অনন্ত অসীম, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ প্রতিনিধি:
বাংলাদেশের সংবিধান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর তারিখে বাংলাদেশ গণপরিষদে এই সংবিধান গৃহীত হয়, এবং একই বছরের ১৬ই ডিসেম্বর বা বাংলাদেশের বিজয় দিবসের প্রথম বার্ষিকী হতে এটি কার্যকর হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের মোট ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। প্রসঙ্গ যেহেতু সংবিধান সম্পর্কিত সেহেতু এই সম্পর্কে কিছু বিষয় পাঠকের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি একই সাথে প্রস্তাবনার আদিবাসী শব্দটির বিরোধিতা করার সুনির্দিষ্ট কারণ নিম্নোক্ত বিশদভাবে ব্যাখ্যা করছি-
গত ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সংবিধান সংস্কারের দাবি ওঠে। তবে এই দাবির পক্ষে ও বিপক্ষে অবস্থান ছিল দেশের রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষের। এরপরই সংবিধান সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করে অন্তবর্তীকালীন সরকার।
সংবিধান সংস্কার কমিশন হলো ২০২৪ সালে বাংলাদেশ অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি কমিশন যার উদ্দেশ্য হলো অতীতের সাংবিধানিক ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা এবং একটি নতুন অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ তৈরি করা। অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যেই সংস্কার প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করার জন্য কাজ শুরু করেছে।
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান পাকাপোক্ত এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা জনগণের উপর প্রভাবিত। এর পরিবর্তন চায় দেশের জনগণ কিন্তু এর তেমন একটা পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না৷ কারণ রাজনৈতিক দল ও আমলারা নিজেদের প্রভাব টিকিয়ে রাখতে এর তেমন একটা পরিবর্তন চাইবে বলে মনে হয় না। এটা পূর্বের ইতিহাস থেকে প্রতীয়মান। এখানেই উল্লেখ যে, বাংলাদেশ সংবিধানে সকল জনগোষ্ঠীর অধিকার, মর্যাদা, ন্যায্যতা ও শ্রেণীবিন্যাস সমতার ভিত্তিতে নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। এরপর দেবাশীষ রায় কর্তৃক কথিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পক্ষে নানান দাবিদাওয়া এবং বর্তমান সংবিধানের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বাঙালি জাতির পরিচয় সংস্কার বিষয়ে কমিশন বরাবর প্রস্তাবনা করেছে। এই প্রস্তাবনা কতটা ন্যায্য-অন্যায্য তা যৌক্তিকতার চোখে কিংবা আইনের চোখে বিচার বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
বাংলাদেশে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি। জনসংখ্যার ৯৯% বাঙালি। ক্ষুদ্র জাতিগত (ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা উপজাতি), চাকমা, ত্রিপুরী, মারমা, কুকি, রাখাইন, মুন্ডা, গারো (আচিক) , ওরাওঁ , সাঁওতাল , মেইতি জনগণ, মণিপুরী,জোমি, বিহারী
খাসি, ইত্যাদি ১%। অর্থাৎ এই রাস্ট্রে বাঙালিই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হিসেবে রাষ্ট্রীয় সংবিধানে জাতি হিসেবে বাঙালি তথা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ স্বীকৃতি স্বাভাবিক। আর বাঙালি মুসলিম ৯০% জনগোষ্ঠী। এই বিবেচনায় রাষ্ট্র ধর্ম জনসংখ্যা অনুপাতে ইসলাম থাকাটাই যৌক্তিক। এটি সকালের দাবি।
আমরা যদি, ইতিহাসের দিয়ে তাকায় তাহলে বাঙালির অবদান গুলো আমাদের দেখতে হবে। বিভিন্ন কালে কালেই আগ্রাসন বিরোধী আন্দোলন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার আন্দোলনসহ সকল আন্দোলনে বাঙালি জাতির অংশগ্রহণ ছিল। সুতরাং সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রাধান্য থাকাটাই স্বাভাবিক। মার্কিন, চীন, ভারত সংবিধানের দিকে তাকালেই দেখবেন একই চিত্র, দেশগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর আধিপত্য প্রতিফলিত হয়েছে৷ এখানে ইতিবাচক হচ্ছে, বাংলাদেশের ৯৯% জনগোষ্ঠী বাঙালি হলেও ১% ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা উপজাতি জাতিসত্তার, অধিকার, সংস্কৃতি