। কিন্তু সেটি বেশিদিন বিরাজ করেনি। বরং শান্তি চুক্তির বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে পাহাড়িদের একটি পক্ষ। যার অন্যতম হচ্ছে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। যদিও বিভিন্ন সময়ে সংবাদ সম্মেলনে পার্বত্য শান্তি প্রতিষ্ঠা না হওয়ার জন্য সরকারকেই দোষারোপ করেন প্রতিমন্ত্রীর সুযোগ-সুবিধা ভোগকারী সন্তু লারমা।
পার্বত্য চুক্তির দীর্ঘদিন পার হলেও তিন পার্বত্য জেলায় সংঘাত, অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। পার্বত্য চুক্তির পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে জটিল এক রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হয়েছে। চুক্তি সম্পাদনের সাথে সাথেই এর বিরোধিতা করে তৈরি হয়েছিল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফ। বর্তমানে ইউপিডিএফ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আলাদা করে সশস্ত্র গ্রুপ রয়েছে। এরা সবাই পরস্পরের প্রতিপক্ষ। গত কয়েক বছর যাবৎ এসব সংগঠন একে অপরের সাথে সংঘাতে লিপ্ত। খুনোখুনি হচ্ছে প্রতিনয়ত। অবৈধ অস্ত্র এবং চাঁদাবাজি এখন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে পাহাড়ে। তবে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে চাঁদাবাজি এবং অধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই আঞ্চলিক দল এবং গোষ্ঠীগুলো বিভক্ত হয়ে আজ ছয়-সাতটি সংগঠনের জন্ম হয়েছে। সংগঠনগুলো আলাদা হলেও এদের সকলের উদ্দেশ্য একটাই চাঁদাবাজি আর সন্ত্রাসী কর্মকান্ড।
পার্বত্য চুক্তিতে প্রধান শর্ত হিসেবে অস্ত্র জমা দেওয়ার কথা থাকলেও আঞ্চলিক সংগঠনগুলো এখনও অবৈধ অস্ত্রই জমা দেয়নি বরং তাদের বহরে ধীরে ধীরে যুক্ত হয়েছে এসএমজি, এলএমজি, রাইফেল, স্নাইপার রাইফেলসহ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। আর এই সব অস্ত্র ব্যবহার করে তারা পুরো পার্বত্য এলাকায় একের পর এক হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে এলাকায় শান্তির পরিবর্তে অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। পার্বত্য চুক্তির ২৭ বছরেও পাহাড়ে থামেনি অস্ত্রের ঝনঝনানি। এখনো গোলাগুলির শব্দে গভীর রাতে ঘুম ভাঙে এলাকায় বসবাসরত সাধারণ মানুষের। সশস্ত্র সংঘর্ষে পড়ছে লাশের পর লাশ। অব্যাহত রয়েছে পাহাড়ি আঞ্চলিক দলগুলোর সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও আধিপত্য বিস্তারের লড়াই।
জানা যায়, জেএসএসের (মূল) এর সঙ্গে সরকারের চুক্তির বিষয়টি অনেকেই মানতে পারেনি। ফলে জেএসএস ভেঙে তাৎক্ষণিক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রসীত খীসার নেতৃত্বে গঠন হয় সশস্ত্র সংগঠন ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (মূল)। এরপর হয় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও জেএসএস (সংস্কার)। নতুন নতুন সংগঠন ও বাহিনী গঠিত হয়ে জড়িয়ে পড়ে চাঁদাবাজি, হত্যা, ধর্ষণ ও অপহরণের মতো অপকর্মে। এই সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধ এবং আধিপত্যের কারণে বেড়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘাত।
বেপরোয়াভাবে ওইসব অপকর্ম ঘটালেও কঠোরভাবে তাদের দমন করা সম্ভব হচ্ছে না পাহাড়ের দুর্গমতার কারণে। উল্টো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সুযোগ নিয়ে সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীসহ পার্বত্য অঞ্চলের নিরীহ বাঙালিদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে তারা।
এই সংগঠনগুলোর বেপরোয়া চাঁদাবাজি এবং পাহাড়ি-বাঙালিদের ভূমি জটিলতাও প্রকট আকার ধারণ করেছে। এমন এক অবস্থার কারণে পাহাড়ে এখনও ফিরেনি শান্তির পরিবেশ। ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে পাহাড়ে ঝরছে রক্ত, থামেনি অভ্যন্তরীণ হানাহানি। অথচ পার্বত্য চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল সকল সন্ত্রসী কর্মকান্ড বন্ধ করে পাহাড়ি জনপদে শান্তি ফিরিয়ে আনা। সেই লক্ষ্য থেকেই এখন সরে এসেছে জেএসএস সন্তু গ্রুপ সহ বাকিরা।