হান্নান সরকার, হিল নিউজ বিডি:
পার্বত্য সংঘাত বাংলাদেশের এক-দশমাংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সৃষ্ট একটি রাজনৈতিক সংঘাতরূপে পরিচিত হলেও এটি মূলত স্বাধীনতা লাভের মানসেই হচ্ছে। রাজনৈতিক যে সংঘাত ছিল তা ১৯৯৭ সালের ২-রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস) মধ্যকার সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে নিরসন করা হয়েছে। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর উপজাতি সংগঠন তথা উপজাতি জনগণের আর রাজনৈতিক দাবিদাওয়া থাকতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সকল উপজাতীয় জাতিসত্তার বেছে থাকার কবজ। এখানে স্পষ্টতই চুক্তির পরবর্তী সময়ে সব সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি ও আধিপত্য বিস্তার এবং স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে।
বান্দরবান ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে আলোচনায় আসা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ খ্যাত বম পার্টি যেসব দাবিদাওয়া বরাবরই রাস্ট্রের কাছে উত্থাপন করেছে তা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে স্পষ্ট যে, কেএনএফ কোনপ্রকার রাজনৈতিক বিষয়াবলি নিয়ে সৃষ্ট হয়নি।
যদি যুক্তির খাতিরে ধরে নিই চুক্তির সুফল কুকিভুক্ত জনগোষ্ঠী: ম্রো, মুরং, খিয়াং, লুসাই, পাংখুয়া ও কথিত বম সম্প্রদায় পাচ্ছে না। সেদিন থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে তাদের রাজনৈতিক দাবিদাওয়া বা অধিকার থাকতে পারে। তাহলে বলবো, এটি কখনো রাজনৈতিক ভাবে রাস্ট্রের কাছে উত্থাপন না করে কেনই সশস্ত্র ভাবে করা হলো? আজকে কেএনএফ ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্র লুট, চাঁদাবাজি, সাধারণ মানুষ হত্যা ও রাস্ট্রীয় বাহিনী হত্যা করে আলোচনা-সমালোচনায়। প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাস্ট্রকে হুমকি দিচ্ছে। এটি কী একটি রাজনৈতিক সংগঠনের আদর্শ হতে পারে? এই কেএনএফ কী কুকিভুক্ত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি করে? যদি প্রতিনিধি করে থাকে তাহলে কেএনএফ এর শতভাগ সশস্ত্র সদস্য কেন বম সম্প্রদায় হইতে? আমরা বিগত সময় ধরে দেখি আসছি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক সকল সদস্য বম সম্প্রদায় হইতে। এবং স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে কেএনএফ কুকিভুক্ত জনগোষ্ঠীর কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ১২ হাজার বম সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে৷ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী কাচিন, মিজোরামে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হাজার খানেক কেএনএফ সদস্য রয়েছে। যাদের বেশিভাগই বম সম্প্রদায়ের যু্কক।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, হেডম্যান কার্বারী ও মান্যগণ্য ব্যক্তিরা বলছেন, “সমগ্র বম সম্প্রদায় কেএনএফ নয় আর কুকিভুক্ত সম্প্রদায় তো একদমই নয়। কিছু বিপদগ্রস্ত বম যুবক উগ্র চিন্তা চেতনা, এবং স্বাধীনতা লাভের মানসেই বিচ্ছিন্নতাবাদে পা বাড়িয়ে রাস্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়েছে। কেএনএফ সন্ত্রাসীদের কারণে আজকে আমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ সবার চোখে অপরাধী।”
একই কথা বলেছে কুকিভুক্ত সম্প্রদায়দের প্রতিনিধিরা। তারা বলছে, কেএনএফ গঠনে আমাদের মতামত গ্রহণ করা হয়নি। কেন কেএনএফ গঠন হচ্ছে, কিবা তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য বা দাবিদাওয়া তা আমরা যেমন প্রতিনিধিরা জানতে পারেনি তেমনি ৭৬ হাজার কুকিভুক্ত জানতে পারেনি।
স্থানীয় জাতিসত্তার প্রতিনিধিরা আরো বলছেন, একটি সংগঠন তৈরি হয় জনগণের মুক্তি সংগ্রামে যুক্ত হয়ে রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। কেএনএফ যেহেতু আমাদের জাতির সাইনবোর্ড ব্যবহার করছে সেহেতু উপজাতি হিসেবে আমাদের জনগণের মতামত গ্রহণ করা উচিত ছিল। কিন্তু তারা অতি সংগোপনে সৃষ্ট হয়ে রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর গহীন অরণ্যকে বেছে নেয়। সেখান থেকেই অস্ত্র নিয়ে রাস্ট্রের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করছে। তাদের রাস্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আমাদের কুকিভুক্ত জনগণের স্বার্থে নয়। জনগণের মতামত উপেক্ষা করে রাস্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ রাস্ট্রদ্রোহিতার শামিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রুমার এক পাড়া কার্বারী বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের রাস্ট্রের কাছে অধিকার বিষয়ক নানা দাবিদাওয়া থাকতে পারে তা আমরা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাস্ট্রের কাছে পেশ করবো। কেন অস্ত্র ধরে রাস্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবো? স্বাধীনতা দাবি আমাদের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র উপজাতি জাতিসত্তার জন্য মঙ্গল নয়। কেএনএফ নিজেদের চাঁদাবাজি, অপহরণ বাণিজ্য ও অস্ত্রবাজির মাধ্যমে কুকিল্যাণ্ড নামক রাজ্য বা রাস্ট্র গঠনের নামে পাহাড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে অশান্তি ও অস্থিতিশীল করছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতি জাতিসত্তার জীবনমানের উপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে৷ সম্প্রীতির বান্দরবান আজ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। মানুষের মনে ভয়, আতঙ্ক কাজ করছে। কখন কী ঘটে। মানুষের জীবন জীবিকায় ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। পর্যটন শিল্পে ধ্বস নামছে। মানুষের মনে কেএনএফ আতঙ্ক যেসব আছে তেমনি রাস্ট্রীয় বাহিনীর আতঙ্কও আছে। সমস্ত বান্দরবান আজ অশান্তির দাবানলে পুড়ছে। বিপদগ্রস্ত কিছু বম যুবক দ্বারা সৃষ্টি কেএনএফ এর আত্মঘাতী মুলক সিদ্ধান্তে আজকে এখানকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের জীবনমানের উপর প্রভাব পড়ছে৷
কেএনএফ সৃষ্টিকারী রুমা উপজেলার ইডেন পাড়ার বাসিন্দা নাথান বম ও যেসকল বম সম্প্রদায়ের যুবক পাহাড়ে ব্যাংক ডাকাতি, পুলিশের অস্ত্রলুট, চাঁদাবাজি, নিরাপত্তা বাহিনীর উপর আক্রমণ ও পর্যটন শিল্প ধ্বংস করেছে তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি৷