চর্চা ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে৷ বাংলাদেশ সংবিধান সকল জনগোষ্ঠীর অধিকার সমতার ভিত্তিতে নির্ধারণ করেছে। পিছিয়ে পড়া জাতিসত্তা হিসেবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম হলেও সকল সম্প্রদায়ের ধর্ম পালনের ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষতা বজায় রেখেই যার যার ধর্ম পালনে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে। এই দৃষ্টান্ত বাঙালি জাতির অন্যান্য জাতি ধর্ম বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতি উদারতার বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৩ (ক) অনুচ্ছেদে উপজাতিদের অধিকার এবং স্বার্থ সংরক্ষণের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।” এখানে স্পষ্টভাবে উপজাতি জনগোষ্ঠীর অধিকারের কথা বলা হয়েছে। বাঙালি তথা রাষ্ট্র কোনোভাবেই উপজাতি জনগোষ্ঠীকে অমর্যাদা করেনি। এরপরও রাঙামাটি চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার রায় গত ২৭ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে অধ্যাপক আলী রিয়াজ প্রধান সংবিধান সংস্কার কমিশন বরাবর প্রস্তাবনা পাঠান! ১৬ পৃষ্ঠা প্রস্তাবনার প্রধান বিষয়বস্তু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, “আসন্ন সংবিধান পুনর্লিখন/সংস্কার এর প্রক্রিয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম এর বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদাসহ অত্রাঞ্চল এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আদিবাসীদের পরিচয়, স্বকীয়তা ও অধিকার সংরক্ষণের বিধানবলি যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্তি।” প্রসঙ্গে।
দেবাশীষ রায় যে-সকল দাবিদাওয়া ও পরিবর্তন বিষয় সংবিধান সংস্কার কমিশন বরাবর প্রস্তাবনা আকারে পাঠিয়েছেন, এ সকল দাবিদাওয়া ও পরিবর্তন বিষয়গুলো কোনোভাবেই যৌক্তিক নয় এবং আইনীভাবেই তার ভিত্তি নেই। এটি বাংলাদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ওনার ব্যবহৃত রেফারেন্স অনেকাংশেই মিথ্যা, বানোয়াট, মনগড়া ও বিকৃত। আর দাবিগুলো বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করলে দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। দেবাশীষ রায় মূলত নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে জনবিরোধী ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবিদাওয়া এবং অপ্রাসঙ্গিক পরিবর্তন প্রস্তাবনায় যুক্ত করেছেন। কথিত আদিবাসী শব্দটি বাংলাদেশ সংবিধান কখনো সমর্থন করেনি। মার্কিন, চীন ও ভারতের মত দেশে সাংবিধানিক ভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতি নেই। এছাড়া পার্বত্য পার্বত্য চট্টগ্রাম এর বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদা বাংলাদেশের মত ক্ষুদ্র আয়তনের দেশের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি কোনো আলাদা ভূখণ্ড নয়। এখানে একটি জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী স্বীকৃতি ও বিশেষ শাসনব্যবস্থা সংবিধানে স্বীকৃতি প্রদান অতঃপর আলাদা রাষ্ট্র গঠন। আমরা ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারি।
আদিবাসী এমন একটি শব্দ। যেটি একটি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতির জনগোষ্ঠীকে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, জাতীয়তাবাদের অধিকার, ভূমি অধিকারের মত অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধিকার প্রদান করেছে। এই প্রেক্ষাপট থেকে বাংলাদেশের মত অতি ছোট দেশের ১% এর কম জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি আত্মঘাতী মূলক হিসেবে বিবেচিত হবে। কখনো আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করলেই দেশের এক-দশমাংশ বিচ্ছিন্নের দ্বারপ্রান্তে চলে যাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী দল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে সশস্ত্র লড়াই করে আসছে। মূলত এই বিবেচনায় রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দল তথা সরকার বরাবরই আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা থেকে বিরত ছিল৷ দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগে দেবাশীষ রায় আদিবাসী শব্দ, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি (হিল রেজুলেশন) কে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে প্রস্তাবনা করেছে। এটি যে একটি গভীর ষড়যন্ত্র তা আমাদের সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে পৌঁছতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৭ পৃষ্ঠা আর দেবাশীষ রায়ের প্রস্তাবনা ১৬ পৃষ্ঠা। এটি একটি চুক্তির ভিতরে আরো একটি চুক্তি কিনা তা ভেবে দেখার বিষয়। দেবাশীষ রায়ের ১৬ পৃষ্ঠা প্রস্তাবনা আইন ও যৌক্তিকতার দিক থেকে পুঙ্খানুভাবে ব্যাখ্যা করলে লেখা অনেক বড় হবে৷ এতে পাঠক বিরক্ত হবেন। তাই সেদিকে না গিয়ে বেসিক সমস্যা হিসেবে আমাদের আদিবাসী শব্দটি সম্পর্কে জানতে হবে, এবং কী কারণে এটি সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রস্তাবনায় যুক্ত হয়েছে তা আগে জানা উচিত:
পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি জনগোষ্ঠী কখনো আদিবাসী হওয়ার জাতিসংঘের ILO বা ঘোষণাপত্রের শর্ত পূরণ করে না। আদিবাসী এমন একটি জনগোষ্ঠী, যারা রাষ্ট্রের প্রাচীন জনগোষ্ঠী। কিন্তু বাংলাদেশের প্রাচীন জনগোষ্ঠী বাঙালি।
আদিবাসী সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রস্তাবনার ভয়ংকর মিশন সম্পর্কে জানতে হলে আমাদেরকে আগে জানতে হবে আদিবাসী বলতে কি বুঝায় এবং কি তার সংজ্ঞা:
আমরা আদিবাসী বলতে বুঝি আদি বাসিন্দা। আদিবাসী শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ Indigenous people। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ লুই মর্গানের সংজ্ঞানুযায়ী আদিবাসী হচ্ছে, ‘কোনো স্থানে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী যাদের উৎপত্তি, ছড়িয়ে পড়া এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই।’ এখন প্রশ্ন পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতিরা কি নিজেদের ভূমিপুত্র হিসেবে দাবি করতে পারে? যদি না পারে তাহলে তারা কীভাবে আদিবাসী হয়?
নৃবিজ্ঞানী, বিভিন্ন গবেষক ও ইতিহাসবিদদের মতে, দেশের উপজাতিরা মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত। তাদের আদিনিবাস ভারত ও মায়ানমার। ব্রাজিলের আমজান আদিবাসী, অস্ট্রেলিয়ার অবরিজিন আদিবাসী এবং রেড ইন্ডিয়ানদের মত কী বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জাতিসত্তার এদেশের পার্বত্য ভূখণ্ডে বসবাসের সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে? যদি থেকে থাকে তাহলে তাদের আদিবাসী স্বীকৃতির বিষয়ে কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়। তারা তাদের প্রাপ্ত অধিকার বুঝে নিবে। কিন্তু আপত্তি সৃষ্টি হয়েছে তাদের এ দেশের আগমনের ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভাব এবং জাতিসংঘের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংজ্ঞা অতঃপর ২০০৭ সালের ঘোষণাপত্র আলোকপাত থেকেই। ঐতিহাসিকদের মতে এ দেশে উপজাতিদের বসবাসের ইতিহাস ৩০০ বছরের বেশি নয়। চেহারা গঠনগত দিক, ভাষা, সংস্কৃতি দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী থেকে অমিল শুধু মাত্র এ ব্যবধানের মধ্য দিয়ে আদিবাসী হওয়া যায় না। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত ৪৫ টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জাতিসত্তা আছে। ILO (No169) 1- (a) উপজাতির সংজ্ঞা মতে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জাতিসত্তাগুলো উপজাতি। জাতিসংঘ স্বীকৃত উপজাতি জনগোষ্ঠীর বিশদ সংজ্ঞা- “একটি দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে ভাষা, সংস্কৃতি, সামাজিক, অর্থনৈতিক ভিন্নতর যারা, তাদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি নিজস্ব আইন দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচালিত তাদেরকে উপজাতি বলা হয়।” এর ফলশ্রুতিতে তারা বাংলাদেশের সংবিধানে উপজাতি হিসেবে স্বীকৃত।
বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগণের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস) মধ্যকার ১৯৯৭ সালের ২-রা ডিসেম্বর একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির জেলা পরিষদ আইনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বলা হয়েছে। পার্বত্য চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাতে উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। চুক্তির সুফল ও উপজাতি কোটায় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণকারী উপজাতিরা নিজেদের হঠাৎ আদিবাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া কেন? আর কে এই দেবাশীষ রায় যে, সংবিধান সংস্কার কমিশন বরাবর ষড়যন্ত্রমূলক আদিবাসী স্বীকৃতিসহ নানান বিতর্কিত দাবি-দাওয়া প্রস্তাবনায় আকারে পাঠিয়েছেন? যা নিয়ে চলছে সমালোচনা।
বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় একজন আত্মস্বীকৃত কুখ্যাত রাজাকার ত্রিদিব রায়ের পুত্রসন্তান। পিতা ত্রিদিব রায় ছিলেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধী। ৭১ সালের দালাল আইনে তার নামের তালিকা ছিল। পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে সেদেশের নাগরিক বনে গিয়ে অমৃত মন্ত্রী মর্যাদা ভোগ করেন। ছিলেন আর্জেন্টিনাসহ বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মিশনে। তার মৃত্যুর পর তাকে বাংলাদেশের মাটিতে শায়িত করতে দেওয়া হয়নি একজন আত্মস্বীকৃত রাজাকার হিসেবে।
ত্রিদিব রায় সম্পর্কে আরো জানা যায়, রাজা ত্রিদিব রায়-এর রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ব্যাখ্যা করার জন্যই প্রিয়জীত দেবসরকার তাঁর বই-এর নামে তাঁকে ‘পশ্চিম পাকিস্তানের শেষ রাজা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
মি: দেবসরকারের মতে, ১৯৫৩ সালে সিংহাসনে আরোহণ থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ত্রিদিব রায় নিজেকে পশ্চিম পাকিস্তানের এক জাতিগোষ্ঠীর রাজা হিসেবে দেখেছেন। রাজা ত্রিদিব রায় খুব চিন্তা-ভাবনা করেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
মি: দেবসরকারের গবেষণা মতে, ত্রিদিব রায়-এর সিদ্ধান্ত ছিল আত্মস্বার্থ-কেন্দ্রিক। নিজের রাজত্ব এবং স্বায়ত্তশাসন টিকিয়ে রাখতেই ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন।
তদুপরি বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ও তার আত্মস্বীকৃত রাজাকার পিতার বিপরীত নয়। তার ডাবল স্ট্যান্ড বাজির খোলস ইতোমধ্যে মানুষের মধ্যে প্রকাশিত হচ্ছে। রাজা পরিবর্তন হয় কিন্তু তার নীতি পরিবর্তন হয় না এই নীতির প্রমাণ দিয়েছেন দেবাশীষ রায় বাংলাদেশে আদিবাসী কনসেপ্ট অনুমোদন না করার পরও শব্দটি স্বীকৃতি আদায়ে উপজাতি জনগোষ্ঠীকে উসকে দিচ্ছেন।
এই দেবাশীষ রায় ১৯৭৭ সাল থেকে চাকমা সার্কেল চিফ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে উপজাতি হিসেবে উল্লেখ করেছে। ১৯৯২ সালে লোগাং গণহত্যা নিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও বাঙালির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিথ্যাচার করতে গণহত্যার চিত্র প্রদর্শনীর জন্য ডকুমেন্টারি ক্যাসেট তিনি তৈরি করেছিলেন। সেই ডকুমেন্টারি ক্যাসেটে উপজাতি হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। যদিও হংকং এসব ভিডিও ক্যাসেট পাচার করতে হবে যাওয়ার আগেই বিমানবন্দর থেকে তিনি আটক হন। উপজাতি শব্দ বিষয়ে দেবাশীষ রায়ের নীতি পরিবর্তন কেন? অর্থাৎ পিতা যেমন রাজ প্রথা বা রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেন ঠিক পুত্রও তার রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে উপজাতি শব্দের বিরোধিতা করতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেননি। চাকমা রাজপরিবারের এই দেশদ্রোহিতা, বিশ্বাসঘাতকতা উপজাতি জনগোষ্ঠীর প্রতি দেশের জনগণের যে সহানুভূতি, আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল তা দিনদিন তলানিতে নিয়ে যাবে। কারণ আদিবাসী এমন একটি শব্দ যা স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করার একটা হাতিয়ার। এই অধিকারের অন্তরালে থাকে সবসময় দেশভাগের চাবিকাঠি। জাতিসংঘের আইএলও কনভেনশনের ১৬৯ এর ১ সাধারণ পার্টের একটি অনুচ্ছেদ তাকে আদিবাসী দাবির পক্ষে ধাবিত করে এবং ২০০৭ সালের আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের ঘোষণাপত্র পাশ হওয়ার পর সে পুরোপুরি পল্টি মেরে উপজাতি শব্দ পরিহার করেই আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবিতে পত্রপত্রিকা, টিভি টকশো ও সভা-সেমিনারে মিলিত হয়েছে। এজন্য পশ্চিমা, ইউরোপীয় এনজিও সংস্থা ও কূটনীতিক মিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করে আদিবাসী দাবি আন্দোলনে অর্থযোগান দিচ্ছে।
উপজাতিরা যে আদিবাসী নয়, তার বাস্তব প্রমাণ:
রাঙামাটি পার্বত্য জেলার সাবেক এমপি মন্ত্রী দীপংকর তালুকদার ১৯৯৭ সালের ২-রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদন করার সময় সন্তু লারমা ও দেবাশীষ রায়কে বলেছিলেন, আদিবাসী হিসেবে চুক্তি সম্পাদিত করার জন্য, কিন্তু তখন তারা বলেছিল এ দেশে কিছু উপজাতি আছে কিন্তু আদিবাসী নেই। তখন তারা চুক্তিতে নিজেদের উপজাতি হিসেবে উল্লেখ করেছিল। চুক্তির খ খণ্ডের জেলা পরিষদ আইনে উপজাতি হিসেবে বিবৃত হয়েছে।
আইনজ্ঞ, সাংবাদিক ও জাতিগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন,
কয়েক বছর ধরে দেবাশীষ রায় আদিবাসী শব্দটির পক্ষে আন্তর্জাতিক আইনের অপব্যাখা দিচ্ছেন। দেবাশীষ রায় একজন আইনজ্ঞ হয়ে কীভাবে আইনের ভুল ব্যাখ্যা দেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। দেবাশীষ রায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা থাকাকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল। তখন তিনি এক রাষ্ট্রীয় গোপন চিঠিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জাতিসত্তাকে উপজাতি হিসেবে তার চিঠিতে সরকারের উল্লেখ করেন। এই থেকে বলা যায়, আদিবাসী বিষয়ে দেবাশীষ রায়ের একমুখে দুই কথা তার ব্যক্তিত্ব নষ্ট করবে। যদিও তার ব্যক্তিত্ব আছে কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে! প্রবাদ আছে হাকিম পরিবর্তন হয় কিন্তু তার হুকুম পরিবর্তন হয় না। কিন্তু দেবাশীষ রায় এই প্রবাদটি লঙ্ঘন করেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, আদিবাসী শব্দটি বহুল প্রচারে দেবাশীষ রায় তার সার্কেলের বাসিন্দাদের আদিবাসী নাগরিক হিসেবে নাগরিক সনদ প্রদান করে আসছে৷ তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ইতোমধ্যে কয়েক দফায় এসেছে।
জানা গেছে, দেবাশীষ রায়ের একমুখে দুই কথার কারণেই গত ১১/১০/২০২০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শাহানারা ইয়াসমিন স্বাক্ষরিত চিঠিতে দেবাশীষ রায়কে নাগরিক সনদ প্রদানে সংবিধান অনুযায়ী শব্দ ব্যবহার করতে জানানো হয়।
১। স্মারকের আলোকে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি তথা পার্বত্য শান্তি চুক্তির “খ” খণ্ডের ১ নং ধারায় পরিষদের আইনে “উপজাতি” শব্দটি বলবৎ থাকবে মর্মে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩ ক অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, “রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন”। স্মারকে সংশ্লিষ্ট সকলকে সংবিধানে উল্লিখিত শব্দাবলি ব্যবহারের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়।
২। বিশেষ সূত্রে জানা যায় যে, উপর্যুক্ত নির্দেশনার বিষয়টি ‘বোমাং সার্কেল’ ও ‘মং সার্কেল’ কর্তৃক যথাযথভাবে পালন
করলেও ‘চাকমা সার্কেল’ কর্তৃক তা নাগরিক সনদপত্র প্রদানে উপেক্ষা করে যাচ্ছেন।
৩। নাগরিক সনদ প্রদানে বা দাপ্তরিক কাজে ‘আদিবাসী’ শব্দের পরিবর্তে সংবিধানের উল্লিখিত শব্দাবলি
সংবিধানের শব্দ ব্যবহারের জন্য পুনরায় অনুরোধ করা হল।
কিন্তু দেবাশীষ রায় তা প্রত্যাখান করে দ্বিমুখী আচরণ করে আসছে। তার এই আচরণে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে তিনি পিতার মত শত্রুপক্ষ অবলম্বনকারী।
দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের দাবি, সংবিধান সংস্কার কমিশন যেন কোনোভাবেই ষড়যন্ত্রমূলক আদিবাসী শব্দটি সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান না করে। যেন স্বীকৃতি প্রদান থেকে বিরত থাকে, একই সাথে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন দাবিদাওয়া সংবিধানে যুক্ত করা থেকে বিরত থাকে